সংবাদ প্রভাকর থেকে ‘বঙ্গদর্শন’ পর্যন্ত বাংলা পত্রিকার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
1818 খ্রিস্টাব্দে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের পরবর্তী পর্যায়ে সম্বাদ প্রভাকর বাংলা পত্রিকার জগতে এক বিপ্লব নিয়ে আসেন। সঙ্গম প্রভাকর প্রথম প্রকাশিত হয় ২৮শে জানুয়ারি, ১৮৩১ সালে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায়। এটি প্রথমে একটি সাপ্তাহিক হিসাবে, পরে একটি ত্রি-সাপ্তাহিক (Bartroyk) এবং তারপর একটি দৈনিক (1839) হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক পত্রিকা। 1843 সালে, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পিতামহ অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় তত্ত্ববেধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হয়, তত্ত্ববেধিনী সভার মুখপত্র হিসাবে। তারপর 1851 খ্রিস্টাব্দে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের বিবিধ সংকলন প্রকাশিত হয়। ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সচিত্র মাসিক পত্রিকা। জার্নালটি জ্ঞানতত্ত্ব এবং প্রত্নতত্ত্বের আলোচনায় একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। এ ছাড়া আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা হল ‘বিদ্যাসাহিনী পত্রিকা (1855), দ্বারকাভূষণ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘সম্প্রকাশ’ এবং প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ সিকদারের যৌথভাবে প্রকাশিত ‘মাসিক পত্রিকা’ (1854)।
সুতরাং, বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশের প্রবণতা, এর সর্বোচ্চ উৎকর্ষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (1872) দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের গদ্যের মান নির্ধারণে ‘বঙ্গদর্শন’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সম্বাদ প্রভাকর পত্রিকার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও গুরুত্ব:
সম্বাদ প্রভাকরের ভূমিকা: সম্বাদ প্রভাকর পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ২৮শে জানুয়ারি, ১৮৩১ সালে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায়। এই পত্রিকার প্রকাশ বাংলা পত্র-পত্রিকার জগতে এক বিপ্লব এনে দেয়। প্রথমে এই সংবাদপত্রটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল, তারপর সপ্তাহে তিন দিন অর্থাৎ দ্বি-বিচার এবং তারপর দৈনিক সংবাদপত্র হিসাবে (1839) প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদ প্রভাকর বাংলা ভাষার প্রথম দৈনিক পত্রিকা। 1853 খ্রিস্টাব্দ থেকে সঙ্গম প্রভাকরের মাসিক সংস্করণও প্রকাশিত হয়।
সম্বাদ প্রভাকরের গুরুত্ব:
- এই পত্রিকার পাতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রাচীন বাংলার হারিয়ে যাওয়া কবিতাকে চিহ্নিত করেছিলেন। কবি ও পাঁচালীকারদের জীবনী ও রচনা সংকলন করে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ প্রকাশ করা গুপ্ত কবিরের এক অনন্য কীর্তি। ঈশ্বর গুপ্ত সর্বপ্রথম ভারতচন্দ্রের জীবনী বিস্তারিতভাবে এই পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করেন।
- সম্বাদ প্রভাকরকে ব্যবহার করে ঈশ্বর গুপ্ত দেশবাসীর মধ্যে দেশপ্রেম ও দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন।
- এই পত্রিকার ভিত্তিতে সম্পাদক নিজেই রিপোর্টারজ ধর্মাই অর্থাৎ সাংবাদিকের স্টাইলে লিখতে শুরু করেন।
- কবি রঙ্গলাল ব্যানার্জী, বঙ্কিমচন্দ্র চ্যাটার্জি এবং দীনবন্ধু মিত্র এই পত্রিকার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।
- এই পত্রিকার সাহায্যে ঈশ্বর গুপ্ত বাঙালি নাগরিক জীবনে জাতীয় চেতনা ও জাতীয়তাবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে সফল হন।
- এর ভাষাও ছিল খুব সাবলীল এবং দ্রুত।
সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে বাংলায় সাংবাদিকতা শৈলীর বিকাশ ঘটেছিল সম্বাদ প্রভাকরের পাতায়।
‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও গুরুত্ব:
‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার পরিচিতি: ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রকাশ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। এই পত্রিকা প্রকাশের ফলে বাংলা পত্রিকার জগতে এক নতুন ধারার সূচনা হয়। 1872 খ্রিস্টাব্দে (1279 বঙ্গাব্দের 1 বৈশাখ) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় মাসিক ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা প্রকাশের পিছনে বঙ্কিমের উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষকে সমকালীন শিক্ষিত মনের সাথে যুক্ত করা। বঙ্কিমচন্দ্রের কিছু উপন্যাস ও বই যেমন ‘লেখরাহস্য’, ‘বিজ্ঞান রহস্য’, কমলাকান্তের দপ্তর ইত্যাদি বঙ্গদর্শনের বিভিন্ন সংখ্যায় পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়েছিল।
বঙ্গদর্শন পত্রিকার নিয়মিত লেখকদের মধ্যে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, বীরেশ্বর পদে প্রমুখ। চতুর্থ পর্ব, 1902-1907 (1309-1312 বাংলা খ্রিস্টাব্দ) এই চার বছরে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গদর্শনও সম্পাদনা করেন।
‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার গুরুত্ব:
সমাজ ও জীবনের প্রতি মানুষের প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা।
সাহিত্য সমালোচনার উপযুক্ত ভাষা ও আদর্শ তৈরি করা।
দেশবাসীকে পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদের চিন্তাধারায় সমসাময়িকতা আনা।
- এই ম্যাগাজিনে শুধু সৃজনশীল কাজই প্রকাশিত হয়নি, ইতিহাস-দর্শন-অর্থনীতি-সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কিত বিভিন্ন আলোচনা এবং জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন রচনাও প্রকাশিত হয়েছে।
- পরকেশ বঙ্গদর্শন পত্রিকা বাংলাদেশের জনগণকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল কারণ এই পত্রিকায় দেশের কৃষক সম্প্রদায়ের দুর্দশা অত্যন্ত যুক্তিযুক্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
- বঙ্কিমচন্দ্র এই পত্রিকায় ব্যক্তিগত প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন।