সদুক্তিকর্ণামৃত লক্ষ্মণসেনের (আনু. ১১৭৮-১২০৬ খ্রি) ২৭তম রাজ্যাংকে ১১২৭ শকাব্দে (১২০৫ খ্রি) শ্রীধরদাস সংকলিত সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ। সদুক্তিকর্ণামৃতের ভূমিকা থেকে জানা যায় যে, শ্রীধরদাসের পিতা শ্রী বটুদাস ছিলেন লক্ষ্মণসেনের সামন্ত অধিপতিদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সামন্ত (মহাসামন্তচূড়ামণি)। তিনি লক্ষ্মণসেনের বন্ধু ছিলেন। গ্রন্থের শেষে শ্রীধরদাস নিজেকে ‘মহামান্ডলিক’ বা প্রশাসনিক ইউনিট ‘মন্ডল’-এর একজন মহান শাসক হিসেবে বর্ণনা করেন।
শ্রীধরদাসের সদুক্তিকর্ণামৃত (শ্রুতিমধুর চমৎকার বাণী) এ যাবৎ আবিষ্কৃত প্রাচীন বাংলার সংকলিত দ্বিতীয় সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ। প্রথম কাব্যগ্রন্থটি বিদ্যাকরের সুভাষিতরত্নকোষ। বিদ্যাকরের কাব্যগ্রন্থে রয়েছে ১৭৩৮ শ্লোক। অপরপক্ষে সদুক্তিকর্ণামৃত কাব্যে স্পষ্টভাবে উদ্ধৃত শ্লোক সংখ্যা ২৩৭৭। দুটি কাব্যগ্রন্থেই অভিন্ন ৬২৩টি স্তবক আছে।
সদুক্তিকর্ণামৃতে ‘প্রবাহ’ নামে পাঁচটি অধ্যায় আছে। প্রতিটি প্রবাহ আবার অনেকগুলি ‘বীচি’ বা তরঙ্গে বিভক্ত। এসকল প্রবাহের শিরোনাম নিম্নরূপ: ‘অমরপ্রবাহ’ (যেখানে ঈশ্বরকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে); ‘শৃঙ্গারপ্রবাহ’ (এখানে রয়েছে প্রেম ও প্রেমিক বিষয়ক এবং বিভিন্ন ঋতুর বর্ণনা); ‘চাতুপ্রবাহ’ (বিভিন্ন ধরনের চাটুকারিতা বা তোষামোদি বিষয়ক অধ্যায়); ‘অপদেশপ্রবাহ’ (বিবিধ বিষয় নিয়ে, যেমন- বাসুদেব, মহাদেব প্রমুখ দেবতা, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলি যেমন- সমুদ্র, নদ-নদী, রত্নসম্ভার যেমন পান্না, জীব-জন্তু যেমন সিংহ, হাতি, মৃগ বা হরিণ, ফুলের মধ্যে পদ্ম, কেতকী, গাছ-গাছালি যেমন অশোক, পাখিদের মধ্যে কোকিল, শুক, চাতকের বর্ণনা রয়েছে এ অংশে); এবং ‘উচ্চবাচপ্রবাহ’ (এ অংশে মানুষ, পাখি- যেমন বক, চক্রবকক বা দীর্ঘচঞ্চু পাখি বিশেষ এবং অপরাপর বিষয়- যেমন কবি, কাব্য, মনস্বী, দরিদ্র গৃহী, জরা, বৃদ্ধ, কাল ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা আছে)।
ধ্রুপদী যুগের লেখক যেমন কালিদাস, ভবভূতি, অমর, রাজশেখর এবং সমকালীন বেশ কয়েকজন বাঙালি লেখকের সংস্কৃত কাব্য থেকে নিয়ে শ্রীধরদাস তাঁর কাব্যগ্রন্থটি সংকলন করেন। মনে হয়, তিনি বিদ্যাকরের সুভাষিতরত্নকোষ কাব্যগ্রন্থ থেকেও বেশকিছু শ্লোক সংগ্রহ করেন। তিনি যোগেশ্বর, শতনন্দ, অভিনন্দ, ধরণীধর, বরাহ, অচল, বল্লণ, মনোবিনোদ, শুভঙ্কর, চক্রপাণি, লক্ষ্মীধর প্রমুখ কবির উদ্ধৃতি দেন। সম্ভবত এঁরা সকলেই ছিলেন বাঙালি কবি অথবা নিদেনপক্ষে পূর্বভারতবাসী বা বাংলা ও বিহার নিয়ে গঠিত পাল সাম্রাজ্যের অধিবাসী। এসকল কবির মধ্যে কেউ কেউ ‘গ্রাম্য কবি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শ্রীধরদাস সেনযুগের কয়েকজন বিখ্যাত সভাকবি যেমন জয়দেব, উমাপতিধর, শরণ, ধোয়ী, গোবর্ধন আচার্য প্রমুখের শ্লোক উদ্ধৃত করেন। বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন, কেশবসেন প্রমুখ রাজকবির শ্লোকও তিনি গ্রহণ করেন। রাজা লক্ষ্মণসেন শ্রীধরদাসেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাংলার সেন শাসনকালব্যাপী (আনু. ১০৯৭-১২২৫ খ্রি) ছিল ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিপত্তির যুগ। এ সময়ে বাংলায় সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা শীর্ষে পৌঁছে। বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর ওপর ৪৭৫টিরও অধিক শ্লোক উদ্ধৃত করার মাধ্যমে শ্রীধরদাস তাঁর সংকলিত কাব্যগ্রন্থে গভীর অনুরক্তি প্রকাশ করেন। এতে অন্যান্য বিশ্বাসের তুলনায় বৈষ্ণববাদের প্রতিই তাঁর ঝোঁক বেশি প্রকাশ পায়। এখানে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় এই যে, সংকলকের পৃষ্ঠপোষক লক্ষ্মণসেন ছিলেন বিষ্ণুর একজন উপাসক। সদুক্তিকর্ণামৃতে রচয়িতার নামহীন বেশ কিছু শ্লোকও রয়েছে।
শ্রীধরদাস আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটি সংকলন করেন মূলত সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে। এটি ছিল এমন এক সাহিত্য কর্ম যা সাধারণ মানুষের শ্রান্তি বিনোদন এবং তাদের সাহিত্যরস ও মেজাজ-মর্জির সঙ্গে মানানসই ছিল। শ্লোকে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত বৃদ্ধ বয়সের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ মানুষ উপকৃত হতো। এ কাব্যগ্রন্থে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, নারী-সৌন্দর্য, ধনীদের তোষামোদ এবং দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত দৃশ্যাবলি- যেমন নদী, পাহাড়, গাছপালা ও ফুল সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। সদুক্তিকর্ণামৃত কেবল সাহিত্যিক মূল্য বিচারেই নয়, প্রাচীন বাংলার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অমূল্য উৎস হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।