দৌলত কাজির পরে আরাকান রাজসভার দ্বিতীয় উল্লেখযােগ্য কবির নাম সৈয়দ আলাওল। আলাওলের লেখা আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়, যােড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে তার জন্ম। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল মুলুক ফতেয়াবাদ-এর অন্তর্গত জালালপুর গ্রামে। অল্প বয়স থেকেই আলাওল বিদ্যাচর্চায় আগ্রহী ছিলেন। হিন্দি, সংস্কৃত, ফারসি প্রভৃতি ভাষায় তাঁর দখল ছিল। আরাকান রাজের প্রধান অমাত্য মাগন ঠাকুরের পৃষ্ঠপােষকতায় তিনি তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘পদ্মাবতী’ রচনা করেন। পরবর্তীকালে তিনি সােলেমান, সৈয়দ মহম্মদ প্রমুখের পৃষ্ঠপােষকতাও লাভ করেছিলেন। পদ্মাবতী ছাড়াও সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জমাল’, হপ্তপয়কর, তােহফা’, সেকেন্দারনামা প্রভৃতি গ্রন্থ তাঁর লেখা। তবে পদ্মাবতী ই তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা।
মালিক মহম্মদ জায়সির হিন্দি কাব্য পদুমাবৎ অবলম্বনে আনুমানিক ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে পদ্মাবতী রচিত হয়। রাজস্থানে প্রচলিত পদ্মিনী বা পদ্মাবতীর কাহিনি নিয়ে জায়সি তাঁর এই কাব্য রচনা করেছিলেন।‘পদ্মাবতী’তে ইতিহাসের কাহিনির সঙ্গে কল্পনা মিশ্রিত হয়ে এক ধরনের রােমান্টিক জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। আলাওল এই কাব্যে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পরিবেশন করেছেন মানবীয় প্রেমের কাহিনি। মধ্যযুগীয় ধর্মপ্রচারমূলক বাংলা সাহিত্যধারায় এই ধরনের মানবীয় বিষয়ের অবতারণা নিঃসন্দেহে উল্লেখযােগ্য সাহিত্যকর্ম। সেদিক থেকেও কাব্যটির বিশেষ মূল্য আছে।
কোন্ রাজসভার কোন্ কবি পদ্মাবতী রচনা করেন? এই কাব্যের বৈশিষ্ট্য কী?
আরাকান রাজসভার কবি সৈয়দ আলাওল পদ্মাবতী কাব্য রচনা করেন।
পদ্মাবতী কাব্যের বৈশিষ্ট্য: আরাকান রাজের দুই অমাত্য মাগন ঠাকুর এবং সুলেমানের অনুরােধে সুফি-কবি মালিক মহম্মদ জায়সির অবধি-হিন্দি কাব্য পদুমাবৎ অবলম্বনে আলাওল আনুমানিক ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে পদ্মাবতী কাব্য রচনা করেন। চিতােরের রানি পদ্মিনীর রূপের কথা শুনে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির চিতাের আক্রমণ, যুদ্ধে চিতােরের রানার পরাজয় ও মৃত্যু এবং পরিশেষে রানির আত্মবিসর্জন—মূল এবং অনুবাদ কাব্যদুটিরই মূল কাহিনি এটাই। রাজস্থানে প্রচলিত এই পদ্মিনী (বা পদ্মাবতী) কাহিনি নিয়ে জায়সি তাঁর কাব্যটি রচনা করলেও সুফি কবি জায়সি ইসলামি সুফি ধর্মতত্ত্ব ও রূপকের প্রয়ােগ করে তাঁর কাব্যটিকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছিলেন। পদ্মাবতী কাব্যে মূল কাহিনির সঙ্গে কল্পনা মিশ্রিত হয়ে এক রােমান্টিক জগতের সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাস এবং কিংবদন্তির প্রেক্ষাপটে আলাওল এখানে পরিবেশন করেছেন এক মানবিক প্রেমকাহিনি।
শুধু তাই নয়, এ কাব্যে তিনি সংস্কৃত কাব্যাদর্শ অনুযায়ী নায়িকার রূপবর্ণনায়, হিন্দু ও সুফিদর্শনের ভাববিন্যাসে এবং যােগ-সাধনার গূঢ়তত্ত্ব বিশ্লেষণেও বিস্ময়কর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এ কাব্যের ভাষা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল হলেও অলংকার প্রয়ােগের আতিশয্য কখনও কখনও রচনাকে আড়ষ্ট করে দিয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, মধ্যযুগের ধর্ম-প্রচারমূলক বাংলা সাহিত্যধারায় এমন মানবিক প্রেমকাহিনি সত্যই অনন্য।
অষ্টাদশ শতাব্দীর যুগবৈশিষ্ট্য উল্লেখ করাে
১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দিল্লিতে মােগল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়লে বাংলার নবাবি রাজত্বেও নানান বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে সিরাজ- উদদৌলা পর্যন্ত বাংলার নবাবদের সকলেই ছিলেন কমবেশি বিলাসব্যসনে মত্ত। তা ছাড়া, সিংহাসনকে কেন্দ্র করে নানান কুটিল ষড়যন্ত্র চলছিল। ফলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিকে মনােযােগী হওয়ার সুযােগ নবাবদের ছিল না। একদিকে নবাবি শাসনের দুর্বলতার সুযােগে দেশের ভূস্বামীদের শােষণ-পীড়ন এবং অন্যদিকে বর্গি ও জলদস্যুদের সাঁড়াশি আক্রমণ বাংলার মানুষকে এক অসহায় অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে বাংলার মানুষ এমন একজন দেবতাকে অবলম্বন করে উঠে দাঁড়াতে বা শক্তি সঞ্চয় করতে সচেষ্ট হয়েছিল, যিনি তাদের অসম্পূর্ণতাগুলি মুহূর্তে ঢেকে দিতে পারেন, জীর্ণতাকে ধ্বংস করে নতুন প্রাণের সম্ভাবনা গড়ে দিতে পারেন, আবার প্রয়ােজনে শত্রুবিনাশেও সক্ষম। উমা অর্থাৎ দুর্গা এবং শ্যামা অর্থাৎ কালী—এমনই দুই হিন্দু দেবী। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালির দুঃখ কষ্টের সাতকাহন এবং দুঃখমুক্তির সুর উমাসংগীত এবং বিশেষ করে শ্যামাসংগীতগুলিতে পরম আকুলতায় ফুটে উঠেছে। পল্লিপ্রাণ বাঙালির পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের গভীর অনুভব এই গানগুলির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এই শাক্ত সংগীতের পথিকৃৎ এবং শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন কবি রামপ্রসাদ সেন (১৭২০-১৭৮১) যিনি কবিরঞ্জন নামেও পরিচিত।
রামপ্রসাদ সেনের কবিপ্রতিভার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শাক্ত পদাবলি সাহিত্য-ধারার অন্যতম প্রতিভাধর কবি হলেন রামপ্রসাদ সেন।
রামপ্রসাদ সেনের কবিপ্রতিভা:
১৭২০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর চব্বিশ পরগনার হালিশহরের নিকটবর্তী কুমারহট্ট গ্রামে কবি রামপ্রসাদ সেনের জন্ম। রামপ্রসাদ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেন। রামপ্রসাদ ‘বিদ্যাসুন্দর’, ‘কালীকীর্তন’ ও ‘কৃষ্ণকীর্তন’ -প্রভৃতি কাহিনি-কাব্য রচনা করলেও তার যথার্থ পরিচয় শাক্ত পদরচয়িতা হিসেবেই। রামপ্রসাদের পদগুলিতে সহজসরল ভাষায় ভক্তপ্রাণের গভীর আকুতি প্রকাশিত হয়েছে। উমাসংগীত এবং শ্যামাসংগীত উভয় প্রকার গানেই তিনি সিদ্ধহস্ত। তবু তাঁর শ্যামাসংগীতগুলিই মানুষকে বেশি টানে। তাঁর ‘মা আমায় ঘুরাবে কত’ কিংবা ‘মন রে কৃষিকাজ জানাে না’ প্রভৃতি গান বাংলার পথে-ঘাটে নানাজনের মুখে শােনা যায়। ‘ভক্তের আকুতি’ পর্যায়ে মায়ের প্রতি কবির অনুযোগ আবদার মা ও ছেলের চিরন্তন সম্পর্কের সুন্দর প্রকাশ। কবি তাঁর পদে কবিচিত্তের যে জীবন যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তা সমকালীন মানুষের মর্মবাণী। তন্ত্রের গৃঢ় তত্ত্বকথা এ গানগুলিতে থাকলেও তা কখনােই গানগুলিকে দুর্বোধ্য ও নীরস করেনি। তাই, রামপ্রসাদের গানের সুরের আবেদন গৃহস্থের মনেও সাড়া জাগায়। শান্ত পদাবলির শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদের ‘রামপ্রসাদি সংগীত’ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।