উনিশ শতকের কাব্য পরিক্রমায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবি প্রতিভার পরিচয় দাও। অথবা, ‘ছন্দের জাদুকর’ উপাধিতে কে ভূষিত? কে এই উপাধি দিয়েছিলেন? কবির দুটি কাব্যের নাম লেখো। কবির কবি প্রতিভার পরিচয় দাও।

‘ছন্দের জাদুকর’ উপাধিতে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ভূষিত। সত্যেন্দ্রনাথকে এই উপাধি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সত্যেন্দ্রনাথের কাব্যগুলি হল-‘সবিতা’, ‘সন্ধিক্ষণ’, ‘বেণু ও বীণা’, ‘হোমশিখা’ ও ‘তীর্ঘসলিল’।

ছন্দের জাদুকর বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী হয়ে বাংলা কাব্যজগতে প্রবেশ করেছিলেন। এক সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে তিনি কাব্যে প্রবেশ করেছিলেন। তাই তাঁর কাব্যচেতনায় রোমান্টিকতার সুর থাকলেও অন্তরালে ছিল স্বদেশচেতনা ও স্বদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা। সমাজ, স্বদেশ, সময়, রঙ্গব্যঙ্গ, শব্দের অবিরাম বর্ষণ নিয়ে তিনি এমন এক জগৎ তৈরি করেছিলেন, যা অনন্য। সত্যেন্দ্রনাথ স্বদেশি শিল্পের প্রসারে যেমন অগ্রণী ছিলেন, তেমনি বিদেশি বর্জনের পক্ষে ছিলেন। তাই কবিতায় উচ্চারিত হতে শুনি-

“নিত্য প্রাতে উচ্চারিব পণ

বাঁচাব দেশের শিল্প-দেশের জীবন।”

সত্যেন্দ্রনাথ জাতপাতের ঊর্ধ্বে এক মহান ভারতবর্ষের কল্পনা মনে মনে করেছিলেন। তাই নিম্নবর্গের জনজাতিকে তিনি কাছে টেনে নিয়েছেন। শুধু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র দ্বারা ভারতবর্ষের আদর্শ রূপ কখনোই গড়ে উঠতে পারে না। এ জন্যই তিনি সমস্ত জাতির শ্রেণিভেদ ভুলে গিয়ে এক মহান ভারতবর্ষের কল্পনা করেছিলেন, আর তা লিপিবদ্ধ করতে ভোলেননি কবিতায়। আবার শোষণের বিভেদ ভুলে গিয়ে সাম্যের বাণী রচনা করেছেন। সমস্ত মানুষেরই যে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তা তিনি মনে করিয়ে দেন-

“গাহ নির্ভয়ে সাম্যের গান-শিকল পড়ুক খসি

উচ্চে সবলে উচ্চারো ওগো সাম্যের মহাসাম,

করো কারাঘাত কারা-ভবনের দুয়ারে অবিশ্রাম।”

বস্তুত এই বলিষ্ঠ জীবনবোধ বুর্জোয়া মূল্যবোধপ্রসূত। ক্ল্যাসিক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এক রোমান্টিক ভাবকল্পনা। ফলে প্রকৃতির চিত্র ফুটিয়ে তুলতে তিনি যেমন দক্ষতা দেখিয়েছেন, তেমনি অতি সাধারণ বিষয়কে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘চম্পা’ কবিতার এক অতিসাধারণ ফুলকে সামনে রেখে কবি জীবন-সংগ্রামের এক অতলান্ত চিত্র এঁকেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ ছন্দ নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ফলে তাঁর কবিতায় বিবিধ সুর পাওয়া যায়। যেমন ‘পিয়ানোর গান’ কবিতায় শুনেছিলাম-“তুল -তুল/টুক টুক/তুল তুল/কোন্ ফুল/তার ভুল।” তেমনি শব্দ প্রয়োগেও তাঁর বিচক্ষণতা লক্ষ করা যায়। আসলে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন স্বতন্ত্র্য প্রতিভার অধিকারী। তাই রবীন্দ্র-সমকালে বসে, রবীন্দ্র অনুরাগী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ঝলসে যাননি। নিজেই নিজের পথ করে নিতে পেরেছিলেন। ফলে শব্দ প্রয়োগ, ব্যঞ্জনা, কুশলী শিল্পী, বিচিত্র জীবনবোধ দ্বারা তিনি রবীন্দ্রযুগে বসেও আধুনিকতার বার্তা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। এজন্য রবীন্দ্রনাথ সতেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে লিখেছিলেন-

“অন্ধকার নিশীথিনী তুমি, কবি, কাটাইলে জাগি জয়মাল্য বিরচিয়া, রেখে গেলে গানের পাথেয় বহ্নিতেজ পূর্ণ করি।”

উনিশ শতকের গীতিকবিতার ধারায় বিহারীলালের কবিপ্রতিভার পরিচয় দাও। চর যে কবিতায় কবি নিজের ব্যক্তি-হৃদয়ের কথা প্রকাশ করেন তা সাধারণভাবে গীতিকবিতা। এখানে কবি নিজের ব্যক্তি-হৃদয়ের অনুভূতির প্রকাশকেই বিশেষ প্রাধান্য দেন। বাংল। গীতিকবিতার ইতিহাসে ‘ভোরের পাখি’ হিসেবে পরিচিত কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-“বিহারীলাল তখনকার ইংরেজি ভাষায় নব্যশিক্ষিত কবিদিগের ন্যায় যুদ্ধবর্ণনা-সংকুল মহাকাব্য, উদ্দীপনাপূর্ণ দেশানুরাগমূলক কবিতা লিখিলেন না এবং পুরাতন কবিদিগের ন্যায় পৌরাণিক উপাখ্যানের দিকেও গেলেন না, তিনি নিভৃতে বসিয়া নিজের ছন্দে নিজের মনের কথা বলিলেন।” তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হল ‘বন্ধুবিয়োগ’, ‘নিসর্গ সন্দর্শন’, ‘বঙ্গসুন্দরী’, ‘সারদামঙ্গল’ ও ‘সাধের আসন’।

বিহারীলালের প্রথম রচনা ‘স্বপ্নদর্শন’ হলেও দ্বিতীয় কাব্য ‘সঙ্গীত শতক’ থেকেই তাঁর কবি প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ লক্ষ করা যায়। ‘সঙ্গীত শতক’ একশোটি গানের সংকলন। ‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্যে কবি বঙ্গনারীকে নানাভাবে চিত্রিত করেছেন। এইসব চিত্রণ বিহারীলালের একান্ত নিজস্ব। ফলে মধ্যযুগ ও মহাকাব্যের নারী থেকে স্পষ্ট পৃথক অবস্থান এখানে লক্ষ করা যায়। সুরবালার যে মূর্তি আমরা পাই তা বেশ জীবন্তভাবে পাঠককে নাড়া দেয়-

“মধুর তোমার ললিত আকার

মধুর তোমার চাঁচর কেশ মধুর তোমার পারিজাত হার

মধুর তোমার মনের বেশ!”

‘বন্ধুবিয়োগ’ কাব্যে তিনি চার বন্ধুর বিয়োগব্যথাকে স্মরণ করেছেন। ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ কাব্যে প্রকৃতির এক নিবিড় চিত্র অঙ্কনে অগ্রসর হয়েছেন। তবে সেই প্রকৃতির মধ্যে প্রেম, প্রকৃতি এনে তিনি এক অনবদ্য ক্যানভাস অঙ্কন করেছেন।

বিহারীলালের কবিপ্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘সারদামঙ্গল’ কাব্য। তিনি নিজেই জানিয়েছেন-মৈত্রী বিরহ, প্রীতি বিরহ ও সরস্বতী বিরহে উন্মত্ত হয়ে তিনি এই কাব্য রচনা করেন। এই কাব্যে তিনি সরস্বতীর আরাধনা করেছেন। এই সারদাকে তিনি কখনও জননীরূপে, কখনও প্রেয়সী ও কন্যারূপে কল্পনা করেছেন। তবে এটি কিন্তু পুরোনো মঙ্গলকাব্য নয়। তিনি মঙ্গলকাব্যের পাঁচ নতুন জীবনবোধের গল্প শোনাতে চেয়েছেন। নিজের অন্তরে প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে তিনি একান্তভাবে এই সারদাকে গড়ে তুলেছেন। এজন্যই সারদাকে কবির দেখার একান্ত বাসনা-

“দাঁড়াও হৃদয়েশ্বরী ত্রিভুবন আলো করি

দু নয়ন ভরি ভরি দেখিব তোমায়।”

রবীন্দ্রনাথের বউঠান কাদম্বরী দেবী ছিলেন বিহারীলাসের ‘সারদামঙ্গল’-এর ভক্ত পাঠিকা। ‘সারদামঙ্গল’-এর কিছু পত্তি তিনি এক আসনে লিখে তা বিহারীলালকে উপহার দিয়েছিলেন। সেখানে লেখা ছিল “হে যোগেন্দ্র। যোগাসনে/ঢুলুঢুলু দুনয়নে/বিভোর বিহবল মনে কাঁহারে ধেয়াও।” এ প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যই বিহারীলাল লিখেছিলেন ‘সাধের আসন’ কাব্য। কিন্তু তার আগেই কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু ঘটে, ফলে উত্তর আর তিনি শুনে যেতে পারেননি। কবি লিখেছিলেন-“কাহারে ধেয়াই আমি নিজে আমি জানি নে।”

বিহারীলাল আধুনিক গীতিকবিতার প্রবর্তক। তাঁর হাত ধরেই বাংলা আধুনিক গীতিকবিতার যেমন সূচনা হয়েছিল তেমনি উনিশ শতকে কিছু কবি বিহারীলালকে সামনে রেখে কাব্য পরিক্রমায় যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-“সে প্রত্যুষে অধিক লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্জে বিচিত্র কলগীত কৃজিত হইয়া উঠে নাই। সেই ঊষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল। সে সুর তাহার নিজের।”

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading