হুমায়ুনের সময়ে আধিপত্যের জন্য মুঘল-আফগান প্রতিযোগিতার একটি বিবরণ দিন

হুমায়ুন সিংহাসনে আরোহণ করেই দেখেন, দিল্লীর সিংহাসন তাঁর কাছে গোলাপ-শহার পরিবর্তে কন্টকশয্যায় পরিণত হয়েছে। বাবর খমামুনের জন্য যে সামাজ্য মধ্য-এশিয়ার কিয়দংশ থেকে বর্তমান ভারতের পান্তাব, মূলতান, উত্তরপ্রদেশ, গোয়ালিয়র, ডোলপুর, বেয়ানা ও চান্দেনী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ।। কিন্তু এই সাগাজ্যের অভ্যন্তরে যেসব আফগান শক্তিশালী প্রধানরা ছিলেন, তাঁরা তাঁর বশ্যতা অস্বীকার করেন। বাবর সামরিক শক্তির সাহায্যে শত্রুগণকে দমন করে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে যেতে পারেননি। রাজপুতগণও সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় হ্যোছিল মাত্র। ইব্রাহিম লোদীর ভাঙা মাহমুদ লোদী মুঘলদের কাছ থেকে দিল্লীর সিংহাসন ছিনিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর ছিল। মাহমুদ লোদীতে কেন্দ্র করে আফগানগণ পুনরতাখানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এদিকে শের খাঁশক্তি সঞ্চয় করে বাবরের রাজত্বকালের শেষভাগ থেকেই বাংলা ও বিহারে আফগানদের দৃঢ় ধাঁটি গড়ে তুলেছিল। তবে। । শের শাহের অভ্যুত্থানই ছিল হুমায়ুনের পক্ষে সবথেকে বিপজ্জনক। বাংলার সুলতান নুসরৎ শাহ এই সময় আফগানদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন। উপরন্ত বাবরের আক্রমণের সময় আফগান অভিজাতদের মূনতম আলম খাঁ গুজরাটের শাসক বাহাদুর শাহের রাজদরবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাহাদুর শাহ এই সময় আলম খাঁকে প্রচুর অর্থ নিয়েছিলেন এবং এক বিরাট সেনাবাহিনী যোগাড় করে আলম খাঁকে তাঁর পুত্র তাতার খাঁর নেতৃত্বে জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। এদিকে বাহাদুর শাহের জন্যই মুখলদের আধিপত্য দক্ষিণ-পশ্চিমে পরিস্ফুট হতে পারছিল না। য়নের পক্ষে এই পরিস্থিতিতে সিংহাসন সাম্রাজ্যের বৈধ উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও হুমায়ুনের পথে করা দূরহ হয়ে ওঠে। রাজপরিবারের মীর্জাগোষ্ঠীর পরিবরিক দ্বন্দ্বও এই। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রাজপরিবারের মধ্যে মোটেই সম্ভাব ছিল না। যদিও পিতার আদেশ অনুযায়ী হুমায়ুন ভাইদের মধ্যে সাম্রাজ্য বণ্টন করে দিয়ে পিতৃআজ্ঞা পালন করেছিলেন। কিন্তু ইসলামীয় আইনে জ্যেষ্ঠপুত্রের উত্তরাধিকারের আইন স্বীকৃত না-থাকায় কনিষ্ঠ ভ্রাতাগণ সিংহাসনের দাবি কখনও পরিয়াগ করেনি। উপরন্ত মীর্জাগোষ্ঠীর অন্যতম দুই আতি প্রাতা মহম্মদ জামান ও মহম্মদ সুলতান দিল্লীর সিংহাসনের জন্য প্রদূত হয়েছিলেন। দুজনেই অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও যোগ্য সৈনিক ছিলেন। তাঁরা হুমায়ুনের কবল থেকে দিল্লীর করার জন্য সবরকম চেষ্টা চালাতে থাকেন। উপরন্ত মেহদী বাবরের প্রধানমন্ত্রী নিজামউদ্দিন খলিফার প্রচেষ্টায় সিংহাসন দখলের এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। বাবরের মৃত্যুর পর তাঁর গঠিত সেনাদলে ডাঙন দেখা দেয়। বাবর তুর্কী, উজবেক, ফরাসী আফগান প্রভৃতি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর র লোক নিয়ে সেনাদল গঠন করেছিলেন, তা তিনি নিজ ব্যক্তিত্বের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু হুমায়ূনের পক্ষে সেই ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব হ্যানি। হুমায়ুনের বাতাদের মধ্যে কামরান দিল্লীর সিংহাসন অধিকারের জন্য প্রমায়ূনের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হন। সাতাদের মধ্যে কামরানই হুমায়ূনের প্রতি অত্যন্ত বিদ্বিষ্ট ছিলেন।

কামরান হুমায়ূনের চেয়ে বয়সে ছোট ছিলেন। তিনি ইতিমধ্যেই কাবুল ও কান্দাহারের শাসক হয়েছিলেন। আসকরী আয়ুনের চেয়ে বয়সে আট বছরের ছোট ছিলেন। আর ছোট ভাই হিন্দাল আধকরীর বয়সে দু’বছরের ছোট ছিলেন। এঁদের দুজনেরই দিল্লীর সিংহাসনের প্রতি লুভদৃষ্টি ছিল, কিন্তু এদের সেই ব্যক্তিত্ব ও ক্ষমতা ছিল না তাই ঐতিহাসিক লেনপুল বলেছেন- “ever weak and shifty, Alkari and Hindal were dangerous only as tools for ambitious men to play upon. “মনের চরম বিপদের দিনেও কামরান হুমায়ূনের বিরোধিতা করেছেন। মধ্য-এশিয়া ও আফগানিস্থান থেকে বাবর সৈন্য সংগ্রহ করতেন; কিন্তু কাবুল, গাঞ্জাব কামরানের থাকায় হুমায়ুনের পক্ষে সেখান থেকে অত্যন্ত বরহ ছিল। বাবর মাত্র চার বছর অবস্থানকালে ভারতে কোন স্থায়ী শাসনব্যবস্থা স্থাপন করে যেতে পারেননি। স্বভাবতই বাবরের প্রতিষ্ঠিত সাহাজ্য সুদৃঢ় ছিল না। তাঁর বিজিত ভারতীয় প্রজাবর্ণা তখনও পর্যন্ত মুখলদের ‘বিদেশী’ বলে মনে করত। উপরস্থ বাবর আগ্রা ও দিল্লীর কোষাগার থেকে যে সম্পদ পেয়েছিলেন, তা তাঁর প্রজাদের ও সঙ্গীদের অকারণে বদান্যায়া দেখিয়ে বিলি করেন। বহু রাজস্বও তিনি মকুব করে এ গলে কমায়ূনকে সিংহাসনে আরোহণ করার সঙ্গেই এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়তে। বাবর বিজিত সাম্রাজ্যে যে-সমস্ত সামরিক প্রশাদক নিয়োগ করেছিলেন, তারাও নতুন সম্রাট হুমায়ুনের আদেশ মেনে চলতে চাইল না। আরণ, জানত হুমায়ুন ব্যক্তিগত ভাবে দুর্বল ও দোলায়মান চিত্তের ব্যক্তি। তাই লেনপুল বলেছেন, বাবর হুমায়ূনকে একটি কম্পমান সাস্রাজ্য দিয়ে যান।

হুমায়ুন ল্যক্তিগত ভাবেও সমস্যা সৃষ্টি করেছিলেন। কারণ, বাবরের মৃত্যুর পর ভারতে নবপ্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্যের এই দুর্দিনে ও সংকটকালে মুঘল সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য একজন কঠোর শক্তিশালী শাসকের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হুমায়ুনের মধ্যে বিভিন্ন সদগুণের সমাবেশ ঘটলেও, তাঁর মধ্যে সেই সময়ের উপযোগী দৃঢ়চিত্ততার যথেষ্ট অভাব ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের তৎকালীন সংকটে একজন শাসকের যে কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রয়োজন ছিল, সেটা হুমায়ূনের মধ্যে ছিল না। যদিও তাঁর পাণ্ডিত্য ও সাহিত্যের প্রতিভা কম ছিল না। কিন্তু একজন রাষ্ট্রনীতিক হিসেবে যে রাজনৈতিক জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি থাকা দরকার, সেটা বর্মায়ূন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। তিনি দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। লেনপুল বলেছেন, এমন কি ডিমি একনাগাড়ে কোন দুরূহ ও কঠিন । পারতেন ন কোন কাজকে দ্রুত কার্যকরী করতেও পারতেন না। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি আনন্দদায়ী বন্ধু বা একনিষ্ঠ সঙ্গী পারছেন। কিন্তু রাষ্ট্রশাসনে যে গুণাবলীর প্রয়োজন, সেটা হুমায়ুনের অভাব ছিল যুদ্ধে জয়লাভের পর ফললাভের জন্য যে সময়-সাপেক্ষ প্রচেষ্টার প্রয়োজন, তা হুমায়ুনের মধ্যে ছিল না। । যুদ্ধে জয়লাভের পর তিনি হারেমে অন্তঃপুরিকাদের স অহিফেন সেবন করতেন এবং সেখানে স্বর্গ রচনা করে মূল্যবান সময় অতিবাহিত করতেন।

Share
error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading