= ‘নবান্ন’ (১৯৪৪) শুধু বিজন ভট্টাচার্যের শ্রেষ্ঠ নাটক নয়, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক। বাংলা নাটকের দিক ফিরিয়েছিল ‘নবান্ন’ নাটক। বাংলা নাটকের প্রকরণগত বৈচিত্র্য ও নাটকে সাধারণ মানুষের জয়গান ধ্বনিত হয়েছিল এ নাটককে কেন্দ্র করেই। গণনাট্য আন্দোলন বলতে আমরা যা বুঝি তারও সূত্রপাত এ নাটককে কেন্দ্র করেই হয়েছিল। নাটকটি প্রথমে ‘অরণি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ‘শ্রীরলাম রলামঞ্চ’-এ নাটকটি অভিনীত হয়। নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য প্রধান সমাদ্দার চরিত্রে অভিনয় করেন। মেদিনীপুরের আমিনপুর গ্রামের প্রেক্ষাপটে এ নাটক রচিত হয়। এ নাটক সম্পর্কে সমালোচক অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন-“ভারতীয় গণনাট্যসঙ্ঘ প্রযোজিত ‘নবান্ন’ নাটকটি গণনাট্য আন্দোলনের শুধু প্রবর্তক নহে, এই আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী নাটকরূপেও স্বীকৃত।”
‘নবান্ন’ নাটক চার অঙ্কে পনেরোটি দৃশ্যে সমাপ্ত। পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলা সেদিন ছারখার হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষ প্রবল অন্নকষ্টের সামনে পড়েছিল। সেই ক্ষুধার্ত দিনে নাট্যকার এ নাটক রচনা করেন। নাট্যকার নিজেই জানিয়েছেন-“ঘরে যেদিন অন্ন ছিল না, নিরন্নের মুখ চেয়ে সেদিন আমি নবান্ন লিখেছিলাম।” প্রধান সমাদ্দারের পরিবার খাদ্যাভাবে শহরে এসেছে। শহরে এসে লাঞ্ছিত হয়েছে। একদিকে খাদ্যাভাব, অন্যদিকে বিত্তবানদের আনন্দযাপন। দুইয়ের ব্যবধানে কৃষকশ্রেণির দুর্দশার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। তবে নাট্যকার কৃষকদের জয়ে নাটক সমাপ্ত করেছেন। কৃষ্ণ, রাধিকা, প্রধান সমাদ্দাররা ফিরে গেছে গ্রামে। নতুন করে ফসল ফলিয়েছে। শুধু বিষয়গত দিক থেকে
টেকনিকের বিচারেও ‘নবান্ন’ নাটক অভিনবত্বের দাবি রাখে। রঙ্গমঞ্চে এই প্রথম কৃষক চরিত্ররা উঠে এল। এ নাটকেই প্রথম মাইক ব্যবহার করা হয়। এমনকি সংলাপেও আঞ্চলিক সংলাপ ব্যবহার করে জনজীবনের কাছে যাওয়ার প্রচেষ্টা ছিল। এ নাটকের সংলাপ শুনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল নাট্যকার যেন ‘জাত চাষা’।
‘নবান্ন’ নাটক বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। গণনাট্য আন্দোলনের ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ নাটকের মধ্য দিয়েই। বাংলা নাটকে গণচেতনা এই প্রথম বিপুল আকারে এল। এ নাটককে কেন্দ্র করেই পরে নতুন নাট্যধারা সৃষ্টি হয়েছিল। শত্রু মিত্র এ নাটক সম্পর্কে লিখেছেন-“আমরা সবাই জানি যে ‘নবান্ন’ ইতিহাস, ‘নবান্ন’ মোড় ফেরানোর ফলক।”