বাংলা গদ্যে সাহিত্যের বিকাশে অক্ষয় কুমার দত্তের সার্থকতা বিচার করুন।

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে অক্ষয় কুমার দত্তের অবদান

অক্ষয় কুমার দত্ত বিদ্যাসাগরের মতোই বাংলা গদ্যে ও বাঙালির চিন্তার ক্ষেত্রে তার পরিছন্নতা ও শক্তির সঞ্চার করে দিয়েছেন। সাহিত্য জগতে তার আবির্ভাব কবি হিসেবে কিন্তু গদ্য রচনার সূত্রপাত হয় সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার মধ্য দিয়ে। বুদ্ধিদীপ্ততার পৌরুষ তার গদ্যে জ্বলজ্বল করছে। তার রচনার মধ্যে এক যুক্তিবাদী বিজ্ঞাননিষ্ঠ মনই কার্যকরী হয়েছে। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থই রচনা করেছেন তাই বাংলা সাহিত্যে তাকে বিজ্ঞান গ্রন্থ রচনা অগ্রণী পথিক বলা যায়। তুলনামূলকভাবে অক্ষয় কুমারের গদ্য ভাষা মিশনারি পণ্ডিতদের তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ

অক্ষয়কুমারের গদ্যরচনা :

‘ভূগোল’ (১৮৪১), ‘পদার্থবিদ্যা’ (১৮৫৬), ধর্মনীতি (১৮৫৬), ‘চারুপাঠ’-তিন খণ্ড’ (১৮৫৩, ১৮৫৪, ১৮৫৯), বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার-[প্রথম ভাগ (১৮৫১), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৩)], ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ [প্রথম ভাগ (১৮৭০), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৮৩)]
—অক্ষয়কুমার দত্তের রচিত গ্রন্থাবলী মূলত বুদ্ধি নির্ভর এবং মননাশ্রয়ী।
তিনি যেহেতু তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার শিক্ষক, নর্মাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, সেজন্য স্কুলপাঠ্য শ্রেণির পুস্তক রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন।


তাঁর ‘ভূগোল’ গ্রন্থটি তত্ত্ববোধিনী সভার আনুকূল্যে প্রকাশিত এবং তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার জন্য পাঠ্যগ্রন্থ হিসাবে রচিত এই গ্রন্থ রচনার সঙ্গে অক্ষয়কুমারের বিপুল জ্ঞানস্পৃহা, তথ্যানুসন্ধান ও বৈচিত্রানুসন্ধানী মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
ক) ‘পদার্থবিদ্যা’ গ্রন্থে বিজ্ঞানবিষয়ক তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন লেখক। বিজ্ঞানের গূঢ় বস্তু জ্ঞান ও তাত্ত্বিক জ্ঞানকে নতুনভাবে পরিবেশন করে, পরিভাষার প্রণালীবদ্ধ প্রকরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে গ্রন্থটিকে সজ্জিত করেছেন। বিজ্ঞানের বস্তুতন্মাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করেছেন। বিজ্ঞানের অনুসরণে প্রাকৃতিক নিয়মের অনুবর্তনকেই অক্ষয়কুমার যথার্থ ধর্ম বলে মনে করেছিলেন। অক্ষয়কুমারের ধর্মানুভবের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক মননের স্বরূপ ছিল উল্লেখ্য।
খ) ‘ধর্মনীতি’ গ্রন্থটি রচনায় জর্জ কুম্বেরের Moral Philosophy নামক গ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে কুম্বেরের বস্তুতন্ময় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ এবং মধ্যযুগীয় বিশ্বাসকে তিনি একইসঙ্গে গ্রহণ করেননি। প্রাকৃতিক বিধান- ই যে ভগবত ভক্তির ভিত্তি—তা তিনি এই গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন।


গ) ‘চারুপাঠ’ গ্রন্থের তিন খণ্ডে স্বপ্নদর্শন বিষয়ক প্রবন্ধ এবং স্বদেশানুরাগ প্রকাশের উপযোগী কিছু প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ গ্রন্থটি জর্জ কুম্বের-এর “The Constitution of Man Considered in Relation to eternal objects’ অবলম্বনে রচিত। প্রকৃতির সঙ্গে বাহ্যজগতের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ নিয়ে জর্জ কুম্বেরের বক্তব্য অক্ষয়কুমার যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছেন। তাই গ্রন্থটিতে লেখকের মৌলিকতা যথেষ্ট। কেননা তিনি তাঁর রচনায় মূল গ্রন্থ বহির্ভূত বহু উদাহরণ ও নির্দেশ দিয়েছেন, যা এদেশীয় জনগণের পক্ষে স্বাভাবিক ও কল্যাণকর। গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে মদ্যপানের অবৈধতা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তাছাড়া ধর্ম ও সামাজিক নিয়ম পালনের ফল, নানা প্রাকৃতিক নিয়মের সমবেত কার্য, ব্যক্তির পক্ষে তার ফলাফল প্রভৃতি আলোচনা করেছেন।


ঘ) ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ অক্ষয়কুমারের শ্রেষ্ঠ গদ্যরচনা। উইলসনের ‘Essays and lectures on the Religion of the Hindus’ অবলম্বনে রচিত হলেও লেখক এতে অনেক নতুন বিষয় যোগ করেছেন। এটি বাঙালির গবেষণামূলক সাহিত্যের এক প্রধান নিদর্শন। এই গ্রন্থে লেখকের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, সত্যনিষ্ঠা, বিচারভঙ্গি, অসামান্য শাস্ত্রজ্ঞান এবং গভীর স্বদেশপ্রেম ও স্বজাত্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের দুটি উপক্রমণিকা মৌলিক প্রবন্ধের পরিচয় বহন করে। এতে আপেক্ষিক শব্দবিদ্যা, প্রাচীন হিন্দুদের মধ্যে বৈদিক ধর্মের প্রচলন, বৈদিক ধর্মের পর হিন্দু সম্প্রদায়ে পৌরাণিক ও তান্ত্রিক ধর্মের প্রসার, বিভিন্ন ধর্মের উপাসনা প্রণালী স্থান পেয়েছে।

অক্ষয়কুমারের গদ্যের বৈশিষ্ট্য :

১) ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা গদ্যকে দিয়েছিলেন মাধুর্য ও শিল্পসুষমা, অক্ষয় কুমার দত্ত দিলেন যুক্তি বিচার সমৃদ্ধ ভারবহনের ক্ষমতা—যে দুর্লভ শক্তিবলে বাংলা গদ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাহন হতে পারে সহজে। সে ভাষা কেবল ঋজু নয়, মসৃণ এবং সাবলীলও। (ভূদেব চৌধুরী)
২) তথ্যনিষ্ঠ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন ও প্রচার তিনিই প্রথম বাংলায় আরম্ভ করেন। তাঁর যুক্তিবাদে ও আলোচনায় দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ ব্রাহ্মধর্মকে অনেকটা যুক্তিবাদী করে তোলে। তাই তার গদ্যও যুক্তিধর্মী।
৩) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন, “তিনিই বাঙালীর সর্বপ্রথম নীতি শিক্ষক”। শুধু বিষয়মাহাত্ম্য, গবেষণা প্রয়াস ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ছাড়াও অক্ষয়কুমার এদিক থেকেও স্মরণীয়।
৪) বাংলা গদ্যে বহুবিধ কঠিন তথ্যের ও ভাবের প্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন দক্ষ লেখক রূপেই। প্রকৃতপক্ষে গদ্যের যা প্রথম উপযোগিতা তা হচ্ছে সাধারণ কাজ চালানো। “গদ্য হচ্ছে age of reason-এর স্বভাষা। সেই” কাজের কথায় গদ্য” ও যুক্তির আশ্রয় গদ্যভাষায় রচনার প্রথম চেষ্টা করেন অক্ষয়কুমার”। (গোপাল হালদার)
৫) অনেকে তার গদ্যে সরসতার অভাব লক্ষ করেছেন, সত্যই তার গদ্যের ভাষা বিশুদ্ধ যুক্তিবাদের ভাষা, তবে বাংলা গদ্যে তিনি যে সৃজনী শক্তির দিকটি প্রকাশ করেছেন তার মূল্য কম নয়। অক্ষয়কুমার দত্তের গদ্যভাষা সেরূপ সরস নয়, সাহিত্যগুণের অভাবও দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর ভাষা শুষ্ক নিষ্প্রাণ হয়ে উঠেছে। তবুও আমরা বলতে পারি, অক্ষয়কুমারের ভাষা রূপে সমৃদ্ধ, বিষয়ে গভীর। তাঁর ভাষায় অকারণ আবেগ আতিশয্য ছিল না— তা ছিল মননশীল যুক্তিনিষ্ঠ। তাঁর ভাষায় বিজ্ঞানকথা দার্শনিকতার যথাযথ প্রকাশ ঘটেছে। ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন বলেছেন তার লেখা ছিল “প্রকাশক্ষম, নিরাভরণ, ব্যবহার উপযোগী এবং প্রসাদ গুণ বিশিষ্ট।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading