জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটি প্রকৃতপক্ষে একটি আখ্যানধর্মী কবিতা। এখানে একটি প্রণয়বঞ্চিতা নারীর আত্মকথনমূলক আখ্যানের আভাস আছে। জয় গোস্বামীর আলোচ্য কবিতার আখ্যানটি স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতাটিকে মনে পড়ায়। পাঠক চমৎকৃত হয়ে লক্ষ করেন, ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতার আত্মকথনধর্মী আখ্যানটির সঙ্গে মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটির আখ্যানের এক আশ্চর্য সাদৃশ্য। অবশ্য আপাত সাদৃশ্যের পাশাপাশি উভয় প্রেমবঞ্চিতা নারীর প্রতিক্রিয়াগত পার্থক্যটিও সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না।
‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ নামক একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির একটি কিশোরীর আত্মকথনমূলক কাহিনী আছে আলোচ্য কবিতাটিতে। প্রকৃতপক্ষে মেয়েটির কিশোরকালের প্রণয়তৃষ্ণার জাগরণ ও অবশেষে বঞ্চনার এই ইতিহাসটি বিকৃত হয়েছে অতীতচারণার ভঙ্গিতে। পরিণত বয়সে পৌঁছে সমগ্র ফেলে আসা জীবনটির দিকে সিংহাবলোকন করেছে অসহায়, দারিদ্র্যক্লিষ্ট মেয়েটি। লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতাটিতেও একইভাবে অতীতচারণার সূত্রেই উঠে এসেছে মালতী নামক মেয়েটির ইতিহাস। মালতী তার জীবনের বঞ্চনার ইতিকথা শুনিয়েছে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রকে। আর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’-এর অনামা কালো মেয়েটির আত্মকথন আসলে উচ্চারিত তার পূর্বপ্রণয়ী বেণীমাধবকে উদ্দেশ করে।
‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’-এর আখ্যানটি আসলে নিহত-প্রেম একটি সাধারণ মেয়ের আত্মকাহিনি। মালতীবালা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পাঠ করার সময় স্কুলঘরের বাইরে ‘দিদিমণির পাশে দিদিমণির বয়’-কে দেখে তারও মনের কোণে অঙ্কুরিত হয়েছিল প্রেমের তৃষ্ণা। শহর থেকে বেড়াতে আসা বেণীমাধব তাই সহজেই তার হৃদয়কে আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু প্রেমের অবুঝ আকর্ষণের পাশাপাশি সামাজিক বাস্তবতার বোধও মেয়েটির ছিল। তাই বয়ঃসন্ধিজনিত স্বাভাবিক লজ্জার পাশাপাশি মেয়েটি আরও দুটি ব্যাপার সেই পূর্বরাগ পর্বেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল : এক, বেণীমাধব মেধাগত দিক থেকে তার থেকে অনেক উঁচুতে— “বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো।” দুই, শহরবাসী মেধাবী বেণীমাধবের সঙ্গে তার আর্থিক ও সামাজিক পার্থক্যটাও প্রায় অলঙ্ঘ্যনীয়— “বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে।”
তবু প্রেম বোধহয় কোনো বাধা মানতে চায় না। প্রাকৃতিক নিয়মেই দেহে মনে বসন্ত দোলা দেয় মেধা বা আর্থিক সঙ্গতির পরোয়া না করেই—“কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জরী।” ফলে যৌবনের তমালতরুমূল থেকে যেন ভেসে আসে বেণীমাধবের প্রেমের বাঁশির আহ্বান। পূর্বরাগের সেই অস্থিরতায় ভুল হয়ে যায় পড়ায়, অঙ্কে ভুল হয় বারবার। ক্রমে আলাপ হয় বেণীমাধরের সঙ্গে সুলেখাদের বাড়ি। তারপর গোপনে দেখা হয় ব্রিজের ধারে।
কিন্তু এই অসম প্রেমের ব্যর্থ পরিণাম বোধহয় সুনিশ্চিত হয়েই ছিল। কিশোরকালের মোহ-উন্মাদনা কেটে গেলে বেণীমাধব পেয়ে যায় রূপে-গুণে উপযুক্ত অন্য সঙ্গিনী। ভুলে যায় মালতীবালা স্কুলের সেই কিশোরীটিকে। এজন্য অবশ্য কোনো অভিযোগ নেই মেয়েটির। বরং বেণীমাধব তার উপযুক্ত সঙ্গিনীকে নিয়ে ভালো থাকুক এটুকুই তার প্রার্থনা। তবু এই ভালো চাওয়ার অন্তরালে তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণটি পাঠকের বুঝে নিতে ভুল হয় না। দারিদ্র্য আর প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামের দুঃসহ গ্লানি নিয়ে কোনোক্রমে দিন কাটে এখন মেয়েটির। এই দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই একদিন তার ছোটো বোনটি চোরাপথের বাঁকে হারিয়ে যায়। পাড়ার সেলাই দিদিমণি হয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে করতেই দিন চলে যায় তার। কিন্তু এই জীবনের ভবিষ্যৎ জানা নেই তার।
মনের ক্ষোভ এবং প্রণয়ের বঞ্চনা তীব্র আগুন হয়ে ঝরে পড়তে চায়। অথচ কী এক গভীর অবসাদে, অর্থহীন জীবনের নৈরাশ্যে সেই ক্ষোভ বা প্রতিবাদের আগুনও জ্বলে না—“তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?” আর এই অবসাদ ও নৈরাশ্যের ভিতর থেকেই নিজের ছোটো বোনের মতো নষ্ট ভ্রষ্ট হয়ে যাবার একটা আশঙ্কাও উঁকি দেয় মেয়েটির মনে—“আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই।”
সমগ্র কবিতাটি প্রায় অনিবার্যভাবেই মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতাটিকে। সেখানেও গ্রামের কালো এবং সাধারণ মেয়েটির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল নরেশ নামক এক যুবকের। অল্প বয়সের মন্ত্র’-তে মালতীও ভুলে গিয়েছিল যে, সে সাধারণ মেয়ে। ভালোবাসার বহু নিবিড় প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিদেশে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নরেশ মালতী নামক মেয়েটিকে উপেক্ষা করে। মালতীকে পাঠানো চিঠির মধ্যে বারবার নরেশ জানিয়ে দিত, বিদেশের সুন্দরী এবং অসাধারণ মনীষাদীপ্ত সেই সহপাঠিনীদের তুলনায় মালতী নিতান্ত সাধারণ এবং নরেশের মতো সম্ভাবনাময় যুবকের পক্ষে একান্ত অনুপযুক্ত।
অর্থাৎ প্রণয়ের অপমৃত্যু ঘটেছে দুটি কবিতার ক্ষেত্রেই মেধা ও সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের জন্য। এদিক থেকে ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’-এর কালো মেয়েটির সঙ্গে ‘সাধারণ মেয়ে’ মালতীর জীবনের বস্তুত কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু একটু অভিনিবেশ দিলেই বোঝা যাবে, উভয়ের ক্ষেত্রে প্রণয়-বঞ্চনার প্রতিক্রিয়ার বিপুল পার্থক্য আছে।
‘সাধারণ মেয়ে’-র মালতী প্রণয়ের বঞ্চনার প্রতিক্রিয়ায় তীব্র ক্ষোভে প্রতিহিংসা প্রবণ হয়ে উঠেছিল। সে অনুরোধ করেছিল, যেন তাকে নিয়ে লেখা গল্পে শরৎবাবু মালতী চরিত্রকেও করে তোলেন জ্ঞানে ও বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্যে অসামান্যা। এম. এ. পাশ করিয়ে সেই গল্পের মালতীও যাবে বিদেশে। সেখানে জ্ঞানী-গুণীজনেদের কাছে স্বীকৃত হবে তার অসামান্যতা। আর সেই স্বীকৃতির গৌরবে সে নরেশকে নিতান্ত উপেক্ষা করে এগিয়ে যাবে আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে। নরেশের উপেক্ষা আর বঞ্চনার প্রত্যুত্তরে নিজের অসামান্যতাকে সপ্রমাণ করেই সে নিতে চেয়েছিল প্রতিশোধ। মালতী প্রেমবঞ্চিতা হয়েও শকুন্তলার মতো ত্যাগ আর তপস্যার পথে প্রেমসিদ্ধির মিথ্যা স্বপ্ন দেখে আত্মপ্রবঞ্চনা করতে চায়নি। তাই শরৎবাবুকে সে স্পষ্ট জানিয়েছিল তার অভিনব প্রতিহিংসা বাসনার কথা—
“তুমি যার কথা লিখবে
তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে।”
‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’-এর কালো মেয়েটিও নিজেকে নষ্ট করে সেই আত্মনিগ্রহের পথেই প্রতিহিংসা বাসনা চরিতার্থ করতে চেয়েছে কবিতার শেষ পঙক্তিতে। কিন্তু তার সেই প্রতিহিংসা বাসনা অনুচ্চ, অনুগ্র; বরং অবসাদের দ্বারা আচ্ছন্ন। পাড়ার সেলাই দিদিমণি হয়ে প্রাত্যহিক দিনযাপনের গ্লানিই তার ভবিতব্য।
‘সাধারণ মেয়ে’ মালতীরও ভবিতব্য একই। আসলে শরৎবাবুকে যে মালতী চরিত্র রচনা করতে অনুরোধ করেছে সে, তা তো কল্পনা। বাস্তবের সঙ্গে তার যোজন তফাৎ। বাংলাদেশের সাধারণ মেয়ের বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন নিতান্তই অলীক, তা জানে মালতীও। তাই তার অন্তিম উচ্চারণ—”হায়রে বিধাতার অপব্যয়।”
কিন্তু তবু আরও একটি পার্থক্য আছে দুটি কবিতার প্রেমবঞ্চিতা নারী চরিত্রে। ‘সাধারণ মেয়ে’-র মালতীর প্রেমের স্বপ্ন মুছে গেছে বঞ্চনার আঘাতে। মিথ্যা প্রতিহিংসার স্বপ্ন নিয়ে শুধু তার বেঁচে থাকা। কিন্তু জয় গোস্বামীর কালো মেয়েটি বঞ্চনার আঘাতে সব হারিয়েও যেন প্রেমের তৃষ্ণাকে বুকে করেই বেঁচে থাকে। ব্যক্তি বেণীমাধব তার কাছে অর্থহীন হয়ে গেলেও, বেণীমাধব তার কাছে যেন হয়ে ওঠে প্রেমতৃষ্ণার এক বিমূর্ত প্রতীক। তাই সব হারিয়েও তার ব্যাকুল উচ্চারণ জেগে থাকে—“বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাব।