বাংলা গদ্য সাহিত্যে শ্রীরামপুর মিশনের ভূমিকা ও গুরুত্ব লেখো।

শ্রীরামপুর মিশনের ভূমিকা:

বাংলা গদ্যের চর্চার ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান অনেকখানি। প্রধানত বঙ্গদেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্যই কলকাতার নিকটবর্তী হুগলির শ্রীরামপুরে এই মিশন প্রতিষ্ঠা করেন ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান মিশনারীরা। ইংরেজ শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনের কাজকর্মে এবং জীবিকার প্রয়ােজনে শিক্ষার গুরুত্ব দ্রুতবেগে বাড়তে থাকে। ইংরেজরা শাসনকার্য পরিচালনার জন্য গদ্য চর্চা করতে থাকেন। বিশেষ প্রয়ােজনবােধকে সামনে রেখে মিশনারীরা লেখ্য গদ্যভাষা গড়ে তােলার যে প্রত্যক্ষ প্রয়াসে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন তাতে বাংলা গদ্যের উদ্ভব পর্ব স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

শ্রীরামপুর মিশন

শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠার পর ও তাঁর সহযােগীরা দেশীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন একদিকে রামায়ণ ও মহাভারত ছেপে প্রকাশ করলে ও অন্যদিকে দেশীয় ভাষায় বাইবেল লিখে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করলে তারা হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হবে। তাই শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাংলা সহ প্রায় কুড়িটি ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেছিলেন মিশনারীরা। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হযেছিল। তবুও বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিশেষত গদ্য ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসে এঁদের এবং এই মিশনের দান স্বীকার করতেই হয়। শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড এই তিনজনের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে।

তাই শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাংলা সহ প্রায় কুড়িটি ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেছিলেন মিশনারীরা। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়েছিল। তবুও বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিশেষত গদ্য ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসে এদের এবং এই মিশনের দান স্বীকার করতেই হয়। শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড এই তিনজনের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে বাংলা গদ্যচর্চার জন্য।

শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ :-

 (ক) পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ: শ্রীরামপুর মিশন বাংলা গদ্যে প্রথম পাঠ্যপুস্তক ব্যাকরণ, রামায়ণ ও মহাভারত মুদ্রণ করে প্রকাশ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য কেরীর সংস্কৃত ব্যাকরণ, বোপদেবের মুগ্ধবােধ, কোলব্রুকের সম্পাদনায় অমরকোষ প্রভৃতি। এছাড়া কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত প্রকাশ করে মিশনারীরা বাংলা ও বাঙালির উপকার করেছিলেন। 

(খ) বাইবেলের অনুবাদ ও প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ: মূলত উইলিয়াম কেরীর চেষ্টায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কাজ শুরু হওয়ার আগেই শ্রীরামপুর মিশন থেকে ‘মঙ্গল সমাচার মতিউর’ রচিত Gospel of St. Mathews (1800, ৭ই ফেব্রুয়ারী মূল গ্রীক থেকে অনূদিত হয়। তারপর ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ বাইবেল ‘ধর্মপুস্তক’ প্রকাশিত হয়। এছাড়া খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধীয় বহু পুস্তক প্রণীত ও প্রচারিত হয়। এসব কাজে মিশনারীদের সাহায্য করেন রামরাম বসু। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই প্রায় আশিটি পুস্তক রচিত হয় ও সাত লক্ষ কপি বিতরিত হয়।

(গ) ইতিহাস-সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান মূলক রচনার প্রকাশ: উইলিয়াম কেরীর যােগ্যতম সহকর্মী ছিলেন জশুয়া মার্শম্যান।

(গ) ইতিহাস-সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান মূলক রচনার প্রকাশ: উইলিয়াম কেরীর যােগ্যতম সহকর্মী ছিলেন জশুয়া মার্শম্যান। সংস্কৃত রামায়ণের ইংরেজি অনুবাদে তিনি কেরীকে সাহায্য করেন। মার্শম্যান ইংরেজি ও বাংলা দু ভাষাতেই রচনা করেন ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ দুখণ্ড (১৮৩১), ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৮৪৪) ইত্যাদি। এছাড়া শ্রীরামপুর প্রেস স্কুল বুক সােসাইটি থেকে মুদ্রিত হয় লসন, পিয়ার্স, ওয়েঙ্গার, কিন্তু, বাটন প্রমুখদের রচনা।

গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য: 

শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত অনুবাদের ক্ষেত্রে গদ্যের এমন কোন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় না। তবুও বাংলা গদ্যের উদ্ভবের ক্ষেত্রে এই ধরনের অনুবাদ পরবর্তী পর্যায়ের ভিত্তিভূমি হিসাবে সূচিত হয়েছে। কেরী মূলত আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন। সেজন্য বাইবেলের অনুবাদের ভাষা দুর্বোধ্য ও অমসৃণ। অনুবাদের মধ্যে রয়েছে ইংরেজি ভাষার অন্বয়রীতির প্রভাব। এমনকি অন্বয়রীতিও যথার্থ নয়। অতিরিক্ত সংস্কৃত তৎসম শব্দের প্রাধান্য গদ্যের দুর্বোধ্যতাকে বাড়িয়ে দিযেছে।

শ্রীরামপুর মিশনের গুরুত্ব: 

আদর্শ গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য শ্রীরামপুর মিশন প্রকাশ করতে না পারলেও শ্রীরামপুর মিশনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। যেমন — 

(ক) শ্রীরামপুর মিশনের প্রতিষ্ঠা মূলত ধর্মপ্রচারের জন্য এবং সেই উদ্দেশ্যেই তারা গদ্য রচনা করেছিলেন। তাই খ্রিস্টানদের প্রসঙ্গকে দেশবাসীদের বােধগম্য ও উপভােগ্য করে তােলার তাগিদে তাঁরা গদ্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। ফলে তাঁদের অন্তরের কৌতূহল ভাষার মৌল প্রবণতার অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছিল। তাঁদের এই চেষ্টাই পরবর্তী বাংলা গদ্যের মুক্তির সম্ভাবনাকে গতিদান করেছিল। 

(খ) পুরাতন বাংলা কাব্য, মূল সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ, রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ, বিভিন্ন পত্র পত্রিকা প্রকাশের ফলে এবং ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হওয়ার ফলে তা দেশীয় মানুষদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।

(গ) মুদ্রাযন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আধুনিক যুগের বাঙালি জীবন ও সংস্কৃত প্রভাবিত হতে পেরেছে। 

(ঘ) বাঙালির মধ্যে পরােক্ষ আত্মসচেতনতা বৃদ্ধির সুযােগ করে দেবার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব যথেষ্ট।

(ঙ) এখন থেকে কেবল বাংলার প্রথম সাময়িক পত্র প্রকাশিত হয়নি, সেগুলাে সমাচার পত্রিকা বা সংবাদপত্রের আদর্শ প্রায় হয়ে ওঠে যা বাংলা গদ্য ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে এবং হয়ে উঠেছে সমাজের যথার্থ দর্পণ। এভাবেই বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশন ইতিহাসে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

গােপাল হালদার শ্রীরামপুরের মিশনের গুরুত্ব সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, “সত্যই যদি বাইবেল স্বচ্ছন্দ বাংলায় অনূদিত হত তাহলে বাংলা লেখকের ভাব-জগতের মধ্যে হত যীশুর উক্ত কথা বা গল্প ও ধারণা এমন বেমানান ঠেকত না। কারণ, আরবদের আরব্য রজনী’র মত যিহুদীদের ওল্ড টেস্টামেন্টও পৃথিবীর একখানা মহৎ গ্রন্থ, আর যীশুর কাহিনী সবল, সরল ও অপূর্ব ভাব-সম্পদ। সে রস খাঁটি বাংলায় পরিবেশিত হলে সাহিত্য হত।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading