উনিশ শতকে মহাকাব্য, পত্রকাব্যের মতো মধুসূদন বাংলা সনেটেরও জন্মদাতা। বাংলা সনেটকে এক উচ্চপর্যায়ে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। জন্মভূমি থেকে বহুদূরে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে বসে তিনি এই সনেটগুলি রচনা করেছেন। মধুসূদন দত্ত মোট ১১০টি সনেট রচনা করেন। রাজনারায়ণ বসুকে তিনি নিজেই এক চিঠিতে লিখেছেন-“I want to introduce the sonnet into our language.” পেত্রার্ক, দান্তে, শেকসপিয়র-এর অনুকরণে তিনি সনেটগুলি রচনা করেন। বাংলাদেশের ফুল, পাখি, বাংলা ভাষা, পুরাণ, বন্ধুদের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে তিনি সনেটগুলি রচনা করেছেন। ‘বলাভাষা’, ‘যশের মন্দির’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, ‘কপোতাক্ষ নদ’ ইত্যাদি সনেটে তাঁর হৃদয়চিত্তের আর্তনাদ বড়ো হয়ে উঠেছে। ‘কপোতাক্ষ নদ’ সনেটে স্বদেশ আত্মার আত্মসন্ধান বড়ো হয়ে উঠেছে। মধুসূদনের রাবণ যেমন স্বদেশ রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল, তেমনি এ সনেটে মধুকবি মনে করেছেন স্বদেশভূমির কথা। আত্মসম্মান, অনুসন্ধানই একজন কবিকে বাঁচিয়ে রাখে। সেই অনুসন্ধান মধুকবিকেও করতে হয়েছে। একজন প্রকৃত কবি কখনোই নিজের স্বদেশভূমিকে ভুলে থাকতে পারেন না। মধুসূদনও পারেননি, ফলে বিদেশে থেকেও প্রিয় নদীর কথা মনে পড়েছে-“সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।/সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;” বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বিদ্যাসাগবও নানা সময়ে মধুসুদনকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। সেই ঋণ তিনি শোধ করেছেন সনেট লিখে। মধুসুদন সেই সনেটে বিদ্যাসাগর চরিত্রের মহান গুণাবলি লিপিবদ্ধ কয়েছেন। সনেটের প্রথমেই কবি জানিয়েছেন- “বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।। কর্ণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,”। কবি উপমা দিয়েছেন, ‘দীন যে, দীনের বন্ধু’ বলে। সনেট রচনা সম্পর্কে মধুসূদনের নিজের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। বন্ধু গৌরদাস বসাককে এক পত্রে লিখেছেন-“প্রিয় গৌর, আমি সম্প্রতি ইতালির কবি পেত্রার্কের কাব্য পড়িতেছি এবং তদানুকরণে কতকগুলি চতুর্দশপদী কবিতাবলি রচনা করিয়াছি। তোমাকে চারিটি পাঠাইলাম। তুমি নকল করাইয়া যতীন্দ্র ও রাজনারায়ণকে পাঠাইবে ও তাহাদের মতামত আমাকে জানাইবে। চতুর্দশপদী কবিতা আমাদের ভাষায় চমৎকার লাগিবে, ইহা বলিতে আমার সাহস হয়।”