আধুনিক কবিতার ইতিহাসে যে সব কবিদের অবস্থান তাঁদের মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করে আছেন দুই সময়ের দুই কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ও শঙ্খ ঘোষ। রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতায় আধুনিক কবিতার জটিলতা নেই। তিনি ছিলেন মানুষের কবি। সমাজের নীচুতলায় যে মানুষ পড়ে থাকেন, সেই মানুষদের নিয়ে তিনি কাব্য রচনা করেছেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া, খেটে খাওয়া অসহায় মানুষদের কথা বারবার তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে। তিনিই প্রথম নির্দ্বিধায় ঘোষণা করেছিলেন-সাধারণ মানুষের কবি তিনি।
প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছিলেন- “লোকে সোনার চামচ-রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোর কথা বলে, আমি তো ‘প্লাটিনাম টাং’ নিয়ে জন্মেছিলাম।” অনেক সমালোচক মনে করেন তিনিই প্রথম বাংলা কবিতায় সাধারণ মানুষদের মর্যাদাকে ঘোষণার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমরা প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘কবি’ কবিতাটি পাঠ করবো। কবিতাটি যখন লেখা হয়েছে তখন নিম্নশ্রেণীর মানুষরা ছিলেন সমাজের প্রান্তবর্তী। সাহিত্যে তাঁদের জায়গা দেওয়ার কথা অধিকাংশ মানুষেরই ভাবনায় আসত না। সেখানে চাষা- কামার-কাঁসারি-ছুতোর-মুটে-মজুর-প্রভৃতি ‘ইতরের’ ব্যথায় সমব্যথী হয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র একটি আস্ত কবিতা লিখে ফেলেছেন। স্রোতের বিপরীতে হেঁটে তিনি পাঠকদের তাক লাগিয়ে দেন। সাময়িক পত্রে কবিতাটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নতুন দিগন্তের যুগন্তকারী কবি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।
অন্নদাশঙ্কর রায় প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পর্কে বলেছিলেন- ‘Premendra is a broken hearted dreamer, still hoping for the best from revolution.’ প্রেমেন্দ্র মিত্রের চেতনায় বেশ কয়েকটি ঘটনার প্রভাব ফেলেছিল- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়বহতা, সারা বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, সোভিয়েত রাশিয়ার জন্ম, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যা, মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন, রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগ। জীবনের যন্ত্রণা- বঞ্চনাকে সঙ্গী করে তিনি কলম ধরেছিলেন। তাঁর একটি অভিযাত্রিক স্বপ্নদেখা মনও বারবার কবিতায় উঠে এসেছে
কিন্তু অবহেলিত, নিপীড়িত, শোষিত, মার খাওয়া মানুষ (যাদের তিনি ভাঙা জাহাজ বলেছেন একটি কবিতায়) তাঁর কাব্যে হাত ধরাধরি করে উঠে এসেছে। আমাদের পাঠ্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিখ্যাত ‘কবি’ কবিতাটি।