অথবা, উদাহরণসহ সংজ্ঞা দাওঃ অক্ষর, মাত্রা, যতি, পর্ব, লয়। ?
অথবা, ছন্দ কাকে বলে | ছন্দের উপকরণ | বাংলা ছন্দের প্রকারভেদ ও আলোচনা | ছন্দ নির্ণয়
অথবা, ছন্দ কাকে বলে?কত প্রকার ও কি কি? উদাহরণসহ আলোচনা কর
ছন্দ কাকে বলে?
কাব্যের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকে ছন্দ বলে।
ছন্দ বাংলা কাব্যের ভাষাকে সচল করে, গতি দেয়, প্রানচঞ্চল করে তােলে। মানুষের মনের আবেগ ভাষা ও ছন্দের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে তাকে স্পন্দিত ও রসঘন করে তােলে। বিশেষ করে কবিতার ভাব ও গতি বােঝার জন্য ছন্দ জানা ও পড়া ভীষণ জরুরি। বাংলা গদ্য ও পদ্য পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে ছন্দের কারণে। গদ্য-পদ্যের সৌন্দর্য-মাধুর্য সৃষ্টি করে ছন্দ। তাই ছন্দ পড়া ও জানা দুইই দরকার। যে কোন কবিতা পড়া ও বলার জন্য ছন্দের তাল ও লয়টি পাঠক কে জানতে হবে। ছন্দ কবিতার বাচ্যার্থের অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে কবিতাকে উৎকর্ষের চরম সীমায় পৌঁছে দেয়। ছন্দ তাই কবিতার ভূষণ, কবিতের সঙ্গে ছন্দের সম্পর্ক ঘনিস্ট। তাই যে বাক্যের শ্রুতিধ্বনির সঙ্গে অর্থ ধ্বনি সুসামঞ্জস্য হয় ,তার ছন্দ অত্যন্ত সরস ও সুন্দর হয়।
সাধারণ ভাবে ছন্দ বলতে আমরা বুঝি ‘কাব্যের রসঘন ও শ্রুতি মধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনি বিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকে ছন্দ বলে। ছন্দ সমস্ত কাব্য শিল্পের শ্রুতি গ্রাহ্য ধ্বনি সােন্দর্য।
ছন্দের উপকরণ:
অক্ষর :
বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোঁকে শব্দের যে অংশটুকু উচ্চারিত হয়, তাকে অক্ষর বা দল বলে।
যতি :
আমরা যখন কথা বলি তখন নিশ্চয়ই অনর্গল বলি না, কথা বলার মাঝে মাঝে থেমে যাই আর এই থেমে যাওয়া বোঝাতে যতি বা ছেদ চিহ্নের ব্যবহার করা হয়। কোনো কবিতা পড়ার সময় শ্বাসগ্রহণের সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে অন্তর অন্তর যে উচ্চারণ বিরতি নেওয়া হয়, তাকে ছন্দ-যতি বলে। কবিতার ছন্দের আদর্শের প্রতি লক্ষ্য রেখে যেখানে থামতে হয় তার নাম “যতি”।
যতি তিন প্রকার।যথা-
ক ) পূর্ণ যতি খ )মধ্যযতি গ ) লঘু বা হ্রস্ব যতি
উদাহরণ :-
নদীতীরে | বৃন্দাবনে || সনাতন |একমনে || জপিছেন | নাম ।।
এখানে সবশেষে আছে পূর্ণযতি , ‘বৃন্দাবনে’ ও ‘একমনে’র পরে পড়েছে অর্ধযতি , আর ‘নদীতীরে’, ‘ সনাতন’ ও ‘জপিছেন’ -এর পরে পড়েছে লঘুযতি।
পর্ব :
বাক্য বা পদের এক হ্রস্ব যতি হতে আরেক হ্রস্ব যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলা হয়। যেমন- একলা ছিলেম ∣ কুয়োর ধারে ∣ নিমের ছায়া ∣ তলে ∣∣ কলস নিয়ে ∣ সবাই তখন ∣ পাড়ায় গেছে ∣ চলে ∣∣ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ( ∣ – হ্রস্ব যতি ও ∣∣ – দীর্ঘ যতি) এখানে একলা ছিলেম, কুয়োর ধারে, নিমের ছায়া, তলে- প্রতিটিই একেকটি পর্ব; মানে প্রতিটি চরণে ৪টি করে পর্ব।
মাত্রা:
একটি অক্ষর উচ্চারণে যে সময় প্রয়োজন হয়, তাকে মাত্রা বলে। বাংলায় এই মাত্রাসংখ্যার নির্দিষ্ট নয়, একেক ছন্দে একেক অক্ষরের মাত্রাসংখ্যা একেক রকম হয়। মূলত, এই মাত্রার ভিন্নতাই বাংলা ছন্দগুলোর ভিত্তি। বিভিন্ন ছন্দে মাত্রাগণনার রীতি বিভিন্ন ছন্দের আলোচনায় দেয়া আছে।
শ্বাসাঘাত:
প্রায়ই বাংলা কবিতা পাঠ করার সময় পর্বের প্রথম অক্ষরের উপর একটা আলাদা জোর দিয়ে পড়তে হয়। এই অতিরিক্ত জোর দিয়ে পাঠ করা বা আবৃত্তি করাকেই বলা হয় শ্বাসাঘাত বা প্রস্বর। যেমন- আমরা আছি ∣ হাজার বছর ∣ ঘুমের ঘোরের ∣
পদ ও চরণ : দীর্ঘ যতি বা পূর্ণ যতি ছাড়াও এই দুই যতির মধ্যবর্তী বিরতির জন্য মধ্যযতি ব্যবহৃত হয় । দুই দীর্ঘ যতির মধ্যবর্তী অংশকে চরণ বলে, আর মধ্য যতি দ্বারা চরণকে বিভক্ত করা হলে সেই অংশগুলোকে বলা হয় পদ। যেমন- তরুতলে আছি ∣ একেলা পড়িয়া ⊥
পর্ব ও পৰ্বাঙ্গঃহ্রস্ব:
যতির দ্বারা নির্দিষ্ট খণ্ডিত ধ্বনিপ্রবাহকে পর্ব বলে। যেমন- রাত পােহাল। ফর্সা হল। ফুটল কত ফুল। ‘রাত পােহাল’, ‘ফর্সা হল’, ‘ফুটল কত’, ‘ফুল’,— এই গুলি এক একটি পর্ব। কবিতা পাঠের সময় তার প্রতিটি পর্বে কণ্ঠস্বরের যে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে, যাতে পর্বে যে দুটি বা তিনটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগ অস্পষ্ট অনুভূত হয়, তাদের এক একটি পৰ্বাঙ্গ বলে। যেমন — রাতপাে । হাল । ফুটল । কত । ফুল। এখানে ১ম পর্ব – ‘রাত পােহাল’ পড়ছি ‘রাতপাে’, ‘হাল’। ‘রাতপাে’ বলেই কণ্ঠস্বর হ্রাস পাচ্ছে। তাই রাতপাে পর্বের একটি অঙ্গ।
পর্ব তিন প্রকার —( ১) পূর্ণ পর্ব (২) প্রান্তিক পর্ব (৩) অতি পর্ব।
মাত্রা:
একটি অক্ষর বা দল উচ্চারণে যে সময়ের প্রয়ােজন হয়, তাকে মাত্রা বা কলা বলে।
শ্বাসাঘাত: কোন কোন চরণের এক একটি পর্বে আদি অক্ষরের উপর যে সুস্পষ্ট জোর বা বল দেওয়া হয়, তাকে শ্বাসাঘাত বলে।
লয়: কবিতা পাঠের সময় পঠনের গতিভঙ্গি থেকে যে সুরের সৃষ্টি হয়, তাকে লয় বলে।
পদ ও চরণ: মধ্য যতির দ্বারা বিছিন্ন ও পর্ব থেকে বৃহত্তর বাক্যাংশকে পদ বলে। পূর্ণ যতির দ্বারা নির্দিষ্ট ধ্বনিপ্রবাহকে চরণ বলে। চরণমাত্রই এক বা একাধিক পর্ব থাকে।
স্তবক: কবিতায় চরণগুচ্ছ লইয়া যে সুশৃঙ্খল ছন্দগ্রন্থি রচিত হয়, তাকে স্তবক বলে।
মিল:
একাধিক পর্ব বা পদ বা চরণের অন্তিম ধ্বনিসাম্যকে মিল বলে।
বাংলা ছন্দের প্রকারভেদ :
বাংলা কবিতার ছন্দ মূলত ৩টি- স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ।
তবে বিংশ শতক থেকে কবিরা গদ্যছন্দেও কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। এই ছন্দে সেই সুশৃঙ্খল বিন্যাস না থাকলেও ধ্বনিমাধুর্যটুকু অটুট রয়ে গেছে, যে মাধুর্যের কারণে ধ্বনিবিন্যাস ছন্দে রূপায়িত হয়। নিচে সংক্ষেপে ছন্দ ৩টির বর্ণনা দেয়া হল।
স্বরবৃত্ত ছন্দ :
ছড়ায় বহুল ব্যবহৃত হয় বলে, এই ছন্দকে ছড়ার ছন্দও বলা হয়। • মূল পর্ব সবসময় ৪ মাত্রার হয় • প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষরে শ্বাসাঘাত পড়ে • সব অক্ষর ১ মাত্রা গুনতে হয় • দ্রুত লয় থাকে, মানে কবিতা আবৃত্তি করার সময় দ্রুত পড়তে হয়
উদাহরণ-
বাঁশ বাগানের ∣ মাথার উপর ∣ চাঁদ উঠেছে ∣ ওই ∣মাগো আমার ∣ শোলোক বলা ∣ কাজলা দিদি ∣ কই ∣ (যতীন্দ্রমোহন বাগচী)
এখানে প্রথম অক্ষরগুলো উচ্চারণের সময় শ্বাসাঘাত পড়ে, বা ঝোঁক দিয়ে পড়তে হয়। আর দাগাঙ্কিত অক্ষরগুলোতে মিল বা অনুপ্রাস পরিলক্ষিত হয়।
এরকম- রায় বেশে নাচ ∣ নাচের ঝোঁকে ∣ মাথায় মারলে ∣ গাঁট্টা ∣শ্বশুর কাঁদে ∣ মেয়ের শোকে ∣ বর হেসে কয় ∣ ঠাট্টা ∣(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ :
- মূল পর্ব ৪,৫,৬ বা ৭ মাত্রার হয় • অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা গুনতে হয়; আর অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে (য় থাকলেও) ২ মাত্রা গুনতে হয়; য় থাকলে, যেমন- হয়, কয়; য়-কে বলা যায় semi-vowel, পুরো স্বরধ্বনি নয়, তাই এটি অক্ষরের শেষে থাকলে মাত্রা ২ হয় • কবিতা আবৃত্তির গতি স্বরবৃত্ত ছন্দের চেয়ে ধীর, কিন্তু অক্ষরবৃত্তের চেয়ে দ্রুত
উদাহরণ-
এইখানে তোর ∣ দাদির কবর ∣ ডালিম-গাছের ∣ তলে ∣∣ (৬+৬+৬+২) তিরিশ বছর ∣ ভিজায়ে রেখেছি ∣ দুই নয়নের ∣ জলে ∣∣ (৬+৬+৬+২) (কবর; জসীমউদদীন) কবিতাটির মূল পর্ব ৬ মাত্রার। প্রতি চরণে তিনটি ৬ মাত্রার পূর্ণ পর্ব এবং একটি ২ মাত্রার অপূর্ণ পর্ব আছে। এখন মাত্রা গণনা করলে দেখা যাচ্ছে, প্রথম চরণের- প্রথম পর্ব- এইখানে তোর; এ+ই+খা+নে = ৪ মাত্রা (প্রতিটি অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকায় প্রতিটি ১ মাত্রা); তোর = ২ মাত্রা (অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকায় ২ মাত্রা) দ্বিতীয় পর্ব- দাদির কবর; দা+দির = ১+২ = ৩ মাত্রা; ক+বর = ১+২ = ৩ মাত্রা তৃতীয় পর্ব- ডালিম-গাছের; ডা+লিম = ১+২ = ৩ মাত্রা; গা+ছের = ১+২ = ৩ মাত্রা চতুর্থ পর্ব- তলে; ত+লে = ১+১ = ২ মাত্রা
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ :
- মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়
- অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা গুনতে হয়
- অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে, এমন অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা হয়; শব্দের শুরুতে বা মাঝে থাকলে ১ মাত্রা হয়
- কোন শব্দ এক অক্ষরের হলে, এবং সেই অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, সেই অক্ষরটির মাত্রা ২ হয়
- কোন সমাসবদ্ধ পদের শুরুতে যদি এমন অক্ষর থাকে, যার শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে, তবে সেই অক্ষরের মাত্রা ১ বা ২ হতে পারে
- কবিতা আবৃত্তির গতি ধীর হয় উদাহরণ- হে কবি, নীরব কেন ∣ ফাগুন যে এসেছে ধরায় ∣∣ (৮+১০) বসন্তে বরিয়া তুমি ∣ লবে না কি তব বন্দনায় ∣∣ (৮+১০) কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি- ∣∣ (১০) দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি? ∣∣ (১০) (তাহারেই পড়ে মনে; সুফিয়া কামাল) কবিতাটির মূল পর্ব ৮ ও ১০ মাত্রার। স্তবক দুইটি পর্বের হলেও এক পর্বেরও স্তবক আছে। এখন, মাত্রা গণনা করলে দেখা যায়, প্রথম চরণের, প্রথম পর্ব- হে কবি, নীরব কেন; হে কবি- হে+ক+বি = ৩ মাত্রা (তিনটি অক্ষরের প্রতিটির শেষে স্বরধ্বনি থাকায় প্রতিটি ১ মাত্রা); নীরব- নী+রব = ১+২ = ৩ মাত্রা (শব্দের শেষের অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকায় সেটি ২ মাত্রা); কেন- কে+ন = ১+১ = ২ মাত্রা; মোট ৮ মাত্রা আবার দ্বিতীয় চরণের, দ্বিতীয় পর্ব- লবে না কি তব বন্দনায়; লবে- ল+বে = ২ মাত্রা; না কি তব = না+কি+ত+ব = ৪ মাত্রা; বন্দনায়- বন+দ+নায় = ১+১+২ = ৪ মাত্রা (বন- অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলেও অক্ষরটি শব্দের শেষে না থাকায় এর মাত্রা ১ হবে; আবার নায়- অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি- য় থাকায়, এবং অক্ষরটি শব্দের শেষে থাকায় এর মাত্রা হবে ২); মোট ১০ মাত্রা এরকম- আসি তবে ∣ ধন্যবাদ ∣∣ (৪+৪) না না সে কি, ∣ প্রচুর খেয়েছি ∣∣ (৪+৬) আপ্যায়ন সমাদর ∣ যতটা পেয়েছি ∣∣ (৮+৬) ধারণাই ছিলো না আমার- ∣∣
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রকারভেদ :
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আবার অনেকগুলো রূপভেদ বা প্রকার আছে- পয়ার, মহাপয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী, দিগক্ষরা, একাবলী, সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ। নিচে এগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল-
সনেট : • বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন- মাইকেল মধুসূদন দত্ত
বাংলায় উল্লেখযোগ্য সনেট রচয়িতা- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, অক্ষয়কুমার বড়াল, ফররুখ আহমদ,কামিনী রায়, প্রমুখ
১৪ বা ১৮ মাত্রার চরণ হয়
দুই স্তবকে ১৪টি চরণ থাকে
সাধারণত দুই স্তবকে যথাক্রমে ৮টি ও ৬টি চরণ থাকে (চরণ বিন্যাসে ব্যতিক্রম থাকতে পারে)
প্রথম আটটি চরণের স্তবককে অষ্টক ও শেষ ৬টি চরণের স্তবককে ষটক বলে
এছাড়া সনেটের অন্ত্যমিল ও ভাবের মিল আছে এমন চারটি চরণকে একত্রে চৌপদী, তিনটি পদকে ত্রিপদীকা বলে
নির্দিষ্ট নিয়মে অন্ত্যমিল থাকে
দুইটি স্তবকে যথাক্রমে ভাবের বিকাশ ও পরিণতি থাকতে হয়; ব্যাপারটাকে সহজে ব্যাখ্যা করতে গেলে তা অনেকটা এভাবে বলা যায়- প্রথম স্তবকে কোন সমস্যা বা ভাবের কথা বলা হয়, আর দ্বিতীয় স্তবকে সেই সমস্যার সমাধান বা পরিণতি বর্ণনা করা হয়
সনেটের ভাষা মার্জিত এবং ভাব গভীর ও গম্ভীর হতে হয়
সনেট মূলত ৩ প্রকার- পেত্রার্কীয় সনেট, শেক্সপীয়রীয় সনেট ও ফরাসি সনেট; এই ৩ রীতির সনেটের প্রধান পার্থক্য অন্ত্যমিলে। এছাড়া ভাব, বিষয় ও স্তবকের বিভাজনেও কিছু পার্থক্য আছে (তা ব্যাকরণের ছন্দ প্রকরণের আলোচ্য নয়)। নিচে ৩ প্রকার সনেটের অন্ত্যমিলের পার্থক্য দেখান হল- পেত্রার্কীয় রীতিক+খ+খ+ক ক+খ+খ+কচ+ছ+জ চ+ছ+জ শেক্সপীয়রীয় রীতিক+খ+ক+খগ+ঘ+গ+ঘচ+ছ+চ+ছজ+জ ফরাসি রীতিক+খ+খ+ক ক+খ+খ+কগ+গ চ+ছ+চ+ছ উদাহরণ- হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব ∣ বিবিধ রতন;- ∣∣ (৮+৬) ক তা সবে, (অবোধ আমি!) ∣ অবহেলা করি, ∣∣ (৮+৬) খ পর-ধন-লোভে মত্ত, ∣ করিনু ভ্রমণ ∣∣ (৮+৬) ক পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি ∣ কুক্ষণে আচরি। ∣∣ (৮+৬) খ অষ্টক কাটাইনু বহু দিন ∣ সুখ পরিহরি। ∣∣ (৮+৬) খ অনিদ্রায়, অনাহারে ∣ সঁপি কায়, মনঃ, ∣∣ (৮+৬) ক মজিনু বিফল তপে ∣ অবরেণ্যে বরি;- ∣∣ (৮+৬) খ কেলিনু শৈবালে, ভুলি ∣ কমল-কানন। ∣∣ (৮+৬) ক স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী ∣ কয়ে দিলা পরে,- ∣∣ (৮+৬) গ ওরে বাছা, মাতৃকোষে ∣ রতনের রাজি ∣∣, (৮+৬) ঘ এ ভিখারী-দশা তবে ∣ কেন তোর আজি? ∣∣ (৮+৬) ঘ ষটক যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, ∣ যা রে ফিরি ঘরে। ∣∣ (৮+৬) গ পালিলাম আজ্ঞা সুখে; ∣ পাইলাম কালে ∣∣ (৮+৬) ঙ মাতৃভাষা-রূপ খনি, ∣ পূর্ণ মণিজালে । ∣∣। (৮+৬) ঙ (বঙ্গভাষা; মাইকেল মধুসূদন দত্ত) কবিতাটিতে দুই স্তবকে যথাক্রমে ৮ ও ৬ চরণ নিয়ে মোট ১৪টি চরণ আছে। প্রতিটি চরণে ৮ ও ৬ মাত্রার দুই পর্ব মিলে মোট ১৪ মাত্রা আছে।
অমিত্রাক্ষর ছন্দ:
বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন- মাইকেল মধুসূদন দত্ত
অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য ভাবের প্রবহমানতা; অর্থাৎ, এই ছন্দে ভাব চরণ-অনুসারী নয়, কবিকে একটি চরণে একটি নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশ করতেই হবে- তা নয়, বরং ভাব এক চরণ থেকে আরেক চরণে প্রবহমান এবং চরণের মাঝেও বাক্য শেষ হতে পারে
বিরামচিহ্নের স্বাধীনতা বা যেখানে যেই বিরামচিহ্ন প্রয়োজন, তা ব্যবহার করা এই ছন্দের একটি বৈশিষ্ট্য
অমিত্রাক্ষর ছন্দে অন্ত্যমিল থাকে না, বা চরণের শেষে কোন মিত্রাক্ষর বা মিল থাকে না
মিল না থাকলেও এই ছন্দে প্রতি চরণে মাত্রা সংখ্যা নির্দিষ্ট (সাধারণত ১৪) এবং পর্বেও মাত্রা সংখ্যা নির্দিষ্ট (সাধারণত ৮++৬) উদাহরণ- তথা জাগে রথ, রথী, গজ, ∣ অশ্ব, পদাতিক ∣∣ (৮+৬) অগণ্য। দেখিলা রাজা ∣ নগর বাহিরে, ∣∣ (৮+৬) রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ ∣ সিন্ধুতীরে যথা, ∣∣ (৮+৬) নক্ষত্র-মণ্ডল কিংবা ∣ আকাশ-মণ্ডলে। ∣∣ (৮+৬) (মেঘনাদবধকাব্য; মাইকেল মধুসূদন দত্ত) এখানে কোন চরণের শেষেই অন্ত্যমিল নেই। আবার প্রথম বাক্যটি চরণের শেষে সমাপ্ত না হয়ে প্রবাহিত হয়ে একটি চরণের শুরুতেই সমাপ্ত হয়েছে (তথা জাগে রথ, রথী, গজ, অশ্ব, পদাতিক অগণ্য)। এই অন্ত্যমিল না থাকা এবং ভাবের বা বাক্যের প্রবহমানতাই অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রধান দুইটি বৈশিষ্ট্য।
গদ্যছন্দ:
এই ছন্দে বাংলায় প্রথম যারা কবিতা লিখেছিলেন তাদের অন্যতম- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মূলত ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী শিল্পমুক্তির আন্দোলনের ফসল হিসেবে এর জন্ম
গদ্য ছন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- গদ্যের মধ্যে যখন পদ্যের রঙ ধরানো হয় তখন গদ্যকবিতার জন্ম হয়
পর্বগুলো নানা মাত্রার হয়, সাধারণত পর্ব-দৈর্ঘ্যে কোন ধরনের সমতা বা মিল থাকে না • পদ ও চরণ যতি দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং বিরাম চিহ্ন বা ছেদ চিহ্ন দ্বারা নির্ধারিত হয়; এই বিরাম চিহ্ন বা ছেদ চিহ্ন উচ্চারণের সুবিধার্থে নয়, বরং অর্থ প্রকাশের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হয়
গদ্যকবিতা গদ্যে লেখা হলেও তা পড়ার সময় এক ধরনের ছন্দ বা সুরের আভাস পাওয়া যায়