ধ্বনি কাকে বলে? ধ্বনির শ্রেণিবিভাজন করে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধ্বনির পরিচয় দাও।

ধ্বনি কাকে বলে?

যেসব ধ্বনি উচ্চারণকালে ফুসফুস থেকে নিঃসারিত বায়ু মুখ দিয়ে বের হবার সময় পূর্ণ বা আংশিকভাবে বাধা পায়, ঘর্ষণ পায়, অথবা সংকুচিত হয়, সেগুলিকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলা হয়। বিশ্বের সমস্ত ভাষা বিশ্লেষণ করে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০টি ভিন্ন ব্যঞ্জনধ্বনি চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্যঞ্জনধ্বনিকে আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালায় ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: ফুসফুসনির্গত ব্যঞ্জনধ্বনি, অফুসফুসীয় ব্যঞ্জনধ্বনি এবং যুগ্মোচ্চারিত ব্যঞ্জনধ্বনি।

  • ফুসফুসনির্গত ব্যঞ্জনধ্বনি:যেসব ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণকালে ফুসফুসের চাপের কারণে বহির্গামী বায়ুপ্রবাহ সৃষ্টি হয় সেগুলোকে ফুসফুসনির্গত ব্যঞ্জনধ্বনি বলা হয়। বায়ু ফুসফুস থেকে তিনটি পথ দিয়ে বের হতে পারে: নাসিক পথে, কেন্দ্রিক পথে, বা পার্শ্বিক পথে। পৃথিবীর ভাষাসমূহে, এবং আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালায়, বেশিরভাগ ব্যঞ্জনধ্বনিই এই ধরনের ব্যঞ্জনধ্বনি। বাংলার সমস্ত ব্যঞ্জনধ্বনি এই শ্রেণীর অন্তর্গত। উচ্চারণ স্থান অনুযায়ী এর শ্রেণীবিভাগগুলি হল উভয়ৌষ্ঠ্য, দন্তৌষ্ঠ্য, দন্ত্য, দন্তমূলীয়, পশ্চাদ্দন্তমূলীয়, মূর্ধন্য, তালব্য, পশ্চাত্তালব্য, অলিজিহ্ব্য, গলনালীয়, কন্ঠনালীয়। বাধার প্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেণীবিভাগগুলি হল স্পর্শ, নাসিক্য, কম্পিত, তাড়িত, উষ্ম, পার্শ্বিক উষ্ম, নৈকট্যক এবং পার্শ্বিক নৈকট্যক
  • অফুসফুসীয় ব্যঞ্জনধ্বনিযে সমস্ত ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণকালে ফুসফুসের কোনও বিশেষ কার্য থাকে না, বরং বায়ু শ্বাসরন্ধ্র (ধ্বনিদ্বার বা কন্ঠনালিপথ) ও পশ্চাত্তালু (কোমল বা নরম তালু) দ্বারা সঞ্চালিত হয়, সে সমস্ত ব্যঞ্জনধ্বনিকে অফুসফুসীয় ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। এই দুই যন্ত্রগুলো বন্ধ করলে বায়ুসঞ্চালক হিসাবে কাজ করতে পারে। এই ব্যঞ্জনধ্বনিগুলি পৃথিবীর খুব কম ভাষাতেই দেখতে পাওয়া যায়। অ-ফুসফুসনির্গত ব্যঞ্জনধ্বনিগুলির বিভিন্ন শ্রেণিগুলি হল: শীৎকার, অন্তঃস্ফোটী, বহিঃস্ফোটী
  • যুগ্মোচ্চারিত ব্যঞ্জনধ্বনিযে সমস্ত ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময় একই সঙ্গে বাগ্‌যন্ত্রের দুটি আলাদা জায়গায় বাধা পায়, সেই ব্যঞ্জনধ্বনিকে যুগ্মোচ্চারিত ব্যঞ্জনধ্বনি বলে।

ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ স্থান বিন‍্যাসে

উচ্চারণ স্থান হিসাবে আমরা ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণস্থানগুলোকে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। এই ভাগ দুটি হলো―

১.১. স্বরতন্ত্রী থেকে আলজিহ্বা পর্যন্ত অংশ : এই অংশের ভিতর বাংলা ব্যঞ্জনধ্বনি হিসাবে স্বরতন্ত্রী জাত ধ্বনি পাওয়া যায়- হ এবং ঃ। এই অংশের স্বরপথ ও আলজিহ্বা থেকে উৎপন্ন ধ্বনি বাংলাতে নেই।

১.২. কোমল তালু থেকে ওষ্ঠাধর পর্যন্ত : বাংলা ব্যঞ্জনধ্বনির অধিকাংশই উচ্চারিত হয়, আলজিহ্বা সংলগ্ন কোমল তালু থেকে ওষ্ঠাধর পর্যন্ত বিস্তৃত অংশের ভিতরে। এই অংশের উচ্চারিত ধ্বনিগুলো সাধারণভাবে স্পর্শধ্বনি হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য স্পর্শধ্বনিকে বিবেচনা করা হয় ফুসফুস পরিচালিত বায়ু প্রবাহজাত ধ্বনির প্রতিহত শ্রেণী হিসাবে। জিহ্বার পিছন অংশটি কোমল তালু বা পশ্চাত্তালুটি স্পর্শ করে বা তার কাছে নিকটবর্তী হয়ে যেসব ধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেগুলোকে পশ্চাত্তালব্য ব্যঞ্জনধ্বনি বলা হয়।

বাগ্‌প্রত্যঙ্গের স্পর্শ-প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে স্পর্শ ধ্বনিকে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগ দুটি হলো― অধরস্থ ধ্বনি জিহ্বাস্পর্শিত ধ্বনি

  • অধরস্থ ধ্বনি
    মানুষের ঠোঁটকে উপর-নিচের অবস্থান অনুসারে দুটি নামে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এর উপরের অংশের নাম ওষ্ঠ ও নিচের অংশের নাম অধর। এই অধরের সাথে কখনো উপরের পাটির দাঁতের সামনের কয়েকটি দাঁত স্পর্শ করে বা ওষ্ঠ অধরকে স্পর্শ করে। এই স্পর্শের ধরন অনুসারে অধরস্থ ধ্বনিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগ দুটো হলো- ওষ্ঠাধর ধ্বনি দন্ত্যাধর ধ্বনি
    • ওষ্ঠাধর ধ্বনি :
      বাংলা ব্যাকরণে এই জাতীয় ধ্বনিকে ওষ্ঠ্যধর-ধ্বনি বলা হয়। এই ধ্বনি ওষ্ঠ ও অধরের স্পর্শে উচ্চারিত হয়। এই জাতীয় বাংলা ধ্বনিগুলো হলো- প, ফ, ব, ভ, ম। যেসব ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণে উভয় ঠোঁট স্পর্শ করা হয় সেগুলোকে উভয়ৌষ্ঠ্য বা বিশুদ্ধ ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি বলা হয়।
    • দন্ত্যাধর বা দন্তৌষ্ঠ :
      এই সময় ওষ্ঠ উপরের দিকে তুলে ধরে রাখা হয়। এই অবস্থায় দন্ত ও অধরের মধ্যে সামান্য ফাঁক সৃষ্টি করে বাতাসের ধাক্কায় ধ্বনি সৃষ্টি করা হয়। স্বাভাবিকভাবে বাংলা বর্ণগুলোর কোনটিই এই ভাবে উচ্চারণ করা হয় না। বাংলাভাষায় কোন সুনির্দিষ্ট বর্ণ এরূপ পৃথকভাবে উচ্চারিত না হলেও, হ্ব যুক্ত শব্দের ক্ষেত্রে এই জাতীয় ধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন : জিহ্বা। বাংলা বানানে এর উচ্চারণ লিখতে গেলে লিখা উচিত্ জিওvআ বা জিউvআ। কারণ এই v বাংলা ভ নয়। এই জাতীয় অন্যান্য শব্দগুলো হলো- আহ্বান, বিহ্বল, গহ্বর ইত্যাদি।
  • জিহ্বাস্পর্শিত ধ্বনি
    জিহ্বার প্রত্যক্ষ ব্যবহারে উচ্চারিত বর্ণগুলোর সাধারণ নাম হিসাবে একে গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে জিহ্বার পশ্চাৎ অংশ বা অগ্রভাগ দ্বারা তালু, দন্তমূল, দন্ত ইত্যাদি স্পর্শ করে ধ্বনি উৎপন্ন করা হয়। বর্গীয় ধ্বনির ভিতর স্বাধীন ‘ঞ’ পুরোপুরি স্পর্শ না হলেও যুক্ত ‘ঞ’ জিহ্বা-স্পর্শিত। ব্যঞ্জনধ্বনির ভিতর প বর্গের সকল ধ্বনি, স, হ, ঃ এবং ঁ জিহ্বা-স্পর্শিত হয়ে উচ্চারিত হয় না। জিহ্বার অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনায় একে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এই ভাগ দুটো হলো―
    • পশ্চাৎজিহ্বাজাত ধ্বনি :
      জিহ্বার পিছনের অংশটি কোমল তালুর শেষের দিকে স্পর্শ করে এই জাতীয় ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়। বর্গীয় ধ্বনিগুলোর ভিতর একমাত্র ক-বর্গের ধ্বনিগুলোই এই শ্রেণীর ভিতর ধরা হয়। ক-বর্গীয় ধ্বনিগুলোকে কণ্ঠ্যধ্বনি বলা হতো। নরম তালুর পশ্চাৎ দিকের অংশ থেকে গ্লটিস পর্যন্ত বিস্তৃত অংশ থেকে উৎপন্ন ধ্বনিগুলোকে সাধারণভাবে কণ্ঠ্যধ্বনি বলা হয়। উৎপত্তির স্থান বিবেচনায় কণ্ঠ্যধ্বনিকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ তিনটি হলো―আল্জিহ্বাজাত ধ্বনি, গলকক্ষীয় ধ্বনি স্বরপথ স্পর্শ ধ্বনি। আলজিহ্বাজাত ধ্বনি আলজিহ্বাকে কম্পিত করে সৃষ্টি করা হয়। ডাচ্-জার্মান ও ফরাসী ‘র’ এ-ভাবে উচ্চারিত হয়। সে জন্য এ ভাষাগুলোর ‘র’ ধ্বনির নাম Uvula ‘র’। গলকক্ষ সঙ্কুচিত করে গলকক্ষীয় ধ্বনি সৃষ্টি হয়। আরবী কাফ ধ্বনি গলকক্ষীয় ধ্বনির উদাহরণ। স্বরতন্ত্রীর মধ্যবর্তী স্বরপথ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে এক ধরনের ধ্বনির সৃষ্টি হয়। একেই বলা হয় স্বরপথস্পর্শীয় ধ্বনি । জার্মান ভাষায় এই ধ্বনির ব্যবহার রয়েছে।
  • জিহ্বাশিখরীয় ধ্বনি :
    জিহ্বার অগ্রভাগ শিখার মতো উপরে উঠিয়ে, স্বরতন্ত্রীকে বাধা দিয়ে এই ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়। জিহ্বার অগ্রভাগ দ্বারা দাঁত, মাড়ি (দন্ত্যমূল), মূর্ধা, তালু স্পর্শ করার প্রক্রিয়ায় জিহ্বাশিখরীয় ধ্বনির উৎপত্তি ঘটে। এক্ষেত্রে জিহ্বার অগ্রভাগ উক্ত স্থানগুলোর কোথায় স্পর্শ করবে, তার উপর ভিত্তি করে ধ্বনির ধর্ম বিবেচনা করা হয়। এই শ্রেণীর ধ্বনিগুলোকে ৪টি উপভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগগুলো হলো―
    • প্রশস্ত দন্ত্যমূলীয় ধ্বনি তালব্য ধ্বনি :
      বাংলাতে এই ধ্বনিগুলো উচ্চারণের সময় জিহ্বা-ফলক ও জিহ্বার অগ্রভাগ একই সাথে শক্ত তালু ও দন্তমূল স্পর্শ করে। প্রচলিত ব্যাকরণ বইতে এই জাতীয় ধ্বনিকে তালব্য নামে পরিচয় দেওয়া হয়। জিহ্বার মাঝের অংশটি তালুটি স্পর্শ করে বা তার কাছে নিকটবর্তী হয়ে যেসব ধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেগুলোকে তালব্য ব্যঞ্জনধ্বনি বলা হয়। বিশুদ্ধ তালব্য ব্যঞ্জনধ্বনি বিশ্বের ভাষায় ব্যবহার খুবই কম, অথচ অর্ধ-তালব্য ব্যঞ্জনধ্বনি (পশ্চাদ্‌দন্তমূলীয় ব্যঞ্জনধ্বনি ও তালব্যীভূত জিহ্বামূলীয় ব্যঞ্জনধ্বনি) সর্বব্যাপী। এই বর্গের ভিতর ঞ উচ্চারণটি সানুনাসিক বর্ণ। উচ্চারণের দিক থেকে এটি যৌগিক স্বরবর্ণের মতো (ইঁয়ঁ)। যুক্তবর্ণ হিসাবে এর উচ্চারণ হয় দন্ত্য-ন এর মতো। অঞ্জন =অ-ঞ্+জ-ন। এর উচ্চারণ- অন্‌জন। তালব্য বর্গের বাইরের ধ্বনি শ-কে তালুজাত ধ্বনি হিসাবে বিবেচনা করা হলেও কখনো কখনো কিছু শর্ত সাপেক্ষে তা দন্ত্য-বর্ণে রূপ লাভ করে থাকে।
    • স্নিগ্ধতালব্য ধ্বনিক-বর্গীয় ধ্বনির উচ্চারণ হয় কোমল তালু থেকে, তাই এর নামকরণ করা হয়- কোমল তালুজাত বা স্নিগ্ধতালব্য ধ্বনি (Velar)। এই ধ্বনি উচ্চারণ করার ক্ষেত্রে, প্রথমে কোমল তালুতে জিহ্বার পশ্চাত্ অংশ যুক্ত করে শ্বাস রোধ করা হয়। পরে এই অবরোধ তুলে স্বরবর্ণযুক্ত করে এই ধ্বনি উৎপন্ন করা হয়। ক, খ, গ, ঘ, ঙ এই জাতীয় ধ্বনি।।
    • অন্তর্দন্ত্য ধ্বনি:
      দুই পাটি দাঁতের মাঝে জিহ্বার ডগা স্পর্শ করে এই জাতীয় ধ্বনির উচ্চারণ করা হয়। যেমন- গ্রীক q । বাংলা বর্ণমালায় এই উচ্চারণ পাওয়া যায় না।
    • দন্ত্য:
      উপরের দাঁতে জিহ্বার অগ্রভাগ স্পর্শ করে এই জাতীয় ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়। বাংলা বর্ণগুলোর ভিতর এই জাতীয় বর্ণগুলো হলো-ত, থ, দ, ধ। বাংলা ব্যাকরণে অনেকে দন্ত্য বর্ণ হিসাবে ন কে উল্লেখ করেন। মূলত ন হলো দন্তমূলীয় বর্ণ।
    • দন্ত্যমূলীয় :
      জিহ্বার অগ্রভাগ দ্বারা দাঁতের গোড়া স্পর্শ করে এই জাতীয় ধ্বনি সৃষ্টি করা হয়। বাংলা বর্ণমালায় এই জাতীয় বর্ণগুলো হলো- ন, র, ল। জিহ্বার ডগাটি দাঁতের পিছনের শক্ত অংশ বা দন্তমূলে স্পর্শ করে বা তার কাছে নিকটবর্তী হয়ে যেসব ধ্বনি উচ্চারিত হয়, সেগুলোকে দন্তমূলীয় ব্যঞ্জনধ্বনি বলা হয়। বাংলা ভাষার “ন”, “র”, “ল”, ও “শ” বর্ণগুলোর উচ্চারণ দন্তমূলীয় বলা হয়। কিছু-কিছু অঞ্চলে বাংলা “ট”, “ঠ”, “ড”, ও “ঢ” বর্ণগুলোর উচ্চারণস্থানও দন্তমূলীয়। এই ধ্বনিগুলোকে আরও সুনির্দিষ্ট করার জন্য একটি বিভাজন করা হয়। যেমন―
      • প্রকৃত দন্ত্যমূলীয় :
        দন্তমূলে অগ্রজিহ্বা স্পর্শ করে এই জাতীয় ধ্বনি উৎপন্ন করা হয়। বাংলাতে এই জাতীয় বর্ণগুলো হলো- ন, য, র, ল, স। যুক্তবর্ণ হিসাবে উচ্চারিত বর্ণগুলো হলো হ্ন, হ্ল, হ্র।
      • উত্তর দন্ত্যমূলীয়:দন্তমূলের পিছনের দিকের শক্ততালুর কাছাকাছি অংশ পর্যন্ত স্পর্শ দন্ত্যমূলের অঞ্চল। জিহ্বার অগ্রভাগ উঁচু করে এই অংশ স্পর্শ করে যে ধ্বনি উৎপন্ন হয়, তাকে উত্তর দন্ত্যমূলীয় ধ্বনি বলা হয়। বাংলাতে এই জাতীয় বর্ণ হিসাবে শ-কে বিবেচনা করা হলেও, এই ধ্বনিটি উচ্চারণে জিহ্বা উত্তর দন্ত্যমূলকে পুরোপুরি স্পর্শ করে না। তবে এক্ষেত্রে উত্তর দন্ত্যমূল বরাবর জিহ্বার অগ্রভাগ সামান্য স্পর্শ পায় মাত্র। এই সামান্য স্পর্শ ছাড়াই শ উচ্চারণ করে থাকেন।
      • দন্তমূলীয় প্রতিবেষ্টিত :জিহ্বার অগ্রভাগ একটু বেশি বাঁকিয়ে মাড়ির শেষাংশের শক্ততালুর কাছাকাছি স্থান স্পর্শ করে এই জাতীয় ধ্বনি উচ্চারণ করা হয়। মূর্ধা অঞ্চল থেকে উচ্চারিত ধ্বনি হিসাবে এগুলোকে মূর্ধন্য হিসাবেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বাংলাতে এই জাতীয় বর্ণগুলো হলো- ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, ড়, ঢ়, ষ।

ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ প্রকৃতি বিন‍্যাসে

  • ফুসফুস পরিচালিত বায়ুপ্রবাহজাত ধ্বনি
    ফুসফুস পরিচালিত বায়ুপ্রবাহ-জাত ধ্বনিগুলোর বায়ু প্রবাহের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ দুটি হলো- প্রতিহত ধ্বনি প্রবাহী ধ্বনি।
    • প্রতিহত ধ্বনি : এই জাতীয় ধ্বনির ক্ষেত্রে বাগ্-প্রত্যঙ্গ দ্বারা উচ্চারণ স্থানে বায়ুপ্রবাহ কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ থামিয়ে দেওয়া হয়। ফলে এই সময় কোন ধ্বনি তৈরি হয় না। এরপর হঠাৎ করে এই বাধা উঠিয়ে ফুসফুসের বাতাসকে ধাক্কা দিয়ে মুখের বাইরে দিকে সঞ্চালিত করা হয়।
      বাংলা ধ্বনিতত্ত্বে এই জাতীয় ধ্বনিগুলোকে বলা হয় স্পর্শ ধ্বনি। ব্যঞ্জনধ্বনিমালায় বর্গীয় ধ্বনি হিসাবে এর সংখ্যা ২০টি। এগুলো হলো- ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, প, ফ, ব, এবং ভ। এছাড়া য ধ্বনিটি প্রতিহত ধ্বনি। র, ল, শ, ষ, হ, ইত্যাদি স্পর্শ ধ্বনির অন্তর্ভুক্ত হলেও, এগুলো প্রতিহত নয়। এই ধ্বনিগুলো সব সময় মুখবিবর দিয়ে প্রকাশ পায়। আবার নাক দিয়ে সঞ্চালিত ধ্বনি প্রতিহত হয় না। সেই কারণে নাসিক্য ও সানুনাসিক ধ্বনি প্রতিহত নয়।
    • প্রবাহী ধ্বনি : এই সকল ধ্বনি বাগ্‌প্রত্যঙ্গ স্পর্শিত হয়ে বাতাসকে বাধা দেয় বটে, কিন্তু বিকল্পপথে বায়ু প্রবাহের কারণে ধ্বনি সম্পূর্ণ থেমে যায় না। এর ফলে উত্পন্ন ধ্বনির আংশিক রূপ পাওয়া যায়। যেমন ম ধ্বনিটি। ঠোঁট বন্ধ করে ম ধ্বনি উচ্চারণের চেষ্টা করলে, ধ্বনির একটি অংশিতরূপ নাকের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হবে এবং তা অবিচ্ছিন্নভাবে চালিত করা সম্ভব হয়। এই অবস্থায় হঠাৎ করে, রুদ্ধ বাগ্‌প্রত্যঙ্গ উন্মুক্ত করে দিলে, ধ্বনিটি পূর্ণরূপে প্রকাশিত হবে।
    • ১.নাসিক্য : শুধুমাত্র নাক দিয়ে ধ্বনি প্রবাহিত হবে। এই জাতীয় ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো হলো- ঙ, ঞ, ন, ণ, ম, ং।
    • ২. সানুনাসিক : যে সকল ধ্বনি নাক ও মুখ দিয়ে বিভাজিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এর পূর্ণনাম সানুনাসিক ব্যঞ্জনবর্ণ যেমন : চন্দ্রবিন্দু যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ।
    • ৩. মৌখিক : ফুসফুস তাড়িত ধ্বনি যখন অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে শুধু মাত্র মুখ দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন তাকে মৌখিক ধ্বনি বলা হয়। কিন্তু ধ্বনির এই অবিচ্ছিন্ন প্রবাহের ভিতরও কিছুটা বাধা থাকে। কারণ কিছু বাধা না পেলে ব্যঞ্জনধ্বনি সৃষ্টি হবে না। বাংলা ভাষায় চার ধরনের মৌখিক ধ্বনি পাওয়া যায়। এগুলো হলোকম্পিত, তাড়নজাত, উষ্ম পার্শ্বিক। এই জাতীয় ধ্বনি গুলো হলো- র, ল, শ, ষ, স, হ, ড়, ঢ়, ঃ।
    • কম্পিত ধ্বনি : ফুসফুস তাড়িত বাতাস মুখবিবর দিয়ে বের হওয়ার সময়, যদি জিহ্বা বা আলজিহ্বা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কম্পনের সৃষ্টি করে, তা হলে তাকে কম্পিত ধ্বনি বলা হয়। বাংলাতে র ধ্বনিটি কম্পিত ধ্বনি। আলজিহ্বার কম্পনে সৃষ্ট ধ্বনি বাংলাতে নেই। ফরাসী ও জার্মান ভাষায় এই জাতীয় র ধ্বনি পাওয়া যায়। এর উচ্চারণ হয়ে থাকে র্‌র্‌র্ ধরনের। এই জাতীয় ধ্বনিকে তরল ধ্বনি হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
    • তাড়নজাত ধ্বনি : জিহ্বার অগ্রভাগ তালুর দিকে উঠিয়ে একটি বারের তাড়নায় এই ধ্বনি তৈরি করা হয়। বাংলাতে এই জাতীয় দুটি রয়েছে। ধ্বনি দুটি হলো- ড এবং ঢ়।
    • উষ্ম ধ্বনি: ফুসফুস থেকে শ্বাস বেরিয়ে যাবার পথ কোথাও সঙ্কুচিত করার কারণে, বাতাসে এক ধরনের শিস্ জাতীয় শব্দের সৃষ্টি হয়। শ্বাসের ঘর্ষণজাত প্রক্রিয়ায় উত্পন্ন শিস্ জাতীয় ধ্বনি উষ্ম (নিঃশ্বাস) ধ্বনি বলা হয়। বাংলাতে এই জাতীয় ধ্বনিগুলো হলো- শ, ষ, স, হ।
    • পার্শ্বিক ধ্বনি : ফুসফুস থেকে আগত বাতাস মুখবিবর দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময়, জিহ্বার অগ্রভাগ তালু অংশের দিকে স্পর্শ করে বাধা প্রদান করলে, বাতাস জিহ্বার দুই পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এই সময় হঠাৎ করে জিহ্বার ডগা উপরের অংশ থেকে সরিয়ে নিলে যে ধ্বনির সৃষ্টি হয়, তাকেই পার্শ্বিক ধ্বনি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাতে এই জাতীয় ধ্বনি হলো ল। এটি তরল ধ্বনি নামেও চিহ্নিত করা হয়।
  • অল্পপ্রাণ মহাপ্রাণ ধ্বনি : বাংলা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় কিছু ব্যঞ্জনধ্বনির সাথে একটি বাড়তি হ ধ্বনি যুক্ত করে উচ্চারণ করা হয়। এই সকল ধ্বনিতে মূল ধ্বনির সাথে হ ধ্বনিটি এমনভাবে মিশে থাকে যে, তাকে পৃথক শোনা যায় না। এই বিচারে ব্যঞ্জনধ্বনিগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন―
    • অল্পপ্রাণ : যে সকল ব্যঞ্জনধ্বনির সাথে হ ধ্বনি যুক্ত হয় না, তাকে অল্পপ্রাণ ধ্বনি বলে। বাংলাতে এই জাতীয় ব্যঞ্জন ধ্বনিগুলো হলো- ক, গ, ঙ, চ, জ, ঞ, ট, ড, ণ, ত, দ, ন, প, ব, ম, র, ল এবং ড়
    • মহাপ্রাণ : যে সকল ব্যঞ্জনধ্বনির সাথে হ ধ্বনি যুক্ত হয়, তাকে মহাপ্রাণ ধ্বনি বলে। বাংলাতে এই জাতীয় ব্যঞ্জন ধ্বনিগুলো হলো- খ, ঘ, ছ, ঝ, ঠ, ঢ, থ, ধ, ফ, ভ, ঢ় এবং হ।
  • ঘোষ অঘোষ ধ্বনি : স্বরতন্ত্রী সামান্য উন্মুক্ত করে ফুসফুসের বাতাসকে সজোরে সঞ্চালিত করলে, স্বরতন্ত্রী দুটো তীব্রভাবে কাঁপতে থাকে। এর ফলে যে ধ্বনির সৃষ্টি হয়, তাকে ঘোষ ধ্বনি বলে। কিন্তু স্বরতন্ত্রী দুটো একটু বেশি প্রসারিত করলে, বাতাস স্বরতন্ত্রীর প্রান্তদেশ ছুঁয়ে যায় মাত্র। এর ফলে স্বরতন্ত্রী অপেক্ষাকৃত কম কম্পিত হয়। এর ফলে যে ধ্বনি উৎপন্ন হয়, তাকে বলা হয় অঘোষ।
    • ঘোষ ধ্বনি : বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ : গ, ঘ, ঙ; জ, ঝ, ঞ; ড, ঢ, ণ; দ, ধ, ন; ব, ভ, ম। অন্যান্য বর্ণ : য, র, ল, ব, হ।
    • অঘোষ ধ্বনি : বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণ : ক, খ; চ, ছ; ট, ঠ; ত, থ; প, ফ)। অন্যান্য বর্ণ : শ, ষ, স, ঃ ও সকল ফিসফিস করে উচ্চারিত ধ্বনি।
  • বাংলা ব্যাকরণে অল্পপ্রাণ, মহাপ্রাণ, ঘোষ ও অঘোষের সমন্বয়ে যে তালিকা তৈরি করা হয়, তার তালিকা নিচে দেওয়া হলো।
  • অল্পপ্রাণঅঘোষ : , , , , প।
    অল্পপ্রাণঘোষ : , , , , , , , , , , , , , ড়।
    মহাপ্রাণঅঘোষ : , , , , ফ।
    মহাপ্রাণঘোষ : , , , , , ঢ়।
  • ঘৃষ্টধ্বনি : জিহ্বাকে ও দন্তমূলের সাথে যুক্ত করে, হঠাৎ তা বিযুক্ত করে বহির্গামী ধ্বনি প্রেরণ করলে, ঘৃষ্ট জাতীয় ধ্বনি তৈরি হয়। বাংলাতে এই ধ্বনিগুলো হলো- চ, ছ, জ, ঝ।
  • অর্ধস্বর ধ্বনি : এমন কিছু ধ্বনি আছে, যেগুলোকে সঠিকভাবে স্বরধ্বনি বা ব্যঞ্জনধ্বনির ভিতর ফেলা যায় না। ধ্বনি বিজ্ঞানীরা এই জাতীয় ধ্বনিকে অর্ধ-স্বর (Semi-vowel) হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বাংলাতে এই জাতীয় ধ্বনি হলো য়। এছাড়া বাংলায় ব্যবহৃত ব-শ্রুতি এই জাতীয় ধ্বনি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
  • নৈকট্য ব্যঞ্জনধ্বনি বা অন্তঃস্থ ব্যঞ্জনধ্বনিসেসব ব্যঞ্জনধ্বনি, যা উচ্চারণকালে কোন উচ্চারক একটি উচ্চারণস্থানের কাছে নিকটবর্তী হয়। বাংলা লিপিতে “র” বর্ণের উচ্চারণরীতি নৈকট্য।
  • ফুসফুসবিচ্ছিন্ন বায়ু প্রবাহজাত ধ্বনি
    এই জাতীয় ধ্বনি উচ্চারণে ফুসফুস এর সাথে বায়ু সংযোগে সাময়িকভাবে বিচ্ছেদ ঘটে। ফুসফুসের সাথে বায়ু প্রবাহের বিচ্ছেদের ঘটনাটি দুটি ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। এর একটি হলো স্বরতন্ত্রীতে, অপরটি স্নিগ্ধ বা কোমল তালুতে। সেই কারণে ফুসফুস-বিচ্ছিন্ন বায়ু প্রবাহজাত ধ্বনিকে প্রাথমিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো− রুদ্ধস্বরপথচালিত বায়ু প্রবাহজাত ধ্বনি এবং স্নিগ্ধতালুচালিত বায়ুপ্রবাহজাত ধ্বনি
    • রুদ্ধস্বরপথচালিত বায়ু প্রবাহজাত ধ্বনি : আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে, স্বরতন্ত্রীর মধ্যবর্তী পথটিকে স্বরপথ বলা হয়। এই স্বরপথ বন্ধ করে দিলে, ফুসফুসের সাথে স্বরতন্ত্রের উপরিভাগের বায়ু-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই অবস্থায় যে ধ্বনি উচ্চারিত হয়, তাকে বলা হয় রুদ্ধ-স্বরপথ-চালিত বায়ু প্রবাহজাত ধ্বনি। এই জাতীয় ধ্বনি আবার দুটি প্রক্রিয়ায় হতে পারে। এই প্রকার দুটি হলো− বহিঃস্ফোটক ও অন্তঃস্ফোটক।
      • বহিঃস্ফোটক: স্বরতন্ত্রীর মধ্যস্থ স্বরপথ বন্ধ করে দেওয়ার পর পুরো স্বরযন্ত্রকে একটু উপরের দিকে উঠালে, ঊর্ধ্বকণ্ঠের জায়গা কমে যায়। ফলে স্বরতন্ত্রীর উপরিভাগ থেকে মুখবিবর বা নাসিকা রন্ধ্র পর্যন্ত একটি ঘন বায়ুস্তম্ভ তৈরি হয়। এই অবস্থায় মুখ বা নাসারন্ধ্রের বাধা দূর করলে, বায়ু সশব্দে মুখ বা নাসিকা পথে নিষ্ক্রান্ত হয়। হিক্কাধর্মী এই শব্দকে বহিঃস্ফোটক বলা হয়। বাংলা ভাষায় এই জাতীয় ধ্বনির ব্যবহার নেই।
      • অন্তঃস্ফোটক: স্বরতন্ত্রীর মধ্যস্থ স্বরপথ বন্ধ করে দেওয়ার পর পুরো স্বরযন্ত্রকে একটু নিচের দিকে নামালে, ঊর্ধ্বকণ্ঠের জায়গা বৃদ্ধি পায়। ফলে স্বরতন্ত্রীর উপরিভাগ থেকে মুখবিবর বা নাসিকা রন্ধ্র পর্যন্ত একটি হাল্কা বায়ুস্তম্ভ তৈরি করে। এই অবস্থায় বাইরের বাতাস মুখ বা নাসারন্ধ্র দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে যে শব্দ সৃষ্টি হয়, তাকে অন্তঃস্ফোটক ধ্বনি বলা হয়। প্রমিত বাংলা উচ্চারণে এই জাতীয় ধ্বনির ব্যবহার নেই।
    • স্নিগ্ধতালুচালিত বায়ুপ্রবাহজাত ধ্বনি: জিহ্বার পশ্চাত্ভাগ দ্বারা স্নিগ্ধতালু অবরোধ করে, ফুসফুসের সাথে বাতাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এই জাতীয় ধ্বনি উৎপন্ন করা হয়। এই অবরোধের পর পশ্চাৎ জিহ্বাকে সামনের দিকে এগিয়ে আনার চেষ্টা করলে মুখের ভিতরের বাতাস বাইরে চলে আসে। একে বলা হয় স্নিগ্ধতালু-চালিত বহির্গামী বায়ু প্রবাহ। কিন্তু ঠিক এর উল্টো পদ্ধতিতে জিহ্বার পশ্চাত্ভাগ গলার দিকে নামিয়ে আনলে মুখের ভিতর বাতাস প্রবেশ করে। একে বলা হয় অন্তর্গামী বায়ু প্রবাহ। আর এর ফলে যে ধ্বনি তৈরি হয়, তাকে বলা হয় অন্তর্গামী শীৎকার বা কাকুধ্বনি । বাংলা ভাষাভাষীরা নিত্য প্রয়োজনে বিবিধ শীৎকার ধ্বনি ব্যবহার করে থাকেন। শীৎকার উৎপন্নের স্থান বিবেচনায় একে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো হলো−
      • ১. ওষ্ঠাধর শীৎকার: ঠোঁট দুটো চেপে ধরে, তারপর হঠাৎ তা উন্মুক্ত করে ভিতরে বাতাস টেনে নিলে যে ধরনের ধ্বনি সৃষ্টি হয়, তাকেই বলা হয় ওষ্ঠাধর শীৎকার। স্বাভাবিক ওষ্ঠাধর শীত্কারের শব্দের প্রকৃতি অনেকটা শিশুর গালে সশব্দে চুমু দেওয়ার মতো। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ওষ্ঠাধর শীৎকার রয়েছে। এই ধরনগুলো নির্ভর করে ওষ্ঠাধরের কুঞ্চন, প্রসারণ, বর্তুলকরণ ইত্যাদির উপর। যেমন−
        ক। অধরিক শীৎকার : ওষ্ঠাধর প্রসারিত না করে এবং ওষ্ঠাধরকে গোল না করেই এই জাতীয় শীৎকার সৃষ্টি করা হয়। শুধু মাত্র ঠোঁট স্পর্শ করে স্বাভাবিক চুম্বনের শব্দ পাওয়া যায় এই শীত্কারে। এর অন্য একটি সমার্থ শব্দ হলো-চুমকুড়ি।
        খ। বর্তুলাকার ওষ্ঠাধর শীৎকার : ওষ্ঠাধর গোল করে এবং যথেষ্ঠ প্রসারিত না করে এই ধ্বনি করা হয়। কৃষকেরা গরু, মহিষ জাতীয় পশুকে ডাকার জন্যও এই জাতীয় ধ্বনি সৃষ্টি করে থাকেন।
        গ। বর্তুলাকার প্রসারিত ওষ্ঠাধর শীৎকার : ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে এবং গোল করে এই শীৎকার উৎপন্ন করা হয়। সতৃষ্ণ চুম্বনে এই জাতীয় ধ্বনি সৃষ্টি হয়। কৃষকের গরু, মহিষ জাতীয় পশুকে আহ্ববান করার জন্যও এই জাতীয় ধ্বনি সৃষ্টি করে থাকেন।
      • ঘ। প্রসারণকৃত ওষ্ঠাধর শীৎকার : ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে এই ধ্বনি উত্পন্ন করা হয়। এর ফলে প্অ প্অ জাতীয় ধ্বনি উত্পন্ন হয়। বিষাদ বা আনন্দ প্রকাশের জন্য অনেকে এই জাতীয় ধ্বনি উচ্চারণ করে থাকেন।
      • দন্ত্য শীৎকার: প্রথমে জিহ্বার অগ্রভাগ দ্বারা দাঁত স্পর্শ করে দাঁতের গোড়ালিতে জিহ্বা পেতে দিয়ে বাতাসকে মুখের মধ্যে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। পরে হঠাৎ করে জিহ্বাকে উঠিয়ে নিলে মুখের ভিতর বাতাস প্রবেশের কারণে যে ধ্বনির উত্পন্ন হয়, তাকে বলা হয় দন্ত্য শীৎকার। এই ধ্বনি দুই ভাবে হতে পারে। যেমন-ক। দন্ত্য শীত্কারের সময় যদি ঠোঁট প্রসারিত থাকে, তাহলে চ্অ জাতীয় ধ্বনি সৃষ্টি করা। অপ্রীতিকর, বিরক্তিকর, আক্ষেপজাতীয় ভাব প্রকাশের জন্য এই ধ্বনি ব্যবহার করা হয়।খ। দন্ত্য শীত্কারের সময় যদি ঠোঁট গোলাকার হয়, তবে তার উচ্চারণ হয় চ্উ ধরনের। এর প্রকৃতি অনেকটা কুকুর জাতীয় প্রাণীর জলপানের শব্দের মতো। কখনো সহানুভূতি প্রকাশের জন্য এই ধ্বনি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া হাঁস-মুরগীকে খাবার দেওয়ার সময় এই জাতীয় শব্দ করে ডাকা হয়।
      • উত্তর দন্ত্যমূলীয় শীৎকার : প্রথমে জিহ্বার অগ্রভাগ উত্তর দন্তমূলে লম্বভাবে স্থাপন করা হয়, পরে জিহ্বাকে নিচের দিকে ছিটকে টেনে আনলে, জিহ্বার অগ্রভাগ নিচের চোয়ালের মাড়িতে আঘাত করে। এর ফলে যে যুগপৎ ধ্বনি সৃষ্টি হয়, তাকেই উত্তর দন্তমূলীয় ধ্বনি বলা হয়। এক্ষেত্রে ঠোঁট প্রসারিত বা গোলাকার হতে পারে। ঘোড়ার দ্রুত গতির ধ্বনি বুঝাতে আমরা এই জাতীয় ধ্বনি করে থাকি।
      • তালুদন্তমূলীয় শীৎকারজিহ্বাকে উল্টিয়ে এর অগ্রভাগ তালুতে রেখে, জিহ্বাকে সজোরে দন্তমূলের দিকে টান দিলে এই ধ্বনি উত্পন্ন হয়। সরু মুখ বিশিষ্ট খালি বোতলের মুখে তালু দ্বারা আঘাত করে ছেড়ে দিলে এই জাতীয় ধ্বনি তৈরি হয়। কৃষকরা গোরুর গাড়ি চালানোর সময় দ্রুত গতিতে গরুকে চলার জন্য এই জাতীয় ধ্বনি উত্পন্ন করে থাকেন।
      • দন্ত্যমূলীয় পার্শ্বিক শীৎকার: জিহ্বাকে দন্তমূলে আবদ্ধ করে, জিহ্বার দুই পাশ সংকুচিত করে বাতাস টেনে নেওয়ার সময় এই জাতীয় ধ্বনি তৈরি করা হয়। খুব শীতে কাতর হয়ে এইভাবে ধ্বনি করা হয়।
      • শিস্ধর্মী শীৎকার : জিহ্বাকে মূর্ধা বরাবর এনে, ঠোঁট দুটো ঈষত্ গোল বা প্রসারিত করে মুখের ভিতর সজোরে বাতাস টেনে নিলে, এই জাতীয় ধ্বনি উত্পন্ন হয়। সাধারণত খুব ঝাল লাগলে আমরা এই জাতীয় ধ্বনি করে থাকি।
      • স্বরতন্ত্রী শীৎকার: কণ্ঠ্যকে সংকুচিত করে বাতাস টেনে নেওয়ার সময় এই জাতীয় ধ্বনি তৈরি করা হয়। দক্ষিণ-আফ্রিকার হটেন্টট, বান্টু গোষ্ঠীর লোকেরা এই জাতীয় ধ্বনি তাদের মূল ভাষাতেই ব্যবহার করে থাকে। প্রবল যৌন উত্তেজনায় নারীকণ্ঠ থেকে এই জাতীয় শীৎকার ধ্বনি পাওয়া যায়।
Share
Scroll to Top

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading