দীনবন্ধু মিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ‘নীলদর্পণ’। নাটকের নাম থেকেই বোঝা যায়, এনাট্যকার একটি দর্পণের প্রতিবিম্ব আঁকার চেষ্টা করেছেন। সে প্রতিবিম্ব হল নীলচাষের
অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরা, নীল চাষের ইতিহাসকে পরিস্ফুটিত করা। উনিশ শতকে ও তার আগে নীলকরগণ বাঙালিদের নীলচাষ করতে বাধ্য করলেন। প্রতিবাদী মানুষ প্রাণ হারাল, নারী ধর্ষিত হল। এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডিকে সামনে রেখে দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন ‘নীলদর্পণ’ নাটক। সমালোচক সুশীলকুমার দে লিখেছেন-“যে সামাজিক উত্তেজনা ও উদ্দেশ্য এই নাটকটিকে প্রেরিত করিয়াছিল তাহার বিস্তৃত উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন, কারণ তাহা ছিল ইহার উপকরণ ও উপলক্ষমাত্র। নীলদর্পণ কেবল নীলকরদের সাময়িক উৎপীড়নের কাহিনী নয়: ইহার মধ্যে বাংলার দীন দুঃখীর প্রাত্যহিক পল্লী জীবনের যে নিখুঁত করুণ চিত্র বাস্তব অনুভূতি ও সমবেদনায় জীবন্তভাবে প্রতিফলিত হইয়াছে…।”
নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গোলক বসুর পরিবার। নীলকরগণ এই বসু পরিবারকে নীলচাষ করতে বাধ্য করেছে। গোলক বসু প্রথমে নীলচাষ করলেও নীলকরগণ প্রদত্ত অর্থ প্রদান করেনি। ফলে এবছর তিনি নীলচাষ করতে অস্বীকার করেছেন। এবার নীলকরগণ আবার পুষ্করিণীর পাড়ে চাষ দিয়েছে। নীলকররা জানে, গ্রামের বিত্তবান চাষি গোলক বসুকে অত্যাচার করলেই সমস্ত কৃষক ভয় পাবে। ফলে নীল চাষ না-করায় গোলক বসুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অত্যাচারিত হয়েছে সে। শেষে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়েছে। নবীনমাধবসহ অনেকের মৃত্যু ঘটেছে। একটি পরিবারকে সামনে রেখে নাট্যকার নীলকরদের ভয়ংকর অত্যাচারকে দেখিয়েছেন। এমনকি ক্ষেত্রমণিকে ধর্ষিত হতে হয়েছে। প্রতিবাদ যে নেই তা নয়, কিন্তু নীলকরদের প্রবল অত্যাচারের সামনে তা সামান্য।
এ নাটকের ভূমিকায় নাট্যকার লিখেছিলেন-“নীলকরনিকরকরে নীলদর্পণ অর্পণ করিলাম। এক্ষণে তাঁহারা নিজ নিজ মুখ সন্দর্শনপূর্ব্বক তাঁহাদিগের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা-কলঙ্ক-তিলক বিমোচন করিয়া তৎপরিবর্তে পরোপকার শ্বেতচন্দন ধারণ করুন, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রমের সাফল্য, নিরাশ্রয় প্রজাব্রজের মঙ্গল এবং বিলাতের মুখ রক্ষা।” নীলচাষ ও তার অত্যাচারকে সামনে রেখে নাট্যকার কাহিনিকে সাজিয়েছেন। বাঙালি কৃষকরা কীভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল নীলকরদের দ্বারা তা নাট্যকার দেখিয়েছেন। সে অত্যাচার থেকে নারীও রক্ষা পায়নি। এ নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে নীলচাষ, নীলচাষের অত্যাচার ও বঙ্গীয় প্রজাগণের দুর্দশার চিত্র। তুরি সে চিত্র অঙ্কন করতেই লেখক ‘দর্পণ’ চিহ্নিত নাম নিয়েছেন। ফলে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের নাম সার্থক ও শিল্পসম্মত।