সমাজ সংসারে যা কিছু পুরনো তা’তেই আমরা ইতিহাস খুঁজি….সেই খোঁজের ভিতর দিয়ে জন্ম নেয় আগ্রহ, সেই আগ্রহ যখন রসদ হয়ে ইতিহাসের কবর খুঁড়ে সাহিত্য উঠে আসে তখন তা হয়ে উঠে কালজয়ী —
তবে সাহিত্যের হাতধরে ইতিহাস সৃষ্টি হয় এ ভাবনা ঠিক নয়, ঠিক এর উল্টো, তা আগেই বলেছি
বিশ্বশান্তি স্থাপনে নারীর অগ্রগতি বা অগ্রগামী ভূমিকা ইতিহাসে আজও উজ্জ্বল সাক্ষরিত।
পৃথিবীতে রানি ক্লিওপেট্রার প্রভাব -প্রত্তিপতি যেমন আছে তেমন আছে মাদার টেরেসা, নাইটিংগেল।
মিশরীয় সভ্যতায় বা গ্রীস সভ্যতায় মহিলাদের
স্থাপত্য বিদ্যা ও ভাস্কর্যে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে কাজ করার কথা আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি।
জানতে পারি আমাদের দেশের ইতিহাস থেকে রাণী লক্ষীবাঈ, মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথা, এবং আরও অনেক অগ্রণী মহিলাদের কথা, যাঁরা তাদের কর্মযজ্ঞের সার্থকতা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্বমহিমায় বিরাজিত —–
তবুও আজ এই ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক নারীকে পারিবারিক কূটনামি, বংশবৃদ্ধির ক্রমধারা
বজায় রাখার জন্য চারদেয়ালে বন্দী করে রাখা হয়।আর সেই বন্ধঘরের চারদেয়ালে মাথাকুটে নারী স্বাধীনতা খোঁজে… খোঁজে মুক্তির স্বাদ।
বর্তমান জীবনে অনেক কিছু পাল্টেছে। মানুষের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, জীবনযাত্রার পদ্ধতি ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যেই পরিবর্তন এসেছে, কিন্ত বদ্ধদ্বারে এখনো গুমরিয়ে মরে নারীর সামাজিক ও মানসিক অবস্থান। হয়তো বাইরের থেকে নারীর অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু তার মনের স্বীকৃতি কি আজও সে পেয়েছে? তার যে একটা স্বতন্ত্র পরিচয় আছে, ইচ্ছে- অনিচ্ছে আছে সেগুলো ক’জনই বা বোঝার চেষ্টা করেন! ক’জনই বা মান্যতা দেন এই চাহিদার।
আজও এই ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক নারীকে স্বাধীন করতে ভয় পায় এই সমাজ। চারদেয়ালে বন্দী থাকা এমনই এক মুক্তিকামী নারী, যার নাম সুবর্ণলতা।
যার প্রকাশ ঘটে আশাপূর্ণা দেবীর কলমে। পুরনো সংসার ও সমাজের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাস।
হ্যাঁ, সেকালের ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন বাংলার সুবর্ণলতারা আজও সংসারের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যাদের খবর কেউ নিতে চায় না।
যাদের সামান্য ইচ্ছেগুলোর দাম চুকাতে হয় বদ্ধঘরে গুমরে মরে; যাদের সমাজ, সংসার বুঝতে অপারগ। স্ত্রীর মনের ঘরে কোনোদিন উঁকি দিয়েও দেখেনি তার স্বামী।
প্রচণ্ড অভিমানী, জেদি, মুখের ওপর সত্য বলা সুবর্ণলতাদের বোঝা জগৎ সংসারের জন্য কঠিনই বটে। এরা তাদের স্বভাবের জন্য লাঞ্ছিত হয়, বিদ্রূপের শিকার হয়, বিরক্তির কারণ হয়। কালকে অতিক্রম করার যে সহজাত স্বভাব নিয়ে সুবর্ণলতারা প্রকৃতিতে আসে।
কিন্তু না, শত শত লাঞ্ছনা, উপহাসের মাঝেও এরা কীভাবে যেন মাথা তুলে আবার দাঁড়ায়। দর্জিপাড়ার গলির বাড়িটায় সেই নয় বছর বয়সে মেজবউ হয়ে প্রবেশ করা সুবর্ণ বাইরের আলো-বাতাস দেখার জন্য কত শত হাহাকার করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
এ যুগের সুবর্ণলতাদের হয়তো সেকালের সুবর্ণলতাদের মত এত বাধা বিঘ্ন সহ্য করতে হয় না, পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। তবে সেকাল আর একালের মধ্যে মিলটা এখনও রয়ে গেছে।
এখনো অনেক পরিবারে নারীর মতামতের কোনো মূল্য নেই। তাছাড়া মানসিক দাসত্ব তো রয়েই গেছে, যেখানে নারীরা আজও অর্থনৈতিক বা সামাজিক দিক থেকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল।
কিছুটা ভাবানায় ভিন্নতা আসলেও এখনকার ভাবনা এমন, কোনো নারী যদি নিজের পায়ে দাঁড়ায়, রাত করে বাড়ি ফেরে, অন্যদের থেকে একটু অন্যরকম ভাবে বা একটু ভালো থাকে, তখন আশেপাশের নারীরাই প্রথমে ‘কেচ্ছা’ রটায় নিজ দায়িত্বে। নারীর জীবনে এক অদৃশ্য শেকল নারীদের মাধ্যমেই তৈরি হয়, যেমন সুবর্ণলতার জীবনে তার ঠাকুমা, তার শাশুড়ি তৈরি করেছে। ভেবে দেখলে বোঝা যায় নারীরাই নারীদের প্রধান শত্রু।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী’র ত্রয়ী উপন্যাসের মধ্যে সুবর্ণলতা অন্যতম। সুবর্ণলতা এক হাহাকারের গল্প, এক মুক্তিকামী আত্মার ব্যাকুল যন্ত্রণার কাতরানি…
এক জীবন্ত জীবনবোধের সহজসরল জীবনযাপন
পথচলার পথের পিচ্ছিল আস্তরণ। যেখানে সে পা ফেলতে চেয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, আর পিছনে টেনেছে তা’কে এই সমাজ ও সংসার। সবশেষে বলা যায়, একটি বিশেষ সময়ের সাহিত্য বুঝতে গেলে, পড়তে হলে, অনুধাবন করতে হলে ওই সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে ভালো করে জানা দরকার কারণ সাহিত্য গড়ে ওঠে সমাজ ও ইতিহাসকে নির্ভর করে। সময়ের সাথে সাথে যেমন সমাজে পরিবর্তন আসে সাহিত্যেও তেমনি পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়। তাই সমাজ ও ইতিহাসের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক অতি নিবিড়। এককথায় বলা যায় একটি বিশেষ সময়ের মানুষের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ভালো করে না জেনে ঐ সময়ে লিখিত কোন সাহিত্য কর্ম অনুধাবন করা কঠিন।
এভাবে প্রতিটি সাহিত্য কর্মই সাহিত্য কর্মটি লিখিত হওয়ার সময়ের সমাজের চিত্র তুলে ধরে। আর এ কারণে সাহিত্যকে সমাজের দর্পন হিসেরে উল্লেখ করা হয়।