রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি আলোচনা কর।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদ

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রচলিত কাল্পনিক মতবাদগুলির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও আলােচিত মতবাদ হল সামাজিক চুক্তি মতবাদ।

মূল বক্তব্য:
সুদূর অতীতে মানবসমাজে রাষ্ট্র ও সরকারের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না। সেসময় মানুষের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক চেতনাও সৃষ্টি হয়নি। রাষ্ট্রহীন সেই অবস্থাকে প্রাকৃতিক অবস্থা বা ‘State of Nature’ বলে অভিহিত করা হয়। চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে কয়েকজনের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় সমাজের সৃষ্ট হয়নি। এই অবস্থা ছিল ‘Pre-Social’ বা প্রাকসামাজিক চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অন্য একদল মনে করেন, এই অবস্থায় সমাজের অস্তিত্ব থাকলেও রাষ্ট্রের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না৷ একে তাঁরা প্রাকৃরাষ্ট্রীয় বা Pre-State বলে আখ্যায়িত করেন। যাই হােক, এই প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবনযাপন প্রাকৃতিক আইন দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। ক্রমশ প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন দুর্বিষহ এবং অসহনীয় হয়ে ওঠে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে আদিম মানুষ স্বেচ্ছায় পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গড়ে তােলে।

প্রধান প্রবক্তা:
চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টির ধারণা নতুন নয়৷ মহাভারতের শান্তিপর্বে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে, সফিস্টদের বক্তব্যে, বাইবেল-এর ওল্ড টেস্টামেন্টে সামাজিক চুক্তি মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে মূলত যে তিনজন রাষ্ট্রদার্শনিক এই মতবাদকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁরা হলেন, সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ টমাস হবস ও জন লক এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি চিন্তাবিদ জা জ্যাক রুশাে।

সমালােচনা:
রাষ্ট্রের উৎপত্তির পটভূমি পর্যালােচনায় সামাজিক মতবাদের মৌলিক অবদান থাকা সত্ত্বেও মতবাদটি নানা কারণে লােচিত হয়েছে, যেমন-

ইতিহাসের বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদানকারী: সামাজিক চুক্তি মতবাদ অনুযায়ী প্রাক রাষ্ট্রীয় অবস্থায় ব্যক্তি চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছিল—এই দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। অধ্যাপক গেটেলের মতে, আদিম অবস্থায় সমাজের একক হিসেবে ব্যক্তির কোনাে স্থান ছিল না, সমাজের একক ছিল পরিবার।

অবৈজ্ঞানিক:

সমালােচকদের মতে, দুটি পক্ষের উপস্থিতি ছাড়া কোনাে চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে না। কিন্তু সামাজিক চুক্তি মতবাদে আদিম অবস্থায় শুধুমাত্র একটি পক্ষের উপস্থিতিকে দেখানাে হয়েছে। সুতরাং, একটি পক্ষের উপস্থিতিতে চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনা আদৌ থাকতে পারে না।

উপসংহার: উপর্যুক্ত বিচ্যুতিগুলি সত্ত্বেও সামাজিক চুক্তি মতবাদের তাৎপর্যকে কোনােভাবেই অস্বীকার করা যায় না। বার্কারের মতে, সামাজিক চুক্তি মতবাদ ‘ন্যায়’ ও ‘স্বাধীনতা’-র মহান গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রচার করে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধকে সুদৃঢ় করেছে।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading