‘পুঁইমাচা’ গল্পটি নামকরণের সার্থকতা –
কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতিপ্রেমিক ও নির্জন প্রান্তবাসী, এ কথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে। প্রকৃতির সহিত মানব মনের যে একটি অন্তর্গুঢ় সম্পর্ক আছে, বিভূতিভূষণের সকল রচনায় তা বিশেষভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতির স্নেহ ছায়ায় মানুষ সব-দুঃখ, সব-বেদনা ভুলে অপার আনন্দ লাভ করতে পারে, এই ছিল বিভূতিভূষণের জীবন বেদ। সেই হেতু তাঁর সকল রচনায় প্রকৃতিপ্রেমচেতনা মুখ্য হয়ে উঠেছে — প্রকৃতির মধ্যে মানুষ তার জীবনের সত্যবোধ খুজে পেয়েছে। প্রকৃতির মনোরম পরিবেশ থেকে ছিন্ন হয়ে একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের কন্যা ক্ষেন্তি কিভাবে অকাল মৃত্যুবরণ করল, তারই মর্মন্তুদ কাহিনী ‘পুঁইমাচা’ গল্পে পরিবেশিত হয়েছে। ছোট সুখ, ছোট আশা নিয়ে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে কিভাবে অভিন্ন হয়ে প্রতীকী রূপ লাভ করে, ‘পুঁইমাচা’ গল্পে তা সবিশেষ পরিলক্ষিত হয়।
‘পুঁইমাচা’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। গল্পটি গ্রাম বাংলার একটি দরিদ্র পরিবারকে কেন্দ্র করে দানা বেঁধে উঠেছে। গল্পটি সংক্ষেপে এইরূপ:
অন্নপূর্ণা-সহায়হরির তিন কন্যা ক্ষেন্তি, পুঁটি ও রাধি। ক্ষেন্তি নিম্নবিত্ত বাঙালি বাড়ির মেয়ে। তার বিয়ের বয়স হয়েছে—বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে কিন্তু পাত্রের চরিত্র খুবই নিন্দনীয় জেনে বাবা সহায়হরি এ বিয়ে ভেঙে দেন। পল্লীর অন্যতম মাতব্বর কালীময় ঠাকুর সহায়হরিকে এক ঘরে করার পরিকল্পনা করেন। ক্ষেন্তি পুইচ চচ্চড়ি খেতে ভালোবাসে—-বাড়ির সবাই সেকথা জানে। কিন্তু ক্ষেন্তির হাতে পাকা পুঁইশাক দেখে মা অন্নপূর্ণা মেয়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মায়ের কঠিন কথায় ক্ষেন্তির হাত থেকে পাকা পুঁইডাঁটা গুলো পড়ে যায়। অথচ পুঁইশাকের প্রতি বড়মেয়ে ক্ষেন্তির দুর্বলতার কথা সকলের থেকে বেশি জানে মা অন্নপূর্ণা। তাই মা অন্নপূর্ণা পুঁইডাঁটার চচ্চড়ি রেঁধে দুপুরে ভাতের সঙ্গে খেতে দিয়ে ক্ষেন্তিকে অবাক করে দেন। আর ক্ষেন্তি অপার আনন্দে অথচ ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পাতের চচ্চড়ি একেবারে নিঃশেষ করে ফেলে।
এই গল্পে আমরা দেখি, শান্ত, নম্র হলেও ক্ষেন্তি কিন্তু ভোজনপ্রিয় ছিল। ভালো-মন্দ সবরকম খাদ্যের প্রতি ছিল তার অফুরন্ত লোভ। তাই, সবদিক ভেবেচিন্তে বড় মেয়ে ক্ষেন্তি স্থির করল যে, সে তরকারির বাগান বানাবে—চুরির অপরাধ সে নেবে না। ছোট বোনকে নিয়ে ভাঙ্গা পাঁচিলের ধারে জমিটায় গজিয়ে ওঠা জঙ্গল পরিষ্কার করে সে তরকারির বাগান তৈরি করার ব্যবস্থা করে। মা অন্নপূর্ণাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সে বাগান দেখায়। মাও খুব খুশি হয়। গোবর কুড়িয়ে এনে ক্ষেন্তি সারের প্রয়োজন মেটায়।
কিন্তু তরকারি বলতে তখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল একটি শীর্ণকায় পুঁইগাছ—একই রকম চেহারার একটি কঞ্চির সঙ্গে জড়িয়ে দিয়ে ফাঁসির মতো করে বাঁধা। ঠিক এমন সময় ক্ষেন্তির বিয়ে হল কোলকাতার বাসিন্দা স্বচ্ছল-পরিবারের দোজবরের সঙ্গে, যার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। বৈশাখে বিয়ে—আষাঢ়েই ক্ষেন্তির বাপের বাড়ি আসার ইচ্ছা ছিল—কিন্তু সেই ইচ্ছা আর পূর্ণ হলো না। বিয়ের পনের টাকা বাকি ছিল বলে মেয়েকে আনতে গিয়েও আনতে পারল না সহায়হরি। বিয়ের পনের টাকা না দেওয়ার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে ক্ষেন্তিকে। অনেক অত্যাচার, অনেক অবহেলা পেয়ে হঠাৎ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষেন্তি মারা গেল।
কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই গল্পে নিম্নবিত্ত বাঙালির যে করুন জীবনচিত্র আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন, তা সত্যিই করুনা মণ্ডিত। সমাজে অবজ্ঞাত-অবহেলিত-অত্যাচারিত সহায়সম্বলহীন মানুষের জীবনচিত্র লেখক বিভূতিভূষণ অতি সুন্দরভাবে অঙ্কন করেছেন। এই গল্পে ক্ষেন্তি যেন পুঁইমাচারই প্রতীক হয়ে উঠেছে। পুঁইমাচা এবং ক্ষেন্তি এক ও অভিন্ন। কেননা, এই ক্ষেন্তি জীবনের সবটুকু না পেয়ে অকালে ঝরে গিয়েছে। প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে পরিপুষ্টি ক্ষেন্তি শহুরে আদব-কায়দা পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারল না। ফলে ক্ষেন্তির মনের আশা মেটে না-মনেই থেকে যায়।
এই গল্পে আমরা দেখি সেই ভোজন বিলাসী লোভী মেয়ে ক্ষেন্তি বাড়িতে নেই। কিন্তু তার কথা সকলেরই মনে পড়ে অহরহ—অথচ তার কথা কেউ উত্থাপন করে না, একবারও মুখে আনে না। হৃদয়ের মধ্যেই সকলে ক্ষান্তিকে গভীরভাবে স্থান দিয়েছে—-আর বাইরে তার কথা যেন শূন্যতায় পরিণত হয়েছে।
পৌষ সংক্রান্তি ঘুরে এল। পনের বছরের সেই মেয়েটি অর্থাৎ ক্ষেন্তি মা অন্নপূর্ণার তৈরি পিঠের জন্য বসে নেই। হঠাৎ পুঁটি বলে বসল, —-
‘দিদি বড় ভালোবাসতো…..।’
পুঁটির মুখ দিয়ে কথাটি বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন জন যেন অসাড় হয়ে গেল। কোন এক ফেলে আসা স্মৃতি জেগে উঠলো সকলের মনে। অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল সবাই। যার কথাটি হঠাৎ উঠে পড়েছে, সে যেন এখনো বেঁচে আছে ওই ভাঙা প্রাচীরের ধারে। মুখে কিছু না বললেও নিশ্চয়ই গোপনে প্রতিদিন সেদিকে সকলে চেয়ে দেখে। ক্ষেন্তির স্মৃতি মনের মধ্যে জেগে ওঠায় সেই মুহূর্তে ক্ষেন্তির স্মৃতি ঘেরা স্থানটির দিকে তিনজনের দৃষ্টি একসঙ্গে আবদ্ধ হলো। সবাই দেখলো, —-
‘সেখানে বাড়ির সেই লোভী মেয়েটির লোভের স্মৃতি পাতায় পাতায় শিরায় শিরায় জড়াইয়া তাহার কত সাধের নিজের হাতে পোঁতা পুঁই গাছটি মাচা জুড়িয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে …. বর্ষার জল ও কার্তিক মাসের শিশির লইয়া কচি কচি সবুজ পাতা গুলি মাচাতে সব ধরে নাই, মাচা হইতে বাহির হইয়া দুলিতেছে …. সুপুষ্ট, নধর, প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর।’
যে লোভী মেয়েটি বাড়ির সকলের হৃদয় জুড়ে ছিল, যার কথা বাইরে প্রকাশ করতে পারছিল না কেউ, অথচ এড়াবার কোন উপায় নেই—ভাঙ্গা প্রাচীরের ধারে সমস্ত মাচাটি জুড়ে তারই অধিষ্ঠান।
পুঁই গাছ সমস্ত মাচা জুড়ে রয়েছে—যেন ঐ মেয়েটির মতো (ক্ষেন্তি) ডাগর-ডাগর শান্ত ভয় চকিত দৃষ্টি মেলে সকলের হৃদয় জুড়ে আছে। কচি ডগা গুলো মাটি ছাড়িয়ে দুলছে। হৃদয় ছাপিয়ে সরুচাকলির মধ্যে, বিশেষ করে প্রাচীরের ওই পুঁইমাচায় তারই তো (ক্ষেন্তি) হাতছানি দেখা যায়। পুঁই চচ্চড়ির প্রতি মেয়েটির যে লোভ, তারই বহি:প্রকাশ ঐ পুঁইমাচা। ক্ষেন্তি এবং পুঁইমাচা এই গল্পে এক ও ভিন্ন হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণের অসাধারণ রচনা দক্ষতায় এই পুঁইমাচাটি ‘প্রধান চরিত্র’ হয়ে উঠেছে। তাই এই গল্পটির নামকরণ হয়েছে ‘পুঁইমাচা’। এবং আমরা মনে করি এ গল্পের নামকরণ ‘পুঁইমাচা’ সার্থক ও সুসংগত।
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণ এই গল্পে প্রকৃতির সহিত মানুষকে অভিন্ন হৃদয় করে দিতে পেরেছেন। তিনি মনে করেন, মানুষ পরম শান্তি পেতে পারে একমাত্র প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি বিভূতিভূষণের কাছে স্নেহময়ী, মমতাময়ী জননী। কেবল প্রকৃতি মানুষের সব-দুঃখ, সব-বেদনা নিমিষে মুছে দিতে পারে। এই প্রকৃতির সহিত ক্ষেতির মিল খুঁজে পেয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি অনুভব করেছেন—-Innocence এর মূল্য দেওয়ার মতো মানুষ সংসারে খুব বেশি নেই। তাই এই গল্পে ক্ষেন্তিকে বৈষয়িক জগৎ থেকে অকালে চলে যেতে হল। কিন্তু লেখক বিভূতিভূষণ এই গল্পে দেখিয়েছেন, ক্ষেন্তির জীবনের ছোট আশা–আকাঙ্ক্ষার স্বাক্ষর সে রেখে গিয়েছে তারই রোপিত পুঁইমাচায়। তাই গল্পটির নামকরণ ‘পুঁইমাচা’ সুসংহত ও সার্থকতামণ্ডিত। এবং সেইসঙ্গে প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণের প্রকৃতিপ্রেম চেতনার স্বরূপটিও এই গল্পে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।