নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেটি বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের নালন্দা জেলার নালন্দা গ্রামে অবস্থিত। এটি ৪০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কার্যকর ছিল এবং বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, দার্শনিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব অত্যন্ত গভীর এবং এর অবদান বিশাল।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও ইতিহাস:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গোপাল নামে এক রাজা দ্বারা, যদিও এর প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে, ইতিহাসবিদরা একমত যে, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল কুমারগুপ্ত প্রথমের শাসনকালে, প্রায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল এক বিশ্ববিদ্যালয় শহর, যেখানে হাজার হাজার ছাত্র এবং শিক্ষক অংশ নিতেন বিভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষা এবং গবেষণায়।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত। এখানে প্রাচীন ভারতের শাস্ত্রীয় বিষয়গুলি যেমন সংস্কৃত, বেদ, পুরাণ, সাহিত্য, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, আর্থশাস্ত্র, এবং মেডিসিনের উপর গুরুত্ব দেয়া হতো। নালন্দায় শিক্ষকেরা বিশ্ববিখ্যাত ছিলেন এবং সেখানে পড়ালেখা করতে আসতেন ছাত্ররা সারা বিশ্ব থেকে।
নালন্দায় শিক্ষা ছিল এক অত্যন্ত গুণগত এবং বহুমুখী। এখানে বিভিন্ন শাস্ত্রের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন, যারা ছাত্রদের বিভিন্ন বিষয়ে তত্ত্ব এবং প্রয়োগগত জ্ঞান দিতেন। সেখানে এমন কিছু শিক্ষকও ছিলেন, যারা পরে বৈশ্বিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন, যেমন চন্দ্রকির্তি, শীলবদ্র, হর্ষ, এবং আরও অনেকে।
শিক্ষার্থীরা:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা পড়ালেখার জন্য আসতেন। এখানকার শিক্ষার্থীরা ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, যেমন চীনের, তিব্বতের, কোরিয়ার, জাপানের, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির থেকেও আসতেন। তাদের মধ্যে চীনা পর্যটক এবং বৌদ্ধ ধর্মমত প্রচারক হিউয়েন সাং (Xuanzang) অন্যতম। তিনি নালন্দায় শিক্ষালাভ করেছিলেন এবং তার ভ্রমণ বর্ণনায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
নালন্দার স্থাপত্য ও অবকাঠামো:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একটি বিশাল আকারের স্থাপনা, যেখানে বিভিন্ন পাখির বাসা, অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি, এবং শ্রেণীকক্ষ ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অডিটোরিয়ামে একযোগে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আলোচনা এবং পাঠদান করতেন। নালন্দার মূল আকর্ষণ ছিল তার বিশাল লাইব্রেরি, যা “ধর্মগঙ্গা” নামে পরিচিত ছিল এবং এটি এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ লাইব্রেরি ছিল। এখানে বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন, এবং বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন পুস্তক সংরক্ষণ করা হত।
নালন্দার পতন:
১২ শতকের শেষভাগে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় মুঘল সম্রাট বাহলুল লোদির সেনাদের দ্বারা আক্রমণ এবং দখল হয়। ১২০০ খ্রিস্টাব্দে, মুঘল সেনাপতি বখতিয়ার খিলজী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করেন, এবং তার অগ্নিসংযোগের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিশাল সংগ্রহশালা ও শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। এর পর থেকে নালন্দার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
আধুনিক নালন্দা:
বর্তমানে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টি UNESCO কর্তৃক একটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থল হিসেবে চিহ্নিত। ভারত সরকার ২০০৬ সালে “নালন্দা ইউনিভার্সিটি” নামে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি পুরনো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোর পাশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এটি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে।
নালন্দার প্রভাব:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব শুধুমাত্র ভারত বা দক্ষিণ এশিয়া নয়, বরং পুরো পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা পদ্ধতি, এবং বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের একত্রিত করার প্রচেষ্টা পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য এক আদর্শ সৃষ্টি করেছে। নালন্দার শিক্ষা নীতি ও গবেষণার ক্ষেত্রগুলি সেই সময়ের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির জন্য এক বিশাল প্রেরণা ছিল।
এছাড়া, বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারেও নালন্দার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নালন্দায় বৌদ্ধ ধর্মের অনেক গুরুতর আলোচনা, গবেষণা এবং ধর্মীয় চর্চা হয়েছে, এবং এটি বৌদ্ধ দর্শনের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
উপসংহার:
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীন ভারতের এক চিরকাল স্মরণীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল, যা শুধুমাত্র জ্ঞান এবং শিক্ষা প্রদানেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি সারা বিশ্বে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির সমন্বয়ে একটি অমূল্য ঐতিহ্য তৈরি করেছিল। আজকের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তার পূর্বসূরীর ঐতিহ্য ধরে রেখে আধুনিক শিক্ষার অঙ্গনে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, যা সারা পৃথিবীর জন্য এক অমূল্য দান হতে পারে।