ধর্মমঙ্গল কাব্যকে কেন রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য বলা হয় ? ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল কাব্য আলোচনা করে এই মন্তেব্যের যোক্তিকতা প্রমান করো ? 

উত্তরঃ- ধর্মমঙ্গলকে রাঢ়ের জাতীয় কাব্য বলার কারণঃ–

১.রাঢ় বাংলার ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতির আলেখ্য নির্মাণ।
২.লাউসেনের মতো জাতীয় বীর চরিত্র নির্মাণ।
৩.স্বর্গ ও মর্ত্যের কাহিনিবৃত্ত রচনা।
৪. মহাকাব্যিক বিশালতা, চরিত্রের মহত্ব,আদর্শ ও ধর্মের জয়,অধর্মের পরাজয় প্রভৃতি মহাকাব্যিক পরিবেশ রচনা করেছেন বলে

মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্য ধারায় ধর্মমঙ্গল কাব্যখানি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী এবং স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। ফেলারাম চক্রবর্তী এই আখ্যান কাব্যকে ‘গৌড়কাব্য’ হিসাবে আখ্যাত করলেও কথাটা নানা দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য। এ কাহিনি নানা বৈচিত্রময় ও বীর রসাত্মক হওয়া সত্ত্বেও শুধু রাঢ়ভূমি ব্যতীত বাংলা দেশের অন্যত্র প্রচলিত হয়নি। উত্তরবঙ্গে মনসামঙ্গলের গোড়ার দিকে সৃষ্টি প্রক্রিয়া বর্ণনায় ধর্মের যে বৈশিষ্ট্য আছে তা ধর্মমঙ্গলের আদর্শ বহন করে। মালদহের গাজন ও গম্ভীরা উৎসব বাহ্যত শৈব হলেও তার অন্তরালে ধর্ম উপাসনার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। লাউসেনের আখ্যানটি উপযুক্ত কবির হাতে পড়লে মধ্যযুগের শুধু ‘ধর্ম’ কাব্য নয় যথার্থ Epic of Growth হতে পারত, সে‌ সম্ভাবনা পুরোপুরি ছিল। মনসা ও চণ্ডীর কাহিনির তুলনায় লাউসেনের কাহিনি অনেক বলিষ্ঠ, ঋজু গতি, সংযত ও বাস্তবধর্মী। অদ্ভুত অনৈসর্গিক ও বীরত্বের নানা গল্প লাউসেনের চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এবং সে গল্পগুলির কিছু কিছু স্থানীয় সমাজ ও ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে। এ অনুমান নিতান্ত মিথ্যা নয়। তাই কেউ কেউ ধর্ম মঙ্গলের বর্ণিত‌ কাহিনিতে ইতিহাসের ইঙ্গিত আবিষ্কার করে কিংবা এতে ভৌগোলিক বর্ণনার যথার্থতা আবিষ্কার করে পুলকিত হয়ে– ধর্মমঙ্গল কাব্যকে “রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য’ (The National Epic of Rarha) বলেছেন।

চণ্ডী, মনসা ও কালিকা মঙ্গলের কাহিনিগুলি সম্পূর্ণরূপে যে কাল্পনিক তাতে সন্দেহ নেই এবং কাল্পনিক বলেই একজন কবির বর্ণনার সঙ্গে অপর কবির বর্ণনার পার্থক্য দেখা যায়। স্থানীয় বর্ণনা ও ভৌগোলিক তথ্যের অনেক গোলমাল বিশৃংখলা রয়েছে। কিন্তু ধর্মমঙ্গলের কাহিনি কেবল অঞ্চল বিশেষে সীমাবদ্ধ, এবং এ কাহিনীর মূলে কোন না কোন দিক দিয়ে ঐতিহাসিক পটভূমিকার কিঞ্চিৎ সম্পর্ক আছে বলে কাব্য-কাহিনিটি নিতান্ত কল্পলোকের কাহিনি হয়ে ওঠে নি। বর্ণনা স্থানের নাম ধাম পরিচয়, আচার, ব্যবহার, জীবন চিত্র, সমাজ পরিবেশ প্রভৃতি সমস্তই রাঢ় অঞ্চলের। এখনও এর কিছু কিছু বজায় আছে। ধর্মপাল, ইছাই ঘোষ (ঈশ্বরী ঘোষ), ঢেকুর গড় (ঢেক্করী বিষয়) এ সমস্ত নাম ধাম পালযুগের ইতিহাস খুঁজলে সহজেই পাওয়া যাবে। তাই ধর্মমঙ্গল কাহিনীর পশ্চাতে কেউ কেউ ইতিহাসের সূত্র নির্দেশ করেছেন। মধ্যযুগে যেমন মারাঠী, গুজরাটী, হিন্দী সাহিত্যে ঐতিহাসিক বীররসের কাহিনী নিয়ে উৎকৃষ্ট কাব্য রচিত হয়েছিল, তেমনি ধর্ম মঙ্গলকাব্যের আখ্যান ও ইতিহাসের সঙ্গে এর বিশেষ যোগ থাকা স্বাভাবিক।

লাউসেনের কাহিনির পশ্চাতে কোন স্থানীয় ঘটনার কিছু ছায়াপাত অবশ্যই আছে। কারণ সমস্ত ধর্মমঙ্গল কাব্যে লাউসেনের কাহিনীর ছাঁদটি প্রায়ই এক প্রকার। স্থানীয় সুপরিচিত ঘটনা যখন সাহিত্যে স্থান পায় তখন তাতে কিছু সত্য থেকে যায়। লাউসেনের বীরত্ব-ব্যঞ্জক গল্প কাহিনিটি সে দিক দিয়ে স্থানীয় সত্য ঘটনার উপর বোধ হয় নির্ভর করেছিল। তবে একথাও বলা আবশ্যক যে, কোন একটা সাদৃশ্য দেখা গেলেই তাকে সত্য ঘটনা হিসাবে আখ্যাত করা যায় না, কারণ এমনও হতে পারে, পাঁচ ছয় শত বছরের পূর্ববর্তী ঐতিহাসিক ঘটনা লোকজীবনের ভাবনা চিন্তার মধ্য দিয়ে পরিশ্রুত ও পল্লবিত হয়ে এসেছে। তবে রাঢ়ে। ইতিহাসের ঘটনার সঙ্গে ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনি যে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ধর্মমঙ্গল কাব্যের পটভূমিকা হচ্ছে পালযুগের গৌরবময় ইতিহাস—যখন ধর্মপালের পুত্র গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তবে কোন ধর্ম-মঙ্গলেই ধর্মপালের পুত্রের নাম উল্লিখিত হয়নি। ধর্মপালের পুত্র দেব পাল উৎকল ও কামরূপের রাজাদের পরাজিত করেন। লাউসেনও কামরূপরাজকে পরাজিত করে তাঁর কন্যা কলিঙ্গকে বিবাহ করেছিলেন। এ ঘটনা ধর্ম মঙ্গলকাব্যে আছে বটে, কিন্তু কলিঙ্গ জয়ের কোন উল্লেখ নেই। এমন হতে পারে যে, দেব পালের কোন সামন্ত অথবা তাঁর খুড়তুত ভাই জয়পাল কামরূপ ও কলিঙ্গ জয় করেছিলেন। কালক্রমে সেই কাহিনি লাউসেন নামক কোন কল্পিত চরিত্রের উপর অর্পিত হয়েছে কলিঙ্গা নামটি কলিগদেশীয় রাজকন্যাকেই বুঝিয়েছে।

এবারে আসা যাক, ধর্মমঙ্গলের ইছাই ঘোষের কথায়। তিনি গৌড়েশ্বরের সামস্ত ছিলেন এবং ঢেকুর গড়ে রাজত্ব করতেন। ঢেক্করী বিষয়ের শাসক ঈশ্বর ঘোষের নামের সঙ্গে ইছাই ঘোষের নামের সাদৃশ্য পাওয়া যায়, এবং ঈশ্বরী ঘোষের পিতা ধবল ঘোষের সঙ্গে ধর্মমঙ্গলের ইছাই ঘোষের পিতা সোম ঘোষকে অভিন্ন ব্যক্তি বলে অনেকেই অনুমান করেন।

অজয় নদের তীরে কেন্দুবিল্বের পূর্ব দিকে শ্যামরূপার গড় বলে একটি বিশাল অরণ্য আছে। স্থানীয় প্রবাদ অনুসারে এটাই ঢেকুর গড় বা ত্রিষষ্ঠীগড়— ইছাই এর রাজধানী। এই অরণ্যে ইছাই প্রতিষ্ঠিত ভবানীর ভগ্ন মন্দির এখনও আছে। এর নিকটেই নাকি কর্ণ সেনের রাজধানী কর্ণগড় ছিল। পশ্চিম বাংলার সীমান্তে বন্ধুর পার্বত্য অঞ্চলে সেন পাহাড়ী পরগণার অন্তর্ভুক্ত গৌরাণ্ডিতে ইছাইয়ের রাজধানী ছিল—এমন প্রবাদও আছে। কারণ ধর্মমঙ্গলে ইছাইয়ের রাজধানী পার্বত্য ও জঙ্গলবেষ্টিত বলে বর্ণিত আছে। যাইহোক ঢেক্করী অধিপতি ঈশ্বরী ঘোষ নামটি ধর্মমঙ্গলে ইছাই ঘোষ রূপে ব্যবহৃত হয়েছে।

ধর্মমঙ্গল কাব্যে ময়নাপুর বা ময়না নগরের উল্লেখ আছে—এই ময়না নগরেই লাউ সেনের রাজধানী ছিল। ময়নাপুর গ্রাম বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে ১২/১৩ মাইল দূরে এখনও আছে, এখানে ধর্ম ঠাকুরের আধিপত্য, ধর্মের মন্দিরও আছে। ধর্ম শিলাটি সিদ্ধি রায় নামে এখনো পুজিত হয়। এখানে একটি দীঘি আছে, তার নাম হা-কন্দ দীঘি। এর পাড়ের উপর লাল পাথরের মন্দিরটি হাকন্দ মন্দির নামে পরিচিত। তবে এই হা-কন্দ মন্দিরের ধর্মশিলা এখন শিবলিঙ্গে পরিণত হয়েছে। বসন্ত কুমারের মতে বিষ্ণুপুরের এই ময়নাপুরই ধর্ম মঙ্গলকাব্যের ময়না নগর—তথা লাউসেনের রাজধানী, হাকন্দ দীঘি ও হাকন্দ মন্দির তারই জ্বাজ্জ্বল্য প্রমাণ।

যাই হোক এই সমস্ত নাম ধাম, ঐতিহাসিক উপাখ্যান ও লোক শ্রুতি অনুসরণ করে লাউসেনকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি এবং ধর্মমঙ্গলের কাহিনীকে যথার্থ ঘটনা বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। রাঢ় দেশে প্রচলিত নানা যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনীর সঙ্গে ধর্মপূজার প্রভাব জড়িয়ে গিয়ে লাউসেনের আখ্যান গড়ে উঠেছে। এতে কিছু কিছু ভৌগোলিক নাম-ধামও আছে। যেমন—বল্লুকা, চাঁপাই, ময়না ঠাকুর গড় ইত্যাদি। এইসমস্ত বিচার বিশ্লেষণ করে বিশিষ্ট সমালোচকগণ ধর্মমঙ্গল কাব্যখানি রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য হিসাবে আখ্যাত করেছেন।

পরিশেষে একটা কথা না বলে উপায় নেই, ধর্মমঙ্গল কাব্যকে রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য হিসাবে আমরা যতই চিহ্নিত করিনা কেন, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে। প্রথমত এই কাব্য ধারা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাসে অবাচীন। দ্বিতীয়ত ব্ৰায়ণ বা উচ্চবর্ণের সমাজেও পরে ধর্ম-উপাসনা কথতি গৃহীত হলেও জাতীয় মহাকাব্য বলতে সমগ্র জাতির অন্তরে বাইরে যেভাবে কাহিনিটি ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়া উচিত, ধর্মমঙ্গলের কাহিনী ঠিক সেভাবে রাঢ়ের ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণের সমাজে গৃহীত হয়নি। এই সমাজে বৈব সংস্কৃতি, শক্তি আদর্শ, রামায়ণ, মহাভারত ও পুরানাদির যেরূপ প্রভাব, ধর্ম মঙ্গলের সেরূপ প্রভাব নেই।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading