সোনার তরী :
১২৯৮-এর আষাঢ়ে সাজাদপুরে বসে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বাংলার নদীমাতৃক পল্লিভূমির জীবনের মধ্যে এক চিরন্তন ও মহৎ অনুভূতি অর্জন করেছিলেন। প্রকৃতির সেই প্রসারিত উদাসীনতার মধ্যে বয়ে চলা মানুষের জীবনের নিশিদিনের কর্মস্রোত কবির কাছে অত্যন্ত নিষ্ফল ভাবে প্রতিভাত হয়েছে। সেদিন সেই নিরুদ্দেশ প্রকৃতির শাস্তিময় ঔদার্যে নির্বিকার সৌন্দর্যের দীপ্ত প্রদীপ উন্মনা হয়ে গেছেন তাঁর চারপাশের পৃথিবীর নিত্য ক্ষুদ্রতার জর্জরিত অশাস্তির পাড়ে গিয়ে সোনার তরী কবিতার মধ্যে এই পরিবেশ পুরোপুরি না পাওয়া গেলেও এক ভাবসাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ নিজে এ কবিতার ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন বেশ কয়েক জায়গায়। কবি নিজেই জানিয়েছিলেন চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে লিখিত একটি চিঠিতে সে সোনার তরী কবিতার কল্পনা বর্ষায় পরিপূর্ণ খরবেগে বয়ে চলে পদ্মার উপর বসে। ভরা পদ্মার বাদল দিনের ছবি ভাষায় প্রকাশ পেয়েছিল অবশ্য বেশ কয়েক মাস পরে ফাল্গুনে। কল্পনা ও রচনার এই কালগত ব্যবধানের অসংগতিও কবিকে পীড়িত করেছে। তাই তার মনে হয়েছে সোনার তরীর যে ইতিহাস সত্য তা বিগত দিনের ইতিহাস। যেদিন তার প্রকাশ সেদিনটি নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। আসলেও এই কবিতার সঙ্গে জন্ম রোমান্টিক কবির অনুভূতির এক আত্মিক সম্পর্ক আছে । মানুষের কর্ম প্রচেষ্টা মানুষকে কীর্তি এনে দেয়। তারই দূরবীনে চোখ লাগিয়ে মানুষ কল্পিত ভবিষ্যতকে অমর করে রাখতে চায়। অথচ মহাকাল এই বিরাট পৃথিবীর জীবন নদীতে যে তরীখানি বেয়ে নিয়ে চলেছে তাতে কীর্তিমানের চেয়ে কীর্তি বেশি। সাজাদপুর থেকে লেখা পূর্বোক্ত চিঠিতে এই কথা বলেছিলেন কবি,— “মানুষ সেখানে আপন সকল কাজকে সকল চেষ্টাকে চিরস্থায়ী মনে করে—আপনার সকল ইচ্ছা চিহ্নিত করে রেখে দেয়—পাস্পারিটির দিকে তাকায়, কীর্তিস্তম্ভ তৈরি করে। জীবনচরিত লেখে এবং মৃতদেহের উপর পাষাণের চির স্মরণ গৃহ নির্মাণ করে। তারপর অনেক চিহ্ন ভেঙে যায় এবং অনেক নাম বিস্তৃত হয়, সময়ের অউনার এটা কারোর খেয়ালে আসে না।”
শিলাইদহ পর্বে কবি বাস্তব জীবনের পটভূমিতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। মানুষের কর্মসাধনার সঙ্গে কবির যোগ ঘটেছিল নিরন্তর। অথচ এইখানেই কবির তার কল্পনার রাজ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। এই কর্মজগৎ আর কল্পনার জগৎ যখন পাশাপাশি এসে গেছে তখনই কবি মনে করেছেন জীবনের এবং দুস্তর ব্যবধান তার চারদিকে রচিত হচ্ছে। কবি নিজেকে এই কর্মজগতের একজন বলে মনে করেন। জীবনভোর সেই সাধনার ফসল ফলিয়েছেন তিনি নিজের কর্মভূমিতে। পাস্পারিটির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছেন এই জীবন পর্বের শেষে একদিন সঞ্চিত ফসলের হিসাব মেটাতে বিষাদে পরিপূর্ণ। ভরা নদী বয়ে চলেছে আপন বেগে পাগলপরা। তারই মাঝে একলা হেঁটে একলা নিজের ছোটো খেতে কবি একাকী। এ একাকিত্ব চিরজন্মে চিরজীবনের। তিনি মনে করতেন প্রত্যেক মানুষের চারিদিকে এক তলহীন সীমাহীন ব্যবধান আছে। সেই ব্যবধানের মধ্যে মানুষ কাজ করে চলে তাকে অতিক্রম করতে পারে না। তার বিষণ্ণতা তাকে নাড়া দেয় তবু তাকে মুছিয়ে দেবার সাধ তার নেই। অবশেষে জীবনের পথ যখন প্রান্তে এসে মেশে তখন দেখতে পান কোনো এক কাণ্ডারী নৌকা বেয়ে চলেছে, ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে, তার গানের সুরে ভরা পালের নৌকায় কবি বুঝতে পারেন যে এ কাণ্ডারী তাঁর চিরচেনা। কবির কাছেও আছে জীবন ব্যাপী সাধনা সোনার তরণীতে। কিন্তু সেই তো কবির শেষ কথা নয়। কবি চান এ তরণী সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টাকেও যেন ঠাঁই দেয়। অথচ এখানেই স্থান সংকুলান হল না। সোনার ধান ধরেছে সোনার তরীতে। সে ধানের চাষি তার শূন্য খেতের পাশে পড়ে থাকল একা। মানুষের জীবনের অর্জিত সাধনার ধন মহাপৃথিবীর তরণীতে নিত্য জমা হতে থাকে। কিন্তু এই ধন যারা সৃষ্টি করেছে তাদের কথা কেউ মনে রাখে না, অথচ তারা চায় বেঁচে থাকতে। লক্ষ লক্ষ মানুষের এই বিস্মৃত ইতিহাস কেবল তাদের কীর্তির মধ্যে সাধনার মাঝে অমর হয়ে আছে। বীরেশ্বর গোস্বামীকে লেখা একটি চিঠিতে এই কবিতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবি তাই বলেছিলেন— “মানুষের এই একটি ব্যাকুলতা। এই বেদনা চিরদিন চলিয়া আসিতেছে। ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের ভালোবাসার মধ্যে এই ব্যথা আছে। আমাদের সেবা আমাদের প্রেম আমরা দিতে পারি। সেই সঙ্গে নিজেকে দিতে গেলে সেটা বোঝা হয়ে পড়ে। আমরা প্রীতিদান করিব, কর্মদান করিব, কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা পালাইতে যাবো না, ইহাই জীবনের শিক্ষা।”
আসলে সংসার মানুষের জীবনের সমস্ত কর্ম ও কর্মফলকে সযত্নে রক্ষা করে কিন্তু তার সঙ্গে কর্মকর্তা মানুষটিকে আলাদা করে রেখে দেয় না। মানুষ যখন সংসারের নৌকাকে তার জীবনলব্ধ ফসল দিয়ে ভরিয়ে দেয় তখন এতটুকু অন্তত চায় যে তার চিহ্নটুকু যেন থাকে সেখানে। কিন্তু এই চলমান মানব পৃথিবী যে অনন্ত যাত্রার পথে নেমেছে সেখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কবি লিখেছেন পূর্বক চিঠিতে— “আমি তাহাকে বলি ওগো তুমি আমার সব লও এবং আমাকেও লও। সে আমার সব লয় কিন্তু আমাকে লয় না। আমাদের সকলের কুড়াইয়া লইয়া সে কোথায় চলিয়াছে তাহা কি আমরা জানি ? সে যে অনির্দিষ্টের দিকে অহরহ যাইতেছে। তাহার কুল কি আমরা দেখিয়াছি? কিন্তু তবু এই নিরুদ্দেশ যাত্রার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, এই অপরিণত অথচ মানব সংসারকে আমাদের যাহা কিছু সমস্ত কিছু দিয়া যাইতে হইবে। নিজেতো কিছুই লইয়া যাইতে পারিব না নিজেকেও দিয়া যাইতে পারিব না।”
যে অতৃপ্তি বোধ তার অধরায় অন্বেষা রোমান্টিক কবির স্বভাব বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্র কাব্য জীবনে মানসী-সোনার তরী চিত্রা পর্বে তার বর্ষণ সহজলভ্য। সোনার তরী কবিতাটি এই রোমান্টিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ। যে মানসসুন্দরী তার জীবনের নৌকাখানি বেয়ে চলেছেন কবি চান সেখানেই তার যেন নিত্য স্থান হয়। অথচ অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এই ভেবে কবি শঙ্কিত, হয়তো এই প্রাপ্তি তার জীবনে ঘটল না যাকে তিনি একান্ত আপন করে চান তাকে তিনি পাবেন কিনা এ শঙ্কায় তিনি দোলাচল। তার জীবনের সর্বস্ব দিয়ে কবি অপেক্ষা করে আছেন এই জীবন দেবতার চরণে পরিপূর্ণ সমর্পণের জন্যে। কিন্তু এই বেদনাই অহরহ আজ কবির চারিদিকে মূর্ত হয়ে উঠছে যে সেই সোনার তরীতে হয়তো তার জায়গা হল না। এক নিঃসীম নিঃসঙ্গতায় ভরে ওঠে কবির হৃদয়। এক অতন্ত্রীয় বিরহে তিনি আত্ম হয়ে ওঠেন। আর সোনার তরী এই আত্ম অতৃপ্তিতেই ভরে আছেন।