ব্রিটিশ ভারতে জীবনব্যাপী শিক্ষার ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা কর।

ব্রিটিশ ভারতে জীবনব্যাপী শিক্ষার ঐতিহাসিক পটভূমি

ভারতের ইতিহাসে ব্রিটিশ শাসনকাল (1757-1947) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়সীমা, যেখানে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশদের অধীনে ভারতে যে শিক্ষা ব্যবস্থাটি গড়ে ওঠে, তা পরবর্তী সময়ে জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারাকে প্রভাবিত করেছে। ব্রিটিশরা ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং নানা দিক দিয়ে আধুনিক শিক্ষা ও তার পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েছিল, যা পরবর্তীতে ভারতীয় সমাজে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে। এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণা কিভাবে বিকশিত হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করা হলো।

1. ব্রিটিশদের শিক্ষা নীতি সমাজে তার প্রভাব

ব্রিটিশরা ভারতে আসার পর প্রথমে তাদের নিজস্ব প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে একটি নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় জনগণের মধ্যে ইংরেজি ভাষা এবং পশ্চিমা শিক্ষার ধারণা প্রচলন করা, যাতে তারা শাসনকার্যে সাহায্য করতে পারে। তবে, ব্রিটিশরা কখনোই ভারতের জনগণের জন্য ব্যাপকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিল না, বরং এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয় সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা প্রদান করা হয়েছিল।

১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকলাহান এর প্রস্তাবের মাধ্যমে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং প্রাথমিকভাবে এই শিক্ষা ব্যবস্থা কেবল ইংরেজি ভাষা শেখানোর উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে উচ্চবর্ণের সমাজের কিছু অংশের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, তবে সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সীমিত।

2. লাইফলং লার্নিং কনসেপ্টের সূচনা

ব্রিটিশ ভারতে জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণা পরোক্ষভাবে বিকাশ লাভ করেছে। ব্রিটিশদের শিক্ষা নীতিতে, বিশেষ করে সেকুলার (ধর্মনিরপেক্ষ) শিক্ষার প্রসার, ভারতে শিক্ষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। তারা বিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেও, কৃষক, শ্রমিক, মহিলাদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। ফলে, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা ছিল না, যা পরবর্তী সময়ে জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণার উত্থান ঘটায়।

এছাড়া, ব্রিটিশরা কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যেমন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয় স্থাপন, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটায় এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার চাহিদা বাড়ায়। বিশেষ করে, তারা শ্রমজীবী ও গ্রামীণ জনগণের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ঘটানোর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা পরবর্তী কালে পেশাগত শিক্ষা ও জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারাকে প্রভাবিত করে।

3. মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার প্রসার

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের সমাজে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়। এই শ্রেণীটি ইংরেজি ভাষা ও পশ্চিমা শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। তারা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পেশাগত দক্ষতা অর্জন করার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে, যার মধ্যে ব্যবসায়িক, প্রশাসনিক, এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এছাড়া, গ্রামীণ ও শ্রমজীবী জনগণের জন্য ব্রিটিশরা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝায়। এই সময়ে জীবনব্যাপী শিক্ষা ধারণা ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে থাকে, যেখানে পেশাগত এবং সামাজিক দক্ষতার উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

4. মুক্তিযুদ্ধের আগে জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারার বিকাশ

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যে জাতীয় আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের পর ভারতীয় সমাজে একটি শিক্ষাগত পুনর্জাগরণ শুরু হয়, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই সময়ে বিশেষত ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিবিদরা ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সংস্কার করতে শুরু করেন, এবং পশ্চিমা শিক্ষার সাথে ভারতীয় শিক্ষার সমন্বয় করার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালান।

এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে, বেশ কিছু ভারতীয় চিন্তাবিদ যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, এবং স্বামী বিবেকানন্দ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য শিক্ষা প্রদানে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষা শুধু মাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং একজন মানুষের চরিত্র গঠনে, সামাজিক উন্নয়নে, এবং জাতীয় পরিচয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

5. পুনর্জাগরণের সময় জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণা

১৯শ শতকের শেষের দিকে ও ২০শ শতকের প্রথম দিকে জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণা নতুনভাবে বিকশিত হতে থাকে। জাতীয় নেতারা যেমন মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং অন্যান্য ভারতীয় চিন্তাবিদরা বিশেষভাবে পেশাগত ও সৃজনশীল শিক্ষা, পাশাপাশি নৈতিক এবং সামাজিক শিক্ষার গুরুত্বের প্রতি মনোযোগ দেন। তাদের দৃষ্টিতে, জীবনব্যাপী শিক্ষা শুধুমাত্র একাডেমিক বা কারিগরি শিক্ষায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং মানবিক গুণাবলি, সমাজিক দায়িত্ববোধ, এবং সৃজনশীল চিন্তার উন্নয়ন ছিল তার অন্যতম লক্ষ্য। গান্ধীজির “নিউ ভিশন” বা নতুন শিক্ষাদর্শনে জীবনব্যাপী শিক্ষা এবং নৈতিক শিক্ষা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল।

6. ব্রিটিশ ভারতের পরবর্তী প্রভাব

ব্রিটিশ শাসন শেষে, স্বাধীন ভারতের শাসকরা জীবনের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাকে আরো গুরুত্ব দিয়ে জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণাকে আরও বিকশিত করার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে, ১৯৫০-এর দশকে ভারতের সরকারের পক্ষ থেকে “জাতীয় শিক্ষা নীতি” গৃহীত হয়, যার মধ্যে জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষার সবার জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বল্পবয়সী ও প্রবীণদের জন্য শিক্ষার সুযোগ প্রদান এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।

উপসংহার

ব্রিটিশ ভারতে জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণা তার মূল ভিত্তি তৈরি করেছে, যদিও তাদের উদ্দেশ্য ছিল সীমিত। ব্রিটিশ শাসনকালে জীবনব্যাপী শিক্ষার যে প্রথম দিকের বিকাশ শুরু হয়েছিল, তা স্বাধীন ভারতে আরো বিস্তৃত হয় এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে শিক্ষা প্রদান করা একটি আদর্শ হয়ে ওঠে। ভারতীয় জনগণের মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে জীবনব্যাপী শিক্ষা আধুনিক ভারত গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading