বাংলা কাব্য সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান
কাজী নজরুল ইসলাম :- জ্যৈষ্ঠের খরশান তেজ আর রৌদ্রদীপ্তি নিয়ে যিনি বাংলা কাব্য সাহিত্যে আবির্ভূত হলেন তিনি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্র-প্রভাবিত বাংলা সাহিত্যে অগ্নিহোত্রী কবি নজরুল প্রলয় মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে এক প্রবল অগ্নিদহনে অন্যায় দুর্নীতিকে বিদুরিত করতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলা সাহিত্যে নজরুল বিদ্রোহী কবিরূপে বিশিষ্ট হয়ে আছে তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রবল প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ও সামাজিক অন্যায়পাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাচরণের জন্য সমগ্র ভাবনাতেই ছিল অনির্বাণ বিদ্রোহের অগ্নিজ্বালা। নজরুলের বিদ্রোহী স্বরূপ প্রকৃতপক্ষে, তাঁর প্রেম-ব্যথিত লাঞ্ছনা-পীড়িত মনের ভাবনার জমাট বাঁধা প্রতিবাদ।
নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিপ্লবের বিদ্রোহের শিল্পবাণী ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে। নজরুলের অন্যান্য বিশিষ্ট কাব্যগ্রন্থ হল— ‘দোলনচাঁপা’ (১৯২৩), ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত), ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪- সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত), ‘ছায়ানট’ (১৯২৫), ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫), ‘সর্বহারা’ (১৯২৬), ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭), ‘সিন্ধু হিল্লোল’ (১৯২৭), ‘সঞ্চিতা’ (১৯২৮), ‘চক্রবাক’ (১৯২৯), ‘প্রলয় শিখা’ (১৯৩০-সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত) ইত্যাদি।
কবি হিসাবে নজরুলের বৈশিষ্ট্যগুলি স্মরণ করা যাক-
১.নজরুল বিদ্রোহী কবি।
২. মানবতাবাদী শিল্পী।
৩. সাম্যবাদের প্রবক্তা।
৪. প্রেম চেতনা ।
৫. সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহান রূপকার।
– এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি নজরুল কাব্যে ধরা পড়েছে। নজরুলের রচিত কিছু উল্লেখযোগ্য কাব্য কবিতা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
অগ্নিবীণা (১৯২২) : নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ হল অগ্নিবীণা। কাব্যগ্রন্থটি তিনি বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে উৎসর্গ করেন। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই কাব্যের কবিতাগুলো আগুনের গোলার মতো ছুটে বেরিয়ে এসেছিল। সেদিন অনেক বিপ্লবীরই সঙ্গী ছিল এই কাব্য। জনজাগরণের গান হিসাবেও এই কাব্যের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি ঘোষণা করেছেন- “আমি চিরবিদ্রোহী বীর আমি বিশ্ব ছাড়িয়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির।”
‘দোলন চাঁপা’ (১৯২৩) : ‘দোলনচাপা’ কাব্যগ্রন্থ নজরুলের আবেগ তথা অতৃপ্ত প্রেমের হাহাকারকে যেমন একদিকে প্রাধান্য দিয়েছে, তেমনি ব্যক্তি প্রসঙ্গের প্রাধান্য এই কাব্যগ্রন্থকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। আর এরই ফলে প্রেম বিষয়ক সংশয় কবিকে বেপরোয়া করে কল্পনার গভীরতা বা উপলব্ধির সীমানাকে সংকুচিত করেছে। অর্থাৎ
কবির প্রেম এখানে বাস্তব জীবনের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নিজেকে মুক্ত করতে প্রয়াসী, কবির প্রেমভাবনা মূলত মানবিক ভাবনা-প্রসূত এবং সৌন্দর্য প্রয়াসের আকাঙ্ক্ষায় নিয়োজিত।
বিষের বাঁশি (১৯২৪) ও ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪) : এই কাব্যদুটির বিষয়বস্তুতে প্রাধান্য লাভ করেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তেজনা। হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয় এবং মানবতার জয়গাথা এই কাব্যদুটির বিষয় হয়েছে। ‘সাম্যবাদী (১৯২৫) এই কাব্যে কবি বঞ্চিত সর্বহারা শ্রেণির প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। সমাজের অদ্ভুত সম্প্রদায়ের প্রতি কবির গভীর মমতা কবিকে করেছে সমাজ- সচেতক। ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় বলেছেন—
“আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ”
সর্বহারা (১৯২৬) : নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের দুঃখ ও দারিদ্রের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে ‘সর্বহারা’ কাব্যে। তিনি ধর্ম, বর্ণ, ধনী-দরিদ্রের বিভেদ ঘুচিয়ে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। মানুষের মানবাধিকারের অপমান কবি সহ্য করতে পারেন নি। ‘সর্বহারা’ কবিতায় বলেছেন—
“হীরা মানিক চাসনিক’ তুই,
চাসনি ও সাত ক্রোর,
একটি ক্ষুদ্রমৃৎপাত্র
তার অভাব তোর,”
ফণিমনসা (১৯২৭) : ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে নজরুল বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন, পীড়িত অসহায় মানুষের ভাষা, চোখের জলই তাঁর কবিতা লেখার প্রেরণা। অপমান নিয়ে বেঁচে থাকা যে মৃত্যুর সামিল, একদা ‘ফণিমনসা’ কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় বারে বারে বলেছেন, এই কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো হল ‘সব্যসাচী’, ‘দ্বীপান্তরের বন্দিনী’ ‘সত্যকবি’, “পথের দিশা,’ ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ ইত্যাদি।
‘সিন্ধু-হিন্দোল’ (১৯২৭) : প্রেম হল এই কাব্যের মূল সুর, এই কাব্যের প্রেম নজরুলের জীবন বন্দনার নবরূপায়ণ। নজরুলের চিন্তায় নারী হল প্রেরণার উৎস। নারীর স্পর্শে জগৎরাঙা হয়ে ওঠে-
“বিবাহের রঙে রাঙা আজসব,
রাঙা মন রাঙা আভরণ,
বল নারী—“এই রক্ত-আলোকে, আজ মম নব জাগরণ”
বাংলা কাব্য সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান :
বাংলা কাব্যসাহিত্যে নজরুলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান গুলি হল-
(১) আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় জানিয়েছেন, ‘কবিরা সাধারণত কোমল ও ভীরু, কিন্তু নজরুল তা নন। কারাগারে শৃঙ্খল পরে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন তা বাঙালির প্রাণে এক নূতন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে।
(২) বাংলা কাব্যসাহিত্যে বিদ্রোহী কবিরূপে তিনি পরিচিত হয়ে আছেন।
(৩) মানবতার কল্যাণের জন্য তিনি কাব্য রচনা করেছেন।
(৪) প্রেমের কবিতা রচনাতেও তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
(৫) তিনি হিন্দু মুসলমানের মিলনগীতি রচনা করেছেন, তাঁর কাব্যে হিন্দু পুরাণ এবং ইসলাম ধর্মের ইতিহাস ও সংস্কৃতি যুগপৎ বিরাজ করেছে।
(৬) তাঁর কবিতা অনেকসময়ই মানুষকে প্রতিবাদের ভাষা জুগিয়েছে।
(৭) তিনি বলেছেন, ‘আমি সাম্যের গান গাই। আমার চোখেতে পুরুষ নারীতে কোনো ভেদাভেদ নাই।
(৮) তাঁর বিদ্রোহাত্মক কবিতাগুলো যুবমানসকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর ‘বিষের বাঁশী’, ‘অগ্নিবীণা’, ‘সর্বহারা’ কাব্য ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল।
(৯) নজরুলের কবিতার আঙ্গিক যেমন সহজ ও বলিষ্ঠ, তেমনি তার কাব্যের ভাষা বেগবান, শানিত নিশ্চিত ও অব্যর্থ। এছাড়া তার কাব্যে গ্রাম্য শব্দ ও প্রচলিত শব্দ সমূহ কে নতুন অর্থে সমৃদ্ধ করে প্রকাশ করেছেন।
(১০) ছন্দের ক্ষেত্রেও নজরুলের কৃতিত্ব প্রশংসনীয় কলাবৃত্ত, দল বৃত্ত, মিশ্র কলা বৃত্ত সব রীতিকেই তিনি অনুসরণ করেছেন। এবং অলংকারের কারুকার্যতা ও চিত্রকল্পের অভিনবত্ব তার কাব্য রূপসজ্জায় দেখা যায়।