বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলন সিটি কলেজের ছাত্রদের মনে এক উত্তেজনা তৈরী করে। সরস্বতী পূজার আগে ৩ রা ফেব্রুয়ারী ১৯২৮-এ সাইমন কমিশনের প্রতিবাদের হরতাল, বয়কট ইত্যাদি নানা ঘটনায় সিটি কলেজের হিন্দু ছেলেরা সদল বলে কলেজ ত্যাগ করলে, তাতে কলেজে যে অর্থের অভাব উপস্থিত হয় তাতে অনেকের সঙ্গে জীবনানন্দেরও কাজ যায়। ১৯১৭-১৯২৮ এই বারো বছর জীবনানন্দ নিজেকে এড়িয়ে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে থাকেন। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্যায়ের কবিতাগুলো জীবনানন্দের শহর ছাড়ার সময় থেকে রচিত। যখন জীবনানন্দের কলিকাতা বাসের আরম্ভ তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ হতে চলেছে এবং আন্তর্জাতিক পৃথিবীতে বাণিজ্য ও প্রভুত্বের সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হয়েছে। তাঁর ‘জীবনপ্রণালী’ উপন্যাসে, ‘নিরঙ্কুশ’ কবিতায় ও ‘সাতটি তারার তিমির’এ ঘটনাগুলির ছায়াপাত ঘটেছে।
জীবনানন্দের কিছু কবিতাতে শহরের নিদারুণ পরিস্থিতির কথা ছড়িয়ে আছে। নিষ্করুণ বিশাল শহরের রাজপথে ছিন্নবাস, নগ্নশির, ভিক্ষাজীবি মানুষেরা হেঁটে চলেছে। পাণ করছে হাইড্রেন্টের জল- ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যের ‘রাত্রি’ কবিতায় এই বিষয়বস্তু ফুটে উঠেছে। ‘বনলতা সেন’ কাব্যের কিছু কবিতায়ও এই ভাব রয়েছে। কলকাতার পথে পথে কবি দেখেছেন ডাস্টবিনের পাশে ঘুরে বেড়ানো ইঁদুর, বিড়াল, নেড়ি কুকুর, ক্ষুধিত মানুষের অস্পষ্ট জগৎ। কবি দেখেছেন কুষ্ঠ রোগী হাইড্রেন্ট খুলে দিয়ে গা ধুতে বসেছে। কলেজস্ট্রীটে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারের ভিতর দেখেছেন সারি সারি রূপহীনা মানবীকে। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যেও শহরের এমন টুকরো টুকরো ছবি ফুটে উঠেছে। রূপহীনা নারী সম্পর্কে কবিতায় লিখেছেন- ‘পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ / পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই আর তার প্রেমিকের ম্লান / নিঃসঙ্গ মুখের রূপ; / বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ, .”- রূপসী বাংলার যে নারীরা অতীতে ছিল রূপবতী, তারা আজ আর নেই। অঘ্রাণের ম্লান উষ্ণতায় মলিন হয়েছে সেই নারীদের রূপ।