তিনি “সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী” কাব্য রচনা করে বাংলার শক্তিমান কবিদের মাঝে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন। বাংলা কাব্যে ধর্মনিরপেক্ষ প্রণয়কাহিনীর তিনি পথিকৃৎ।
সপ্তদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রাম-আরাকানে দুজন শক্তিমান মুসলমান কবির আবির্ভাব ঘটেছিল—বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যাদের অবদান যথেষ্ট। এঁরা হলেন দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল। এই কবিরা ধর্মনিরপেক্ষ দেবভাবনামুক্ত অবিমিশ্র মানবিক চেতনার জয়গান গেয়েছেন—যা মধ্যযুগের গতানুগতিক ধারা থেকে স্বতন্ত্র। ব্রহ্মদেশের নিম্নভাগের সংলগ্ন অঞ্চল ছিল আরাকান। এখানকার অধিবাসীরা ছিলেন মগ। রাজাও ছিলেন মগ জাতীয় বৌদ্ধ। এই রাজাদের উৎসাহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় কবিরা কাব্য রচনা করেছিলেন।
দৌলত কাজির কবি পরিচয় :
কবি চট্টগ্রামের অন্তর্গত সুলতানপুর গ্রামে সুফি মতাবলম্বী মুসলমান পরিবারে আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন। আরাকানরাজ থিরি-থু-ধম্মা অর্থাৎ শ্রীধর্মার তিনি ছিলেন রাজসভা কবি। এই রাজার সমরসচিব ছিলেন আশরফ খান। তাঁর অনুগ্রহে, পৃষ্ঠপোষকতায় ও নির্দেশে কবি তার একমাত্র কাবা লোরচন্দ্রানী’ রচনায় হাত দেন। কবি তার কাব্যটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি, তার আগেই তিনি লোকান্তরিত হন। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে আরাকানরাজ সাদ-থু-ধম্মা অর্থাৎ চন্দ্র সুধর্মার নির্দেশে সপ্তদশ শতকের শ্রেষ্ঠ মুসলমান কবি আলাওল কাব্যটি সম্পূর্ণ করেন।
দৌলত কাজির কাব্য পরিচয় :
আরাকান রাজসভার শ্রেষ্ঠ কবি দৌলত কাজীর কাব্যের নাম লোরচন্দ্রানী বা ‘সতীময়না’। দৌলত কাজীর এই কাব্য মধ্যযুগের গতানুগতিক কাব্যধারার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এই কারণে যে, কাব্যখানি দেবদেবীর মহিমাজ্ঞাপক কাব্য নয়, তা মর্ত্য মানব-মানবীর ঘরোয়া জীবনালেখ্য ও প্রেমকথার লোককাব্য।
(a) মিঞা সাধনের গুজরাটি গোহারি ঠেট ভাষায় লেখা ‘মৈনা কো সৎ’।
(b) মুল্লা দাউদের লেখা ‘চন্দায়ন’ কাব্য।
(c) লোরক-চন্দ্রানী বা লোর চন্দ্রানী নামক লোককথা বা লোকগাথা।
(d) এটি একটি রোমান্টিক প্রেমের কাহিনী ।
(e) কাব্যটির মাত্র তিনভাগের দু’ভাগ লেখেন তিনি।
(f) এই কাব্যের প্রধান চরিত্র – লোরক, ময়না, চন্দ্রাবতী, বামন ।
কাব্য রচনার কাল নির্ণয়ঃ
রাজা শ্রীধর্মার রাজত্বকাল ছিল ১৬২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মনে করা হয় এই সময়ে অর্থাৎ ১৬২১-১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই এই কাব্য রচিত ।
দৌলত কাজির কাব্য কাহিনীঃ
‘লোরচন্দ্রানী’ বা ‘সতী ময়নামতী’র কাহিনী : গোহারী দেশের রাজা মোহরার সুন্দরী কন্যা চন্দ্রানীর সঙ্গে এক বামনের বিয়ে হয় । এ বিয়ে সুখের হয় নি। কারণ বামন ছিল নপুংসক। এরপর রাজা লোরকে-র (লোর) সঙ্গে সাক্ষাতের পর চন্দ্রানী ও লোর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। লোরের ময়নামতী নামে আর এক স্ত্রী ছিল। কিন্তু লোর সেই স্ত্রীকে ছেড়ে চন্দ্রানীকে নিয়ে পালিয়ে যান। পথে নপুংসক বামন তাঁকে আক্রমণ করতে এলে লোর তাকে বধ করেন এবং রাজা মোহরার অনুরোধে গোহারী রাজ্যের রাজা হয়ে বসেন। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর তিনি প্রথমা পত্নী সাধ্বী ময়নাকে ভুলে গেলেন। ময়না এদিকে পতিবিরহে দুঃখে কষ্টে কাল কাটাতে লাগলেন। ইতিমধ্যে ছাতন নামক এক লম্পট রাজকুমার ময়নাকে পাওয়ার জন্য রক্তনা নামে এক কুটনীকে কু-প্রস্তাব দিয়ে ময়নার কাছে পাঠিয়ে দেয়। রক্তনা তাকে নানা প্রলোভনের মাধ্যমে ছাতনের প্রতি আকৃষ্ট করবার জন্য অনেক চেষ্টা করল কিন্তু প্রতিবারই সতী ময়না তার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। রক্তনা বারো মাসের যৌবন সুখের বর্ণনা দেয়। এই পর্যন্ত দৌলত কাজীর লেখা।
‘সতী ময়না’ কাব্যের গুরুত্বঃ
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দৈবী পরিমণ্ডলের মধ্যে দৌলতকাজীর কাব্যটি ব্যতিক্রমে উজ্জ্বল । এই কাবো বাস্তব নরনারীর যে প্রণয়কথা ও সুখদুঃখের চিত্র চিত্রিত তাতে বাংলা কাব্যে গতানুগতিকতার মধ্যে নূতন জীবনচেতনার আদর্শসুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
দৌলত কাজীর কবি প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
দৌলত কাজীর দুটি কবিপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য হল –
ক) দৌলতকাজীই মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মর্ত্য-জীবন রসের কবি ।
খ) অনুভূতির গভীরতায় মানব চরিত্রের সার্থক রূপায়ণে প্রেমের মুক্ত মহিমা প্রচারে ও সরস রচনারীতিতে দৌলতকাজীর রচনা শিল্প সৌকর্ষমণ্ডিত ।
কৃতিত্বঃ
(i) এই প্রথম দেবদেবীর কাহিনির পরিবর্তে মানব-মানবীর প্রণয় কাহিনি বাংলা সাহিত্যে স্থান লাভ করে—তার প্রধান পুরোহিত ছিলেন দৌলত কাজী।
(ii) মুসলমান বিদ্বজ্জন আরবি, ফারসির চর্চার ক্ষেত্রে থেকে সরে এসে এই প্রথম তারা বাঙলা ভাষার সৃষ্টিক্ষেত্রে প্রবেশ করল।
(iii) দেবদেবীর কাহিনি অপেক্ষা লোককাহিনির রোমান্স রস সৃষ্টিতে দৌলত কাজীর অভিনবত্ব স্মরণীয়। যাকে যথার্থ মানব চরিত্র বলে তা দৌলত কাজীর পুর্বে তেমন ছিল না।
(iv) দৌলত কাজী-ই প্রথম শক্তিশালী বাঙালি মুসলমান কবি; ‘লোরচন্দ্রানী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ধর্মসংস্কার মুক্ত মানবীয় প্রণয়কাব্য।
(v) দৌলত কাজীর রচনায় সুফি ও হিন্দু আধ্যাত্মিক সাধনার স্বাভাবিক সম্মেলন সহজ হয়ে ওঠে।