বাংলা কাব্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান আলোচনা করো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা কাব্যে নতুন সুর শুনিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল প্রথম বিদ্রোহের চেতনা নিয়ে বাংলা কাব্যসংসারে প্রবেশ করেন। ইংরেজ শোষণের বিরুদ্ধে তিনি সচেতনভাবে বক্তব্যধর্মী, প্রতিবাদের বাণী সঞ্চার করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে যে রবীন্দ্রবলয় গড়ে উঠেছিল, সেখান থেকে নজরুলই প্রথম বেরিয়ে এসেছিলেন। বাংলা কাব্যসংসারে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রবেশ করেন নজরুল ইসলাম। প্রথম থেকেই তিনি কাব্যে এক বক্তব্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার পিছনে ছিল ইংরেজের অত্যাচার ও শোষণ।

নজরুলের কাব্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২), ‘দোলন চাঁপা’ (১৯২৩), ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪), ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪), ‘ছায়ানট’ (১৯২৫), ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫), ‘সর্বহারা’ (১৯২৬) ও ‘ফণি-মনসা’ (১৯২৭)। নজরুল প্রথম থেকেই প্রতিবাদ-চেতনা সঞ্চার করেছেন। ‘ধূমকেতু’ ও ‘লাঙল’ পত্রিকায় ব্রিটিশ সরকারের শোষণ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন। কবিতা লেখার জন্য কারাবাস হয়েছে, কিন্তু কারাগারে বসেও লিখেছেন অবরুদ্ধ কারাগার ভেঙে ফেলার গান। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কারও কারও কাছে মনে হয়েছে ‘দুষ্ট খোকার বিদ্রোহ’। তবে এ কবিতা ব্রিটিশ সরকারের অবস্থানকে স্পষ্ট করে দিয়েছিল, এমনকি ব্রিটিশ সরকারের শোষণ, অত্যাচারে সাধারণ মানুষ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। ক্রমাগত ‘আমি’ শব্দ ব্যবহার করে প্রতিবাদকে এক উচ্চসুরে নিয়ে গেছেন-

“আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,

মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস।

আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,

আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার।”

নজরুল মিলনের কবি। মানবতার কবি। হিন্দু-মুসলিমের সাম্প্রদায়িক বিভেদ ঘুচিয়ে দিয়ে মহান মানবতার সন্ধানকারী কবি। এই মানবতার সন্ধানে তাঁকে পুরাণের জগতে যেমন প্রবেশ করতে হয়েছে, তেমনি ধর্মীয় মৌলবাদীদের গাল দিতে হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মৌলবীরা সাধারণ মানুষকে নিজেদের নির্দিষ্ট বলয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল। ইংরেজ জেনেছিল, হিন্দু-মুসলিমের যদি বিভেদ তৈরি করে দেওয়া যায় তবে এদেশে দীর্ঘদিন শাসনকাজ চালানো সম্ভব হবে। কিন্তু কবিতায় সেই বিভেদ ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছেন নজরুল। ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতায় হিন্দু-মুসলিমের বিভেদ ঘুচিয়ে মিলনের ডাক দেন-

“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ, কান্ডারী। আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ। হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কান্ডারী। বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।”

দারিদ্র্যের লাঞ্ছনা তিনি সহ্য করেছেন। তবুও স্বপ্ন দেখেছেন। মানুষের মুক্তির স্বপ্নে ভেসে গেছেন। তাই মনে হয়েছিল-“হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান।” নজরুল যেমন প্রতিবাদের কবি, তেমনি প্রেমেরও কবি। নজরুলের কবিতার বড়ো আবেদন সাম্যবাদ। এক সাম্যবাদী মনন নিয়ে তিনি বাংলা কাব্যসংসারে এসেছিলেন। এ পৃথিবীতে সবার অধিকার সমান। এ পৃথিবী গঠনে নারী-পুরুষ প্রত্যেকে সমান ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পুরুষ নিজের কায়েমি অধিকারে বেশি দখল করেছে। তেমনি এ সভ্যতা গঠনে শ্রমিক, কৃষকদের অবদানও সমান। নজরুলের ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’ কাব্যে এই চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে। নজরুলের তীব্র প্রতিবাদ ও ব্যঙ্গ মানসিকতা অনেকেই পছন্দ করেনি সেদিন। এমনকি বন্ধুরাও দূরে চলে গিয়েছিল। চোখের সামনে মুখোশধারী বন্ধুবৃত্ত গড়ে উঠেছিল। তাই গভীর বেদনায় ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় লিখেছেন-

“বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড়ো বিব-জ্বালা এই বুকে,

দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।

রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা, তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা।”

নজরুলের কাব্যজীবন ক্ষণিক। ক্ষণিক জীবনেই তিনি বৃহৎ চেতনার জয়গান গেয়ে গেছেন। দেশ স্বাধীন হবার আগেই তিনি বাশক্তি হারিয়ে ফেলেন। দেশ স্বাধীন হল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। তাই পরবর্তীতে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন-“ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নি তো নজরুল।” মানবপ্রীতি ও স্বদেশচেতনা নিয়ে তিনি কলম ধরেছিলেন। ফলে তাঁর কবিতায় কাব্যিকতা অপেক্ষা বক্তব্য ধর্মে উজ্জ্বল। এক শাণিতময় ভাষা ও তীব্র ব্যঙ্গবাণে তিনি পরাধীনতার যন্ত্রণা তুলে ধরেছেন। বাংলা কাব্যে এক উজ্জ্বল নাম নজরুল ইসলাম। যিনি রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালেই ভিন্ন সুর শুনিয়েছিলেন।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading