দেবী গল্পের বিষয়বস্তু ও নাম করনের সার্থকতা বিচার কর ?

Table of Contents

দেবী গল্পের বিষয়বস্তু ও নাম করনের সার্থকতা

প্রভাত-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রত্ন ‘দেবী’ গল্পটি। গল্পটির পরিকল্পনায় লেখক রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী। শ্বশুর কালীকিঙ্করের স্বপ্নাদেশের বিশ্বাসে মানবী দয়াময়ীর দেবীত্বে রূপায়ণ হয়। অবশেষে দেবীর আত্মহত্যায় কাহিনীর যবনিকাপাত ঘটে। এই গল্প অশ্রুভারাতুর মানবরসে হৃদয়গ্রাহী। এখানে যে কোন মহৎ ছোটগল্পের মতো শুধু দশচক্রে মোহগ্রস্ত একটি নারীর ভয়াবহ পরিসমাপ্তিই দেখানো হয়নি, এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘ধর্মের সঙ্গে ধর্মতন্ত্রের’ বিরোধে প্রাণের বিনাশ ঘটার সতর্ক উপদেশও মূর্ত হয়েছে। এখানে প্রভাতকুমারের শিল্প-প্রতিভা নিজের শাস্ত, সরস ও সজল কল্পনার সীমা অতিক্রম করে উচ্চাঙ্গের কবিত্ব ও দার্শনিকতার পরিচয় দিয়েছে। গল্পটির সাফল্য এটাই প্রমাণ করে যে, আর একটু আত্মস্থ এবং সাধননিষ্ঠ হতে পারলেই তার যে হাত জলতরঙ্গ বাজাতে অভ্যস্ত, তা মৃদঙ্গে ধ্রুপদী বোল তুলতে পারত।

বিষয়গত প্রমূল্যে ‘কাশীবাসিনী’ গল্পটির গুরুত্ব নিঃসন্দেহে স্বীকার্য। যৌবনে প্রকৃতির তাড়নায় স্বাভাবিক পথ থেকে বিচ্যুত বিধবার পতিতা জীবনযাপন সমাজ সম্মত না হোক, তার হৃদয়ের স্নেহ-ভালবাসার উদ্ভব যে জীবনসঙ্গত—এই সহজ সত্য এ গল্পের উপজীব্য। বস্তুতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের ক্ষীরোদা, শরৎচন্দ্রের চন্দ্রমুখী রাজলক্ষী ইত্যাদি কিংবা শ-এর ভিভি ওয়ারেন, হেলিহির জোয়ানিতা প্রমুখ পতিতা নারী সমাজ ও সংস্কারের আঘাতে অভিঘাতে যেভাবে জর্জরিত হয়েছে, প্রতিবাদে মুখর হয়েছে প্রভাতকুমারের রূপকারী-বিবেক কিন্তু ঠিক সেই বোধে উদ্বুদ্ধ হয়নি। তাই দেখা যায় পতিতা প্রসঙ্গের কোন স্মৃতিরতি নয়, সন্তানম্নেহের সুগভীর আকর্ষণ ‘কাশীবাসিনী’ গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। উপস্থাপনার কৌশল এ গল্পের দ্বিতীয় আকর্ষণ : “মালতীর এবার একটু একটু কান্না পাইতে লাগিল। কঁাদ কাঁদ হইয়া বলিল, ‘কেন তুমি জানালে তুমি কে’?”

“কি জানি। থাকতে পারলাম না।” “মালতী আবেগভরে একবার বলিতে যাইতেছিল জানিয়েছ ভালই করেছ। নইলে মা ত কখনো চক্ষে দেখিতে পেতাম না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে হইল এ মা! নাই দেখতাম।”

গল্পের শেষে পদস্খলিতা মায়ের এই সংক্ষিপ্ত জবাব, মেয়ের দ্বিধা এবং প্রবল আবেগের এই আশ্চর্য রূপায়ণে গল্পকারের ভাবাবেগ সংযম প্রায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংযমী-রীতিকে যেন চকিতে স্মরণ করিয়ে দেয়। কাশীবাসিনীর শান্ত নিরুত্তাপ স্বভাব তার সংযমী বাচনভঙ্গীর মধ্য দিয়ে সস্তানপ্রীতি প্রকাশিত। আসলে ব্যভিচারিণী মায়ের মনে সংসারের আর পাঁচজন গৃহিণীর মতো স্নেহক্ষুধা দেখবার এবং দেখাবার চেতনাতেই প্রভাতকুমারের এ গল্প সৃষ্টি। সেই জননীকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তিনি তত আগ্রহী নন। তাঁর ‘দুধ-মা’ গল্পে ফুলটুসিয়ার মধ্যেও একই পরিচয় স্পষ্টরেখ। কিন্তু পাদ্রীপুত্র জোসেফের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের ফলে জাত সেই শিশুপুত্রকে ডাক্তার এবং বিভাবতীর সাহচর্যে (এবং ফুলটুসিয়ার স্তন্যদানে) রেখেও সেই শিশুর বসন্তরোগে মৃত্যু ঘটিয়ে তবে গল্পকার নিশ্চিন্ত হয়েছেন সর্ব সমস্যার সমাধানে। আকস্মিকের বিস্ময়বোধে গল্পের ইতি। তুলামূলকভাবে ‘হীরালাল’ গল্পটি অধিকতর নির্মম। এই গল্পের বিষয়— অবৈধ সম্পর্কের প্রতি আকর্ষণে, স্ত্রী নীরদার বিষপ্রয়োগে স্বামী বিনোদলালকে হত্যার চেষ্টা এবং পরিণামে হীরালাল ডোমের চক্রাস্তে শাস্তি প্রাপ্তি। নারীর পাতিব্রত্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধেই প্রভাতকুমার ছিলেন মুগ্ধপ্রাণ। তার পরিচয় তার ‘নবীন সন্ন্যাসী’ (গোপী বাবুর স্ত্রী) ‘রত্নদ্বীপ’ (রাখালের স্ত্রী), ‘সতীর পতি’ (সুরবালা) প্রভৃতি উপন্যাসে তো বটেই তাঁর অনেক গল্পেও (যেমন ‘নূতন বউ’তে নির্মলা, ‘বি. এ. পাশ কয়েদী’তে মোক্ষদায়, ‘ভুলভাঙ্গা’ হরিপ্রিয়া ইত্যাদি) নারীর পতির প্রতি আনুগত্যে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আলোচ্য গল্পটি বিপরীত মনোভঙ্গীতে উপস্থাপিত। সেইজন্য অনেকে এমন কথাও বলেছেন যে এ গল্প শৈলজানন্দ বা জগদীশ গুপ্তের মতো লেখকের কাছেই প্রত্যাশিত ছিল। হীরু ডোমের কাছ থেকে নীরদার বিষ কেনার ছলনাটুকু চমক জাগায়। বঙ্কিমের হীরা চরিত্রের ঘনিষ্ঠ স্মৃতি স্মরণে আসে। গল্পে আছে— “শেয়ালের বড় উপদ্রব হয়েছে। বুঝেছো। রান্নাঘরের বেড়া ফাক করে, রোজ রাত্রে শেয়াল ঘরে ঢুকে, আমার হাঁড়ি খেয়ে যায়। দুটো শেয়াল মরে, এই রকম খানিকটা বিষ তুমি আমায় দিতে পার?” শুধু হীরা নয় রবীন্দ্রনাথের ‘বৌঠাকুরাণী হাটে’র মঙ্গলার মধ্যেও বিষ কেনার উপলক্ষে ছিল একই যুক্তি। তবু ‘হীরালাল’ গল্পটির মধ্যে লক্ষণীয় বিশেষত্ব হল, গল্পকারের শোধনী মনোভঙ্গীর বদলে একটি চাপা সহানুভূতির লক্ষ্য প্রকাশ। তাই ব্যভিচারিণী স্ত্রীর স্বরূপ অবগত হয়ে বিনোদের বিয়ে করার খবর যেমন গল্পকার জানাতে ভোলেননি, তেমনি হীরু ডোম নীরদাকে গভীর রাতে গ্রামছাড়া ক’রে কলকাতায় রেখে আসতে গিয়ে বলে—“তোমাদের দলের লোক সেখানে ঢের আছে, তারা যেমন খায় তুমিও সেইরকম করে খাবে।” প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, অগ্রজ লেখক ত্রৈলোক্যনাথ যখন তাঁর ‘রূপসী হিরণ্ময়ী’ গল্পে পতিঘাতিকা সুন্দরী হিরণ্ময়ীকে নারকীয় ব্যাধিতে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে শেষে তার মৃত্যুদণ্ড উচ্চারণ করেছেন, সেখানে প্রভাতকুমার নীরদাকে পতিতালয়ে নির্বাসন দিয়েও তার অন্নবস্ত্রের যে অভাব হবে না সেকথা ইঙ্গিতে জানিয়ে পাঠককে আশ্বস্ত করেছেন। আবার ‘জামাতা বাবাজী’র অন্তর্ভুক্ত ‘মাতঙ্গিনী কাহিনী’ যেমন ‘হীরালাল’ গল্পটির উৎস, তেমনি ত্রৈলোক্যনাথও ‘বাঙ্গাল নিধিরাম’ গল্পটির উপসংহার-রূপে ‘রূপসী হিরণ্ময়ী’ গল্পটি লেখেন।

আরো পড়ুন,

‘স্টোভ’ গল্পে শশিভূষণের চরিত্র আলোচনা করো।

‘নিমগাছ’ গল্পটি কোন গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত? নিমগাছের প্রতীকে গল্পকার যে সমাজচিত্র তুলে ধরেছেন তা বুঝিয়ে দাও।

‘রস’ গল্প অবলম্বনে মাজু খাতুনের চরিত্রটি আলোচনা করো।

‘পাড়ি’ গল্পটি রচনার প্রেক্ষাপট বুঝিয়ে দাও।

‘পুঁইমাচা’ গল্পে প্রতিফলিত সমাজচিত্র আলোচনা করো।

‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে হাস্যরস নির্মাণে গল্পকারের কৃতিত্ব আলোচনা করো।

‘মৌরীফুল’ গল্পে প্রকৃতি ও মানবের মেলবন্ধন কীভাবে ঘটেছে বুঝিয়ে দাও।

‘ছিন্নমস্তা’ গল্পে একটি পুরুষ চরিত্রকে ঘিরে মাতা ও বধূর যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছবি প্রকাশিত হয়েছে তার পরিচয় দাও।

‘আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা’ গল্পের নামকরণের তাৎপর্য আলোচনা করো।

‘আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা’ গল্পের নামকরণের তাৎপর্য আলোচনা করো।

‘পুঁইমাচা’ গল্পটি নামকরণের সার্থকতা বিচার কর ?

“ রস ” গল্পের নামকরণ সার্থকতা বিচার কর ?

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের দেবী গল্পের বিষয়বস্তু ?

দেবী গল্পের বিষয়বস্তু ও নাম করনের সার্থকতা বিচার কর ?

রবীন্দ্রনাথ ও প্রভাতকুমারের মধ্যে তুলনা কর ?

‘দেবী’ গল্পের মূল চরিত্রের পরিণতির জন্য কোন কোন ঘটনা দায়ী উল্লেখ করো।

Share
error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading