‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে উত্তরসাধকদের সংকট ও মুক্তির যে রূপরেখা প্রাবন্ধিক অঙ্কন করেছেন তার পরিচয় দাও।

রবীন্দ্রনাথ ও “উত্তরসাধক” প্রবন্ধে উত্তরসাধকদের সংকট ও মুক্তির রূপরেখা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা সাহিত্য এবং দার্শনিক চিন্তার অন্যতম পথপ্রদর্শক, তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে মানবজীবন, সমাজ, ধর্ম, এবং সংস্কৃতির নানা দিক বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর প্রবন্ধগুলি শুধু সাহিত্যিক স্তরে নয়, একটি সামাজিক ও দার্শনিক স্তরেও গুরুত্বপূর্ণ, এবং এগুলির মধ্যে ‘উত্তরসাধক’ একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ হিসেবে চিহ্নিত। এই প্রবন্ধে তিনি উত্তরসাধক (অথবা আধুনিক সাধক) বা আধুনিক মানবের সংকট এবং তার মুক্তির পথ অনুসন্ধান করেছেন।

উত্তরসাধক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মূলত দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আলোচনা করেছেন: একদিকে প্রাচীন ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক চেতনা এবং অন্যদিকে আধুনিকতার চাহিদা ও সংকট। উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংকট এবং এক ধরনের মানসিক বিভ্রান্তি উত্তরসাধকের জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে, এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে উত্তরসাধকের মুক্তির পথও অঙ্কন করেছেন। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে সংকটের কথা বলেছেন এবং তার মুক্তির জন্য যে রূপরেখা দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি।

১. উত্তরসাধকের সংকট: পুরোনো ও নতুনের দ্বন্দ্ব

‘উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক মানুষের সংকটের কথা তুলে ধরেছেন। প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিক দর্শন এবং আধুনিক বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদী চিন্তা একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে রয়েছে—এটি উত্তরসাধকের মূল সংকট। তিনি দেখিয়েছেন, আধ্যাত্মিক সাধনা, যেখানে একরকম আত্মবিলীনতা বা ‘অহংবিলোপ’ (ego dissolution) ধারণা করা হয়, সেখানে উত্তরসাধক বা আধুনিক মানুষ যখন তার আধুনিক চিন্তা ও সমাজের বাস্তবতায় বিচলিত হন, তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।

প্রাচীন ভারতের সাধনা ছিল এক ধরনের আত্মা ও জগতের মধ্যে গভীর সম্পর্কের ধারণা, যেখানে ব্যক্তি আত্মাকে ব্রহ্মের অংশ হিসেবে দেখতে পারত। এই সাধনা ছিল এক ধরনের ‘ঊর্ধ্বমুখী’ প্রচেষ্টা, যেখানে ব্যক্তি নিজের আত্মাকে শ্রদ্ধা ও পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে চাইত। কিন্তু আধুনিক মানুষ, বিশেষ করে ভারতীয় সমাজে, নানা পশ্চিমা চিন্তা, বিজ্ঞানের প্রভাব, এবং সমাজ সংস্কারের চাপে পড়েছে। এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে, উত্তরসাধক অনুভব করেন যে, তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তা ও ধারণাগুলি একধরনের পুরনো, অচল হয়ে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ এই সংকটকে খুব সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন, যেখানে আধুনিক মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন এবং শারীরিক-মানসিক বাস্তবতার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়।

উত্তরসাধক, প্রাচীন আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণার প্রভাবের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় ও বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের মধ্যে পড়ে যান। তার মনোভাব এবং জীবনযাত্রার আদর্শ বদলে যেতে থাকে, কিন্তু তিনি পুরনো আদর্শগুলোকে ছেড়ে দিতে পারেন না। এটি তার সংকটের মূল জায়গা—এমন এক সংকট, যা তাকে আত্মবিশ্বাস এবং সমাজের মাঝে শূন্যতার দিকে ঠেলে দেয়।

২. উত্তরসাধকের মুক্তি: আত্মসমীক্ষা ও আত্মনির্ভরতার পথে

রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে, শুধুমাত্র সংকটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই সংকটের মীমাংসা কেবল বাইরের কোনো ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক প্রথায় নয়, বরং আত্মানুসন্ধানে নিহিত। ‘উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে তিনি তার এই মুক্তির রূপরেখা স্পষ্ট করেছেন।

(i) আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, একটি জাতি বা ব্যক্তির মুক্তি তখনই আসবে যখন সে নিজের আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে। তিনি বলেছিলেন, “মানুষ যখন আত্মবিশ্বাসে অটল থাকে, তখন সে প্রকৃত দীক্ষা পায়।” আত্মবিশ্বাসের ধারণা কেবল বাহ্যিক শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়, বরং একজন মানুষের গভীর অন্তরের শক্তি ও চিন্তাশক্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি বলেছিলেন যে, একজন উত্তরসাধককে তার আধ্যাত্মিক আত্মবিশ্বাসের জোরে আধুনিক চিন্তাভাবনা এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণকে গ্রহণ করতে হবে, এবং পুরনো আধ্যাত্মিক ধারণাগুলির সাথে নতুন ধারণাকে মেলানোর চেষ্টা করতে হবে।

অর্থাৎ, উত্তরসাধককে নিজের অন্তরের খোঁজে যেতে হবে এবং তার ব্যক্তিগত শক্তির উত্থান ঘটাতে হবে। রবীন্দ্রনাথের মতে, নিজের আত্মবিশ্বাসে জোর দিয়ে আত্মনির্ভরতার দিকে এগিয়ে গেলে, সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তির মধ্যে সেতু তৈরি করা সম্ভব।

(ii) সংস্কৃতির সঙ্গে ঐক্য

রবীন্দ্রনাথের মতে, এক্ষেত্রে সংস্কৃতি ও আধুনিক চিন্তার মেলবন্ধন অত্যন্ত জরুরি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সংস্কৃতির মূলে রয়েছে মানবিক মূল্যবোধ এবং সেই মূল্যবোধের সংরক্ষণ করা উচিত। এই মূল্যবোধের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিক প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তার সঙ্গে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তবে, এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে, ব্যক্তিকে প্রথমে তার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

উত্তরসাধককে প্রাচীন ভারতে প্রচলিত আধ্যাত্মিক বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে নতুন চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে হবে, যা আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞান গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। রবীন্দ্রনাথ এখানে বিশেষভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কথা বলেছেন, যেখানে তিনি ভারতের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির মধ্যে আধুনিকতার জ্ঞান ও বিশ্লেষণ যুক্ত করতে চাইতেন।

(iii) আত্মানুসন্ধান ও মানবিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন

রবীন্দ্রনাথ ‘উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে সামনে আনেন—এটি হল আত্মানুসন্ধান এবং মানবিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শুধু ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক উত্থান নয়, বরং মানবতার প্রতি গভীর বিশ্বাস ও নৈতিক দায়িত্বও একজন উত্তরসাধকের মুক্তির পথে আসবে। রবীন্দ্রনাথ আধ্যাত্মিকতার নতুন গতি দিতে চেয়েছিলেন, যেখানে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস ও সমাজের উন্নতি একসঙ্গে চলতে পারে।

এই প্রবন্ধে, রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তির জীবনে একটি নতুন উপলব্ধির জন্ম নিতে হবে। এটি কেবল একটি আধ্যাত্মিক পরিবর্তন নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন। একটি উন্নত সমাজ গঠনের জন্য একজন উত্তরসাধককে তার আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যা সামাজিক দিক থেকে আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলবে।

৩. উত্তরসাধকের মুক্তির উপাদানসমূহ

রবীন্দ্রনাথের কাছে মুক্তি ছিল একটি অন্তর্নিহিত ব্যাপার, যা একদিকে আধ্যাত্মিকতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আরেকদিকে সামাজিক সত্যকে উপলব্ধি করার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হতে পারে। তিনি আধ্যাত্মিকতা এবং আধুনিকতা, প্রাচীন চিন্তা ও নতুন উপলব্ধির মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের মতে, মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ছিল:

আত্মবিশ্বাস এবং আত্মনির্ভরতা—নিজের শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের উপর ভরসা রেখে, পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে নিজের পথ খুঁজে নেওয়া।

আধ্যাত্মিক ও সামাজিক চেতনার একীকরণ—আধুনিক জ্ঞান ও প্রাচীন আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা।

নতুন মানবিক মূল্যবোধ—আধ্যাত্মিক সাধনা ও মানবিক উন্নতি একসাথে অর্জন করা।

উপসংহার

‘উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক মানবের সংকট এবং তার মুক্তির পথ নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, একজন উত্তরসাধকের জন্য মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন সে তার আধ্যাত্মিক চেতনা ও আধুনিক সমাজের প্রয়োজনীয়তা বুঝে একযোগে কাজ করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, সংকট থেকে মুক্তির জন্য আমাদের নতুন করে নিজের আত্মবিশ্বাস এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে জীবনকে চিন্তা করা উচিত।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading