মুঘল স্থাপত্যের ক্ষেত্রে শাহজাহানের অবদান মূল্যায়ন কর

অথবা, স্থাপত্য শিল্পের বিকাশে সম্রাট শাহজাহানের অবদান মূল্যায়ন কর

অথবা, স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সম্রাট শাহজাহানের কৃতিত্ব পর্যালোচনা কর।

মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল একটি বিশেষ যুগান্তকারী অধ্যায়। সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি, শিল্পকলার উন্নতি, উন্নত শাসনব্যবস্থা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধন-সম্পদ, অভ্যন্তরীণ শান্তি, নিরাপত্তা প্রভৃতি তার রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে পরিণত করে।

তার আমলে মুঘল শিল্প ও স্থাপত্যের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হয়।

স্থাপত্যশিল্পের বিকাশে সম্রাট শাহজাহানের অবদান বা কৃতিত্ব শিল্প ও স্থাপত্যের জন্য শাহজাহান ভারতবর্ষের ইতিহাসে অদ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছেন। নিম্নে স্থাপত্য শিল্পের বিকাশে সম্রাট শাহজাহানের কৃতিত্ব ও অবদান আলোচনা করা হলো:

১. তাজমহল: সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজমহলের স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য আত্মত্মার যমুনা নদীর কূলে তার কবরের উপর তাজমহল নামে একটি ভুবনবিখ্যাত স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন যা তার পত্নী প্রেমের নির্দশনস্বরূপ বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম হিসেবে আজো দাঁড়িয়ে আছে।

নির্মাণকাল ১৬৩২ সালে তাজমহলের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ২০,০০০ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে প্রায় ৩ কোটি মুদ্রা বায়ে ২২ বছর পর ১৬৫৩ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়।

স্থপতি তাজমহলের প্রধান স্থপতি ছিলেন ওস্তাদ ঈশা নামক একজন সুনিপুণ কারিগর। তিনি জাতিতে বাঙালি ছিলেন।

২. শাহজাহানাবাদ: সম্রাট শাহজাহান তার রাজত্বকালে রাজধানী আগ্রা থেকে নিশ্চিতে স্থানান্তর করেন। পরে স্বীয় নামানুসারে এর

নামকরণ করেন ‘শাহজাহানাবাদ’।

এরপর দিল্লিকে সুসজ্জিত করার জন্য তিনি দেশি, বিদেশি শিল্পী ও স্থপতিদের আমন্ত্রণ করেন এবং বিভিন্ন অট্টালিকা গড়ে তোলেন

৩. মতি মসজিদ: সম্রাট শাহজাহানের স্থাপত্যশিল্পের আরেকটি নিদর্শন হলো মতি মসজিদ। এটি দেওয়ানের আমের উত্তরে অবস্থিত শ্বেতপাথরে নির্মিত।

এ মসজিদের আয়তন দৈর্ঘ্য ২৪৩ মিটার এবং গ্রন্থ ১৮৭ মিটার। ১৬৪৫ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয়। ১৬৫২ সালে।

এটি নির্মাণ করতে খরচ হয় প্রায় ৩০ লক্ষ মুদ্রা। মাত মসজিদের মতো এত চমৎকার কারুকার্য পৃথিবীর অন্য কোনো মসজিদে আজো পরিলক্ষিত হয়নি।

৪. দিল্লির জামে মসজিদ: সম্রাট শাহজাহান নির্মিত অপূর্ব স্থাপত্যের মধ্যে দিল্লি জামে মসজিদ অন্যতম। এটি ভারতের বৃহত্তম মসজিদগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্তর স্থান দখল করে আছে।

এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৫০ সালে। দীর্ঘ ৫ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৬৫৬ সালে সম্রাট শাহজাহান এ ভুবনবিখ্যাত মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। এ মসজিদটি মূল্যবান পাথর দ্বারা নির্মিত হয়।

৫. দেওয়ান-ই-খাস: শাহজাহানের সময়ে লালকেল্লার ভিতরে দেওয়ান-ই-খাস নির্মাণ করা হয়। শাহজাহানের আমলের যেকোনো ইমারত অপেক্ষা এটি অধিকতর সৌন্দর্যমণ্ডিত।

দেওয়ান- ই-শ্বাস ছিল মূল্যবান, রৌপাছাদ বিশিষ্ট মর্মর হস রাজা, সুবর্ণ ও সুন্দর পাথরের অলংকারকরণ। সম্রাট এটিকে ভূ-স্বর্গ মনে করতেন।

৬. ময়ূর সিংহাসন: ময়ূর সিংহাসন সম্রাট শাহজাহানের শিল্পানুরাগের অপর একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। ঐতিহাসিকগণ একে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজকীয় সিংহাসন বলে অভিহিত করেন।

১৬৩৪ সালে শিল্পাধ্যক্ষ বেবাদিল খানের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৮ বছর অক্লান্ত সাধনায় প্রায় ৮ কোটি মুদ্রা ব্যয়ে এটি নির্মিত হয়। স্বর্ণ নির্মিত ৪টি পা এবং ১২টি মরকত মনির অগ্নের উপর এর চন্দ্রাতপ ছান বসানো হয়।

প্রত্যেকটি স্তম্ভের মাথায় মণিমানিক্যখচিত একজোড়া ময়ূর মুখোমুখি বসানো ছিল। সিংহাসনে উঠার জন্য হিরা পান্না বসানো ৩টি সিড়ি ছিল।

৭. লালকেল্লা: সম্রাট শাহজাহান রাজধানী দিল্লিতে লালকেল্লা নির্মাণ করেন। লালকেল্লার অভ্যন্তরে দেওয়ান-ই-আম ও দেওয়ান-ই- খাস এবং মমতাজমহল নামক প্রাসাদ অবস্থিত।

ঐতিহাসিকদের মতে, শাহজাহানের নির্মিত যেকোনো প্রাসাদ অপেক্ষা দেওয়ান-ই- খাস অধিক সৌন্দর্যমণ্ডিত।

এ প্রাসাদটি কারুকার্যময় অলংকারে সুশোভিত। এর প্রবেশ পথে ফারসি ভাষায় লিখা ছিল স্বর্ণ যদি ধরা মাঝে থাকে কোনোখানে তা এখানে, এখানে, এখানেতে।”

৮. শালিমার উদ্যান: ১৬৩৭ সালে শাহজাহান রাজপ্রাসাদের কেন্দ্ররূপে শালিমার উদ্যান নির্মাণ করেন। লাহোরে নির্মিত শালিমার উদ্যান আজো দর্শকদের পুলকিত করে। এ উদ্যান রাজকীয় প্রমোদ কেন্দ্র হিসেবে নির্মিত হয়।

১. শিশমহল ও জুইমহল: শিশমহল ও জুঁইমহল শাহজাহানের স্থাপত্যশিল্পের আরো ২টি অন্যতম নিদর্শন। সম্রাট শাহজাহান ১৬৩১ সালে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সুশোভিত রাজকীয় আবাসগৃহ শিশমহল ও দুইমহল নির্মাণ করেন। তিনি লাহোর অবস্থানকালে শিশমহলে অবস্থান করতেন।

১০. অন্যান্য স্থাপত্যশিল্প: উল্লেখিত শিল্পসমূহ ও সম্রাট শাহজাহান আগ্রা মসজিদ, খাসমহল, নওলাখ রঙ্গমহল, খোয়াব ঘর, গোলাপ-ই-বাগ দরওয়াজা, ঝর্ণা-ই-খাস ইত্যাদি নির্মাণ করেন।

এছাড়া নিজামউদ্দিন আউলিয়ার স্মৃতিসৌধ, কাবুল, কাশ্মীর, আজমির, আহমেদাবাদের প্রাসাদ দুর্গ, মসজিদ ও অট্টালিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১১. শিল্পকলা: মুঘল সম্রাট শাহজাহান ছিলেন গভীর শিল্পানুরাগী। তিনি হিন্দু শিল্পকলা ও ইউরোপীয় শিল্পকলার সংমিশ্রণে এক নতুন শিল্পকলার প্রচলন করেন।

তার রাজত্বকালে চিত্রকলার অনন্য নিদর্শন হলো দারাশিকোর এলবাম। তার পৃষ্ঠপোষকতায় ফকির শাহ, মীর হাসান, অনুপ প্রমুখ চিত্রকলার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেন।

১২. শিল্প ও স্থাপত্যের উৎকর্ষ সাধন সম্রাট শাহজাহানের ন্যায় সৌন্দর্য ও জাঁকজমকপূর্ণ নরপতি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। স্থাপত্যশিল্পের দিকে দিয়ে পৃথিবীর আর কোনো সম্রাটই এতো গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হননি।

তার স্থাপত্যের কীর্তি অন্যতম নিদর্শন হলো তাজমহল, মতি মসজিদ, লালকেল্লা, দিল্লির জামে মসজিদ, ময়ূর সিংহাসন ইত্যাদি।

১৩. সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন: সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিও সম্রাট শাহজাহানের আকর্ষণ ছিল প্রবল। তিনি পণ্ডিতদের খুব সমীহ করতেন এবং রাজদরবারে আহ্বান করতেন।

তার একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতার আব্দুল হামিদ লাহোরি, এনায়েত খান প্রমুখ সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মুঘল সম্রাটদের মধ্যে একমাত্র শাহজাহানের আমলেই শিল্পকলা ও স্থাপত্য শিল্পে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে।

ঐশ্বর্যশালী ও মহিমান্বিত শাহজাহানের কীর্তিগুলো তার আমলে আর্থিক প্রাচুর্যের স্বাক্ষর বহন করেন। এ কারণেই সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ সময় মুঘল সাম্রাজ্য সর্বক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হয়। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, রাজস্ব সকল ক্ষেত্রে অপরিসীম উন্নতি ঘটে।

তার আমলে কাব্য, সাহিত্য ও শিল্পের অসাধারণ প্রগতি সাধিত হয়। এছাড়া দেশে নিরবিচ্ছিন্ন | শান্তি ও সমৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading