বাংলা ভাষা উদ্ভবের একটি রূপরেখা প্রস্তুত করো।অথবাবৈদিক থেকে বাংলা পর্যন্ত ভারতীয় আর্যভাষার ধারাবাহিক বিবরণ

‘সংস্কৃত ভাষা বাঙলা ভাষার জননী’- বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বাঙলা ভাষার উৎপত্তি-বিষয়ে গবেষণা-ভিত্তিক সিদ্ধান্তের পূর্বে এটিই ছিল প্রায় সর্বজনস্বীকৃত মতবাদ। বাঙলা ভাষায় ব্যবহৃত তথা তৎসম শব্দের আধিক্য এবং খাঁটি বাঙলা তথা তদ্ভব শব্দগুলির সঙ্গে সংস্কৃত শব্দের নিকট সম্বন্ধহেতু বিবেচনা করা হতাে যে ‘সংস্কৃত ভাষাই বাঙলা ভাষার জননী’। ভাষাতাত্ত্বিক অনুশীলনে সংস্কৃতের সঙ্গে বাঙলা ভাষার একটা অতিশয় ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্বীকৃত হলেও সরাসরি সংস্কৃত থেকেই যে বাঙলা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে, এমন কথা মেনে নেওয়া চলে না। তবে ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্য’ তথা সংস্কৃত ভাষাই যে ক্রমবিবর্তিত হায়ে ‘মধ্যভারতীয় আর্য’ তথা প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে কালক্রমে বিবিধ নব্যভারতীয় আর্যভাষায় তথা বাঙলা, হিন্দী প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষায় পরিণত হয়েছে, এই বিজ্ঞানসম্মত অভিমতটিই সর্বজনমান্যতা লাভ করেছে। ভাষাবিজ্ঞানের বিচারে বলা চলে যে সংস্কৃত তথা প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা প্রাকৃতের তথা মধ্যভারতীয় আর্যভাষার অন্ততঃ তিনটি স্তরের মধ্য দিয়ে ক্রমবিবর্তিত হতে হতে আনুমানিক খ্রীঃ দশম শতকের দিকে বাঙলা এবং অপরাপর আঞ্চলিক নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় রূপান্তরিত হয়। কাজেই ‘বাঙলা ভাষার জননী’ বলতে মধ্যভারতীয় আর্যভাষা বা ‘প্রাকৃ ভাষা’কেই বুঝিয়ে থাকে, কারণ এই ভাষা থেকেই সরাসরি বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বৈদিক স্তর থেকে কীভাবে কোন স্তরের মধ্য দিয়ে ক্রম-পরিবর্তন-সূত্রে বাঙলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে, নিম্নে তার বিস্তুত বিবরণ সংক্ষিপ্তাকারে প্রদত্ত হলাে।

আনুঃ খ্রীঃ পূঃ পঞ্চদশ শতকের দিকে আর্য-ভাষাভাষী জনগােষ্ঠীর ভারত আগমন শুরু হয়। এই আর্যভাষাভাষী জনগােষ্ঠী তথা ভারতে আগত আর্যগণ যে ভাষায় কথা বলতেন, তাকে ভাষাবিজ্ঞানীরা ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা’ (Old Indo-Aryan, O.I.A.) নামে অভিহিত করে থাকেন। এই ভাষারই একটা শিষ্টজনসম্মত সাহিত্যিক রূপ আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ‘বৈদিক সাহিত্যে’।  সপ্তসিন্ধুর কূলেই প্রথম আর্য-উপনিবেশ গড়ে উঠলেও কালক্রমে আর্যরা গঙ্গা-যমুনার দুই কুল ধরে অগ্রসর হয়ে আনুঃ খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের দিকে গােটা মধ্যভারত পর্যন্ত অধিকার করে ক্রমশই পূর্বদিকেই সরে আসছিলেন। এই দীর্ঘকাল তাঁরা বিভিন্ন অনার্য জাতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার ফলে তাঁদের ভাষায় দেখা দিয়েছিল বিরাট পরিবর্তন। তখন তারা এই ভাষার সংস্কার সাধন করেন-ফলতঃ সংস্কারকৃত এই ভাষার নাম হয় ‘সংস্কৃত’। এই ভাষায় বিভিন্ন লােকায়ত সাহিত্য রচিত হয়েছিল তাই এটিকে সাধারণভাবে ‘লৌকিক সংস্কৃত’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।

অতএব প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার দুটি মার্জিত সাহিত্যিক রূপের নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে একটি ‘বৈদিক সংস্কৃত’, অপরটি ‘লৌকিক সংস্কৃত’। অতিশয় শিথিলভাবে দুটিকেই আমরা সাধারণতঃ ‘সংস্কৃত’ নামেই অভিহিত করে থাকি। অনুমান করা হয়, সেকালে এ দুটির বাইরে আরাে একটি ভাষা লােকসাহিত্য রচনার কাজে ব্যবহৃত হতাে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার ইতস্ততঃ-বিক্ষিপ্ত দু’চারটি শব্দ পাওয়া গেলেও ঐ ভাষায় লিখিত কোন সাহিত্য একাল পর্যন্ত এসে পৌছয় নি। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার এই তিনটি রূপের অতিরিক্ত যে আরাে একাধিক আঞ্চলিক কথ্যরূপ ছিল, তা কিন্তু অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে লােকের মুখে মুখে ক্রমবিবর্তিত হতে হতে মধ্যভারতীয় আর্যভাষায় বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপে রূপান্তরিত হচ্ছিল।

ভাষা নদীস্রোতের মতই চিরপ্রবহমাণা। এর গতিপথে যেমন ভিন্ন ভাষার স্রোত এসে এর সঙ্গে উপনদীর মতাে মিশ্রিত হয় তেমনি ভিন্নতর শাখারূপেও এর অনেক শ্রোতােধারারও সৃষ্টি হয়ে থাকে। কখন বা নদীতে বাঁধ বেঁধে তার কিছু জলকে হ্রদের মতাে আবদ্ধ করে রাখা হয়, কিন্তু কোন বিপর্যয় না ঘটলে নদীর মূল ধারা শুধু এগিয়েই চলেএর গতিপথ সরল না হতে পারে, কোথাও বাঁক ফিরতে পারে, অঞ্চল বিশেষে এই শ্রোতােধারা ভিন্ন নামেও পরিচিত হতে পারে, কিন্তু মূল নদীটি অখণ্ডপ্রবাহে বয়ে চলতে থাকে— যেখানে সে বাঁক ফিরেছে সেখানে ভিন্ন নামে পরিচিত হলেও ধারাটি কিন্তু অবিচ্ছিন্ন। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা তাই অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষায় যখন রূপান্তরিত হলাে, কালের বিচারে সে সময়টা আনুঃ খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক, নামের বিচারে তাকে বলা হয় ‘প্রাকৃত’। এই মধ্য ভারতীয় আর্যভাষাও সুদীর্ঘকালে বিবর্তিত হতে হতে প্রায় দেড় হাজার বৎসর পর বাঙলা আদি নব্য ভারতীয় ভাষায় পরিণতি লাভ করে।

খ্রীঃ পূঃ পঞ্চদশ শতক থেকে খ্ত্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকএই সহস্রাব্দকাল বিস্তৃত প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা কালে প্রাকৃত তথা মধ্যভারতীয় আর্যভাষায় রূপান্তরিত হবার পর তার স্থিতিকাল ছিল আরাে দেড় হাজার বছর। এই সুদীর্ঘকালের ব্যবধানে ভাষাদেহে অনেক নতুন লক্ষণ প্রকটিত হওয়াতে ‘প্রাকৃত’ তথা ‘মধ্যভারতীয় আর্যভাষা’ (Middle Indo- Aryan, M.I.A.) অন্ততঃ তিনটি স্তরে বিবর্তিত হয়েছিল, বলা যেতে পারে। খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত ‘আদিস্তর’, খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রীষ্টোত্তর দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত ‘ক্রান্তিকাল’, খ্রীঃ দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রীঃ ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত ‘মধ্যস্তর’ এবং খ্রীঃ ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রীঃ দশম শতক পর্যন্ত ‘অন্ত্যস্তর’।

প্রাকৃতের আদিস্তরের ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় ‘পালিভাষা’য় রচিত বৌদ্ধদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও কাহিনীতে এবং অশােকেরও সমসাময়িক কালে রচিত বিভিন্ন শিলালিপিতে। অশােকের সমকালেই যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতের বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তৎকালীন শিলালিপিগুলির ভাষা-বিচারে। উত্তরপ্রদেশের যােগীমারা গুহায় শুতনুকা (সুতনুকা) নামে যে শিলালিপিটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার ভাষাকে বলা হয়েছে ‘পূর্বীপ্রাচ্যাপ্রাকৃত’। এই ‘সুতনুকা লিপি’র ‘প্রাচ্যা প্রাকৃত’ থেকেই ক্রম-বিবর্তনে বাঙলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে—এরূপ অনুমান করা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য শিলালিপিতে অন্যান্য অঞ্চলের ভাষারূপ বিধৃত হয়েছে। তাদের ‘উদীচ্যা-প্রাকৃত’, ‘প্রাচ্যা-প্রাকৃত’ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়।

আদিস্তরের প্রাকৃতের বিবর্তিত রূপের পরিচয় পাই মধ্যস্তরের প্রাকৃত। মধ্যস্তরের প্রাকৃতের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন নাটকে এবং প্রাকৃত কাব্য-মহাকাব্যে। সংস্কৃত নাটকের মহিলা চরিত্রের এবং অশিক্ষিত পুরুষ চরিত্রের মুখে বিভিন্ন প্রাকৃত ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণভাবে মধ্যস্তরের এই প্রাকৃত ভাষাকে বলা হয় ‘সাহিত্যিক প্রাকৃত’। নাটকে ব্যবহৃত প্রাকৃতগুলির মধ্যে রয়েছে নারী মুখের ভাষায় ‘শৌরসেন প্রাকৃত’, গীতের ভাষায় ব্যবহৃত ‘মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃত’ এবং অশিক্ষিত পুরুষের মুখে ‘মাগধী প্রাকৃত’। মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে স্বাধীনভাবে কাব্য-মহাকাব্যটি রচিত হলেও অপর দুটি প্রাকৃতে রচিত কোন সাহিত্য পাওয়া যায় না। জৈনধর্মাবলম্বীগণ ‘অর্ধমাগধী’ প্রাকৃতে তাদের বহু শাস্ত্রগ্রন্থাদি রচনা করে গেছেন। ‘পৈশাচী’ প্রাকৃতে গুণাঢ্য ‘বড্ডাকহা’ (বৃহৎকথা) নামে এক অতি বৃহৎ কাহিনী সংকলন রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়-কিন্তু গ্রন্থটি পাওয়া যায়নি। এই মধ্যস্তরের প্রাকৃতই আবার ক্রমবিবর্তিত হয়ে অন্ত্যভরে পরিণত হয়েছে। এই মধ্যস্তরের মাগধী প্রাকৃত আদি স্তরের পূর্বীপ্রাচ্যার প্রত্যক্ষ বংশধর: এই ভাষা থেকে অথবা সমকালের বৈয়াকরণ-কথিত ‘গৌড়ী প্রাকৃত’ থেকে ক্রমবিবর্তনে বাঙলা ভাষার উদ্ভব।

অন্ত্যক্তরের প্রাকৃতের সাধারণ প্রচলিত নাম ‘অপভ্রংশ’ এবং ‘অপভ্রংশে’র অর্বাচীন বূপকে বলা হয় অবহটঠ (অপভ্রষ্ট)। তাত্ত্বিক দিক থেকে প্রতিটি প্রাকৃতেরই অপভ্রষ্ট বুপ স্বীকার করা হয় বলে ‘শৌরসেনী অপভ্রংশ’ ও ‘মাগধী অপভ্রংশে’র কথা বলা হয়, কিন্তু কার্যতঃ শৌরসেনী ছাড়া অপর কোন অপভ্রংশ বা অবহট্ঠ ভাষার নিদর্শন বাস্তবে পাওয়া যায় না। শৌরসেনী অবহটুঠ একসময় সমগ্র উত্তর ভারতে শিষ্টজনসম্মত সাহিত্যের ভাষারুপে প্রচলিত ছিল। এই অবহটুঠ ভাষা থেকেই আনুঃ খ্রীঃ দশম শতকের দিকে নব্য ভারতীয় আর্যভাষাসমূহের উদ্ভব ঘটে। অপর একটি অনুমান, বৈয়াকরণগণ বলেন, ঐ সময় ‘দেশী’ নামে একটি জানপদ ভাষা ছিল, সম্ভবত, এটি ‘গৌড়ী অপভ্রংশ’ অথবা অর্বাচীন গৌড়ী প্রাকৃত—যা থেকে সরাসরি বাঙলা ভাষার উদ্ভব ঘটা সম্ভব। আচার্য সুকুমার সেন বলেন, নব্য ভারতীয় আর্যের উদ্ভবের সময় ভাষাগুলির মধ্যে যে সাধারণ লক্ষণ ছিল সেইগুলির প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া এই সময়ের ভাষাগুচ্ছকে একটি বিশিষ্ট ভাষার সন্তান বলিয়া গণ্য করিতে হয়, ভাষাতত্ত্বের দিক দিয়া আলােচনার সুবিধার জন্য এই কাল্পনিক ধাত্রী ভাষাটিকে বলা হইল প্রত্ন নব্য ভারতীয় আর্য (Proto-New Indo-Aryan)অপভ্রষ্টের দ্বিতীয় বা শেষ স্তর হইল এই প্রত্ন নব্য ভারতীয়।”

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার কথ্য রূপটি খ্রীঃ পূর্ব শতাব্দীতে যে সকল আঞ্চলিক প্রাকৃতে পরিণতি লাভ করে তাদের মধ্যে ছিল ‘শুতনুকা লিপি’তে প্রাপ্ত ‘পূর্বীপ্রাচ্যা’। লক্ষণ-বিচারে দেখা যায় এই পূর্বীপ্রাচ্যাই পরবর্তী পর্যায়ে ‘মাগধী-প্রাকৃত’ নামে সাহিত্যিক প্রাকৃতে এবং গৌড়ী প্রাকৃতে রূপ লাভ করে। অনুমিত হয়, এই মাগধী বা গৌড়ী প্রাকৃতই কালক্রমে বা গৌড়ী অপভ্রংশ ‘মাগধী অপভ্রংশ’ ও তা থেকে ‘মাগধী অবহট্টে’ পরিণত হয়। মাগধী বা গৌড়ী অবহট্ঠ যে ‘প্রত্ন নব্য ভারতীয় আর্যভাষা’য় রূপান্তরিত হয়, সেটিই মালবে প্রাপ্ত শিলালিপির ‘গৌড়ী’ ভাষা। এটি থেকেই পূর্ব ভারতীয় বাঙলা, অসমীয়া, ওড়িয়া এবং মৈথিলি, মগহী, ভােজপুরিয়া-আদি বিহারী ভাষাগুলির উদ্ভব ঘটে অতএব ধারাবাহিকতার বিচারে আমরা বাঙলা ভাষায় কুলপরিচয় নির্ণয় করতে পারি নিম্নোক্ত ক্রমে। বৈদিক যুগের কথ্যভাষা পরবর্তী স্তরে ‘শুতনুকা লিপি’তে প্রাপ্ত ‘পূর্বী-প্রাচ্যার’ মধ্য দিয়ে মাগধীও গৌড়ী প্রাকৃত, মাগধী বা গৌড় অপভ্রংশ ও মাগধী বা গৌড়ী অবহটঠের স্তর পার হয়ে প্রত্ন নব্য ভারতীয় গৌড়ীভাষা থেকে প্রাচীন বাঙলা ভাষার উদ্ভব ঘটে।

বাঙলা ভাষাও হাজার বৎসরে অনেকখানি পরিবর্তিত হওয়ায় ভাষায় পরিবর্তন অনুযায়ী তাকে আদিযুগ, আদিমধ্যযুগ, অন্ত্যমধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ এই চারটি পর্বে বিভক্ত করা হয়। প্রতি পর্বেই ভাষাগত পরিবর্তন লক্ষণীয়।

বাঙলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’- আনুমানিক খ্রীঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত হয়। এই কালটিকে বলা হয় বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ‘আদিযুগ’। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সদ্য-উদ্ভূত বাঙলা তাঁদের সাধন-ভজন-বিষয়ক তদ্বাদি এই গ্রন্থে বিভিন্ন পদের আকারে রচনা করেছিলেন। চর্যাপদ ধর্মীয় সাহিত্য। খ্রীঃ ত্রয়ােদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর অর্ধাংশ পর্যন্ত ছিল ক্রান্তিকাল। একালে রচিত কোন রচনার নিদর্শন সুলভ নয়। এরপর ১৩৫০ খ্রীঃ থেকে ১৪০০ খ্রীঃ পর্যন্ত বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যযুগ। এর মধ্যে আবার ১৫০০ খ্রীঃ পর্যন্ত আদিমধ্যযুগ বা চৈতন্য-পূর্ব যুগ। এই যুগের উল্লেখযােগ্য সাহিত্য বড়ু চণ্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদাবলী কিছু অনুবাদ সাহিত্য এবং কয়টি প্রধান মনসামঙ্গল কাব্য। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাঙলার সাহিত্যে ও সমাজে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে। ফলে, বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের গুণগত এবং পরিমাণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল অনেকখানি। অন্ত্যমধ্যযুগে তথা চৈতন্যোত্তর যুগে জীবনী সাহিত্য, পদাবলী সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য, বিভিন্ন ধারার মঙ্গলকাব্য ও নানাজাতীয় লােক সাহিত্যের সৃষ্টি হয় (১৮০০ খ্রীঃ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে গদ্য-সাহিত্যের উদ্ভব এবং তার পরই পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাঙলা সাহিত্যে যে বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়, তাকেই বলা হয় ‘আধুনিক যুগ’। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের যুগ বিভক্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ভাষাও যুগােপযােগীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।

আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বৈদিক যুগের কথ্যভাষা কীভাবে ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক বাঙলায় উপনীত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার দুটি পদ অবলম্বন করে তার সুন্দর দৃষ্টান্ত নির্মাণ করেছেন।

বৈদিক যুগ থেকে এক অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে ভাষাস্রোত একাল পর্যন্ত চলে এসেছে মাঝে মাঝে রূপান্তর লাভের সঙ্গে সঙ্গে নামেরও পরিবর্তন ঘটেছে।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading