উনিশ শতক ছিল পরাধীন ভারতবর্ষের অত্যাচারিত দিন। ইংরেজ সরকারের অত্যাচার ও ভারতবাসীর স্বদেশচেতনার জাগরণেই গিরিশচন্দ্র ঘোষ ঐতিহাসিক নাটকগুলি লিখেছিলেন। অতীত ইতিহাসের গৌরবগাথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বাঙালির চেতনা বৃদ্ধি করাতে চেয়েছিলেন। তেমনি হিন্দু-মুসলিমের সম্প্রীতির ঐক্যমূলকে দৃঢ় বন্ধনে বেঁধে দিলেন। তাই ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটকে শুনতে পাই-“বঙ্গের সন্তান হিন্দু মুসলমান/ বাঙ্গালার সার্বিক কল্যাণ।” বীর শিবাজির আদর্শ, অশোকের স্বদেশ ত্যাগ ও অহিংসার মন্ত্রের উচ্চারণ শুনিয়ে বাঙালিকে স্বদেশচেতনার দীক্ষা দিয়ে যান।
গিরিশচন্দ্রের সর্বাধিক খ্যাতি সামাজিক নাটক রচনায়। তাঁর ‘প্রফুল্ল’ উনিশ শতকের অন্যতম সামাজিক নাটক। যোগেশের সাজানো সাংসার কীভাবে ভেঙে গেল, একান্নবর্তী
পরিবার কীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তা দর্শকদের নাট্যরস পিপাসা মিটিয়েছিল। যোগেশের কণ্ঠে, “আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল” করুণ রসে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। তবে নাটকের নামকরণে সামান্য অসংগতি চোখে পড়ে। পণপ্রথার ভয়ংকর ফল নিয়ে লিখেছেন ‘বলিদান’ নাটক। পণ দিতে না-পেরে একটি পরিবারের কর্তা কীভাবে আত্মবিসর্জন দিলেন, এমনকি কর্তা করুণাময়ের কণ্ঠে যখন শুনতে পাই- “বাঙ্গালার কন্যা সম্প্রদান নয়-বলিদান”-তা আমাদের আঘাত করে।
ইংরেজ নাট্যকার শেকসপিয়রকে গুরুপদে বরণ করে নাট্যক্ষেত্রে এসেছিলেন গিরিশচন্দ্র। শুধু নাটক রচনা নয়, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের রঙ্গমঞ্চে একচ্ছত্র অধিনায়ক ছিলেন তিনি। বাংলার নাট্যমোদী দর্শকদের প্রয়োজনে তাঁকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল ‘গৈরিশ ছন্দ’। বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও নাট্যশিল্পের কথা লিখতে গেলে গিরিশচন্দ্রকে বাদ দিয়ে কিছুই সম্ভব নয়। তাই সমালোচক অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন-“গিরিশচন্দ্র অনেক নাটক লিখিয়াছেন বটে এবং তিনি একজন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তাহাও সত্য, কিন্তু ইহা অপেক্ষাও বড়ো কথা বোধ হয় এই যে, তিনি রঙ্গমঞ্চের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক ও পরিচালক। তাঁহার পূর্বে রঙ্গালয়ের নিতান্ত শৈশব অবস্থা এবং তাঁহার পরেও আবার ইহার অকাল বার্ধক্যের সূচনা দেখা গিয়াছে। রঙ্গালয়ের গৌরবময় যৌবন কেবল গিরিশচন্দ্রের সময়েই প্রকট হইয়া উঠিয়াছিল।”