‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় যে বিদায়ের সুর ধ্বনিত হয়েছে, তা বর্ণনা করো।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমিক। প্রকৃতি তাঁর কবিসত্তার মূল ধরে টান দিয়েছিল সেকথা সত্যি ; কিন্তু তিনি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিরহ-বেদনা, প্রেম-প্রীতিকেও অস্বীকার করেননি ; অথবা, মানুষের সমস্ত মানবিক অনুভূতিকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন ; তার চেয়েও বড়ো কথা হচ্ছে, ভালোবাসতেন। তাই তিনি মানব-প্রেমিক। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটিতে তাঁর সেই নিগূঢ় মানবপ্রেমেরই অপূর্ব আর্তি আর ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে।

এই বিশ্বে দুটি শক্তিতে অবিরাম যুদ্ধ চলেছে। এক দিকে জীবন, তার হাতিয়ার প্রেম প্রীতি-ভালোবাসা ; আর একদিকে নির্মম নিষ্ঠুর মৃত্যু। এই বিশ্বে এক দিকে চলেছে ধ্বংস আর একদিকে চলেছে সৃষ্টি। এই সৃষ্টি প্রেমের। সুতরাং লড়াই চলেছে প্রেম আর মৃত্যুর মধ্যে। একদিকে মৃত্যু এসে হুংকার দিয়ে বলছে—’চল’, প্রেম বাধা দিয়ে বলছে—‘না, যাবে না’। একদিকে দুর্নিবার ধ্বংস বলছে, ‘সময় হয়েছে চল’, আর একদিকে প্রেম বলছে—“যেতে নাহি দিব’। মৃত্যু সর্বজয়ী, তার শক্তি অসীম ; মহাকালের অমোঘ নিয়মে ধ্বংস করার শক্তিতে সে বীর্যবান। আর একদিকে প্রেম–সে দুর্বল। মৃত্যু যাকে ছিনিয়ে নিতে আসে তাকে ধরে রাখার কোনো শক্তি মানুষের নেই সেকথা সত্যি; কিন্তু তাই বলে সে ভীরু নয়। সে তার প্রেমের হাতিয়ার উচিয়ে মৃত্যুর সর্বসংহা শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। নিষ্ঠুর অমোঘ বিধানকে মানি না বলে সে বিদ্রোহ ঘোষণা করো। কিন্তু মৃত্যু এবং ধ্বংসকে প্রতিরোধ করার মতো শক্তি তার নেই। তাই তাকে শেষ পর্যন্ত প্রিয়জনকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিতে হয়; কিন্তু তাই বলে বিদ্রোহ করতে সে ছাড়ে না; তার ক্ষুদ্র পেলব শক্তি নিয়ে ভয়ংকর শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পিছপাও হয় না সে।

কবির চার বছরের কন্যা। কতই বা তার শক্তি ! সে বাধা দিল না, কবির হাত ধরা টানাটানি করল না। চেঁচিয়ে পাড়াকে সন্ত্রস্ত করে দিল না। সে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার

প্রচারিত ‘যেতে আমি দিব না তোমায়’।

কিন্তু তবু সময় হলে, কবিকে যেতে দিতে হল। তবুও চলে যেতে হল কবিকে। কবি যেতে যেতে ভাবলেন, তাঁর অতটুকু মেয়ে ! সে এই শক্তি কোথা থেকে পেলো!

শুধু তাঁর কন্যা নয়, পৃথিবীর শত লক্ষ কোটি বস্তু অবিরাম এই একই কথা বলছে। মাতা বসুন্ধরা সহস্র হাত দিয়ে তাঁর সন্তানদের বুকের ওপরে আঁকড়ে ধরে বলছেন, মৃত্যুর হাতে কিছুতেই আমার সন্তানদের আমি ছেড়ে দেব না। কিন্তু হায়, কাকে তিনি মৃত্যুর হাত থেকে ধরে রাখতে পারছেন ? মৃত্যু কারও স্নেহকে তোয়াক্কা করে না। সে কেবল নির্মম নয়, জহ্লাদই নয়, সে উদাসীন। মানুষের প্রেম-প্রীতিকে সে উপহাস করে চলে যায়, মানুষের কাছ থেকে তার প্রিয়জনকে নিয়ে যায় ছিনিয়ে। মানুষের ‘অশ্রুজলে, হাহাকারে তার হৃদয় ব্যথিত হয় না। সে চির উদাসীন, সে বিধাতার প্রাণহীন অমোঘ নিয়ম।

তাহলে কি প্রেম ব্যর্থ? মানবদরদী কবি তা স্বীকার করতে রাজি নন। মৃত্যু যদি বিশ্ববিধাতার অমোঘ অপরিবর্তনীয় বিধি হয় তো হোক। প্রেমও বিধাতার কাছে সত্য। প্রেম তাই পরাজিত হয় তো হোক, কিন্তু সে হার স্বীকার করে না। অবিনাশী মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সে সোচ্চার। স্বর্গ আর মর্ত্যের মধ্যে প্রভেদ এইখানেই। স্বর্গের দেবতারা অমর। মৃত্যু সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। তাই দেবতাদের অভিধানে ‘হারানো’ শব্দটা নেই। তারা সেখানে নেই বন্ধুবিচ্ছেদের যাতনা, নেই প্রিয়বিচ্ছেদের আকূল আর্তি, প্রিয় মিলনের অপরূপ আনন্দ। মর্ত্যে মৃত্যুর প্রবেশ অবারিত। এইখানে আছে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা। তাই মর্ত্যজীবন এমন মধুর। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে এই সংগ্রাম যতই ‘একপেশে’ হোক না কেন, মৃত্যু যতই নির্মম, উদাসীন আর অপ্রতিরোধ্য হোক না কেন, দুর্বল প্রেম এইখানে মহৈশ্বৰ্যে বলীয়ান। প্রেম যেমন মৃত্যুকেও জয় করেছে, দুর্বল প্রেমের কাছে মহাবীর্যবান মৃত্যুকেও তাই হার স্বীকার করতে হয়েছে। মৃত্যু আমাদের প্রিয়জনকে আমাদের চোখের অন্তরালে টেনে নিয়ে যেতে পারে সত্যি, কিন্তু আমাদের প্রেমকে বিনষ্ট করতে পারে না। প্রিয়জনকে হারানোর যে বেদনা, যে হাহাকার তা মৃত্যুর দ্বার পেরিয়ে স্বর্গলোকে বিধাতার কাছে পৌঁছতে না পারে তো না পারুক, মর্ত্যলোকের জীবনকে যে মধুময় করে রেখেছে সে বিষয়ে কবির মনে কোনো দ্বিধা নেই। প্রিয়বিচ্ছেদ আমাদের কাছে তাই হতাশার হুতাশন নয়, ট্র্যাজিডির পরশ পাথর।

এই দিক থেকে বিচার করলে আলোচ্য কবিতাটিকে মানবপ্রেমিক কবির মর্ত্যপ্রীতির একটি গভীর নিদর্শন হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading