‘আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা’ গল্পের নামকরণের তাৎপর্য-
বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে দেবেশ রায় (১৯৩৬-২০২০) নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। ঔপন্যাসিক হিসাবে যেমন সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তেমনি ছোটোগল্পকার হিসাবে প্রশংসার অধিকারী হয়েছিলেন। ছোটোগল্প রচনায় এক নতুন রীতি নিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন। তাঁর ছোটগল্পের অঙ্গিক নির্মাণ, বক্তব্য উপস্থাপন ও বিষয়বস্তু নির্ধারণে নতুনত্বের পরিচয় মেনে। ছোটোগল্পগুলির বিষয়বস্তুর মূলে
রয়েছে সাধারণ মানব জীবন। সংবেদনশীন সত্ত্বার অধিকারী গল্পকার সমাজকে গভীরভাবে অবলোকন করেছেন। প্রতিটি ছোটোগল্পে মৌলিকত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব মানবজীবনের সুখ, দুঃখ, লড়াই, বিধ্বংস প্রভৃতির প্রভাব সমাজের উপর পড়ে। ছোটোগল্প তাই মানুষের ছোট ছোট দুঃখ কথা তুলে ধরে। নানা ভাবে জীবনের বৈচিত্র্যতা উঠে আসে গল্পের ভুবনে। কোন গল্পকার, বা, সাহিত্যিক সমকালকে অগ্রাহ্য করে সার্থকভাবে এগিয়ে যেতে পারেন না। মানুষের জীবন প্রণালী, আশা-আকাঙ্কন, সুখ-দুঃখ, জ্বালা-যন্ত্রণা, জটিলতা- দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, যুদ্ধ, দেশল্লগ-এ সবেরই সাক্ষী রয়েছেন গল্পকার। মানুষের টিকে থাকার লড়াই ও উত্তরণকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন গল্পকার বিভিন্ন গল্পে।
তাঁর ছোটোগল্পগুলির মধ্যে রয়েছে বাস্তবধর্মী জীবনকে নানাভাবে কাঁটাছেঁড়া করে দেখার প্রবণতা, দেবেশ রায়ের বেশ কয়েকটি গল্পে প্রবাদ প্রবচনের উল্লেখ রয়েছে যেমনঃ ‘অমলেন্দু, মানতীর’ ও আরো কয়েক প্রকারের ভালোবাসা’ গল্পে-চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। ‘সাধারণ চক্রোত্তির জীবনসূত্র’ গল্পে- শ্যামও রইল স্কুল ও রইল কিংবা ‘ধণী’ গল্পে- ভাগের মা গঙ্গা পায় না, ‘আগভূম বাড়াডুম ঘোড়াডুম’ গল্পে- জাতে মাতাল অনে ঠিক ইত্যাদি।
দেবেশ রায় নাগরিক জীবনের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও তুলে ধরেছেন বিভিন্ন গল্পে। গ্রামীণ শোষণ এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটি আনাদ্য ভিত গড়ে দিয়েছিলেন গল্পগুলির মাধ্যমে। জীবনযাত্রার নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের ছবি বিভিন্ন গল্পে ফুটে উঠেছে। লোকায়ত সংস্কার বিশ্বাস, লৌকিক, অভি-লৌকিকের অসংখ্য উপাদানের সূত্রে পীড়ন সর্বস্ব মানুষের আর্তিকে জুড়ে দইয়ে এক বিকল্প বাস্তব জগৎ, বিকল্প বয়ান এবং বিকল্প নন্দনকে চমৎকার ভাবে রূপদান করেন। গ্রামীণ জীবনবোধ গড়ে উঠেছে সাধারণ, সহজ, সরল, মানুষগুলিকে নিয়ে। বেশ কয়েকটি গল্পে গাঁয়ের বিবরণ, জমির উল্লেখও রয়েছে। গ্রাম পাশ দিয়ে অতিবাহিত নদীর প্রসঙ্গ, চাষের জন্য মাটি; ধান ক্ষেত্রে তাদে বা বাধ দেওয়ার কথা, নদীতে চলে নৌকা, ক্ষেতে নাঙল সেই সঙ্গে নিকানো উঠানের কথাও রয়েছে। গ্রামে বিজলী বাতির অভাব রয়েছে, তাই অনেক গল্পে লণ্ঠনের কথা, প্রদীপের আলোর কথা উল্লেখিত হয়েছে। তেঁতুল, পাকুড়, শিরিষ, বট, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি
গাছ-গাছালির গুরুত্ব দৈনন্দিন জীবনে অনেক বেশি। ‘রক্তের তামুখ’ গল্পে উল্লেখ রয়েছে মানবজীবনের অত্যাবশকীয় সেই উপাদানগুলি। শস্য-শ্যামলা, সবুজ শ্যামল ভারতবর্ষের প্রকৃতি রূপ বর্ণনা করেছেন
গল্পকার- “কার্তিকে ক্ষেত ভরা, অঘ্রানে আঙিনা ভরা, পৌষে খোলান ভরা’। গ্রামের মাটি মেশানো নরনারী আর ভূমিজ আখ্যান নিয়ে গল্প রচনা করেন তিনি। ‘উচ্ছেদের পর’ গল্পে নদীর পাড়ে জাল নিয়ে একজনকে মাছ ধরতে দেখা যায়। সত্যিই মনোরম দৃশ্য এটি। কিংবা ‘আমিষ নিরামিষ’ গল্পে সিদেশ্বরী দেবীর টুংরী-র প্রসঙ্গ রয়েছে এখানে লোক বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ‘আহ্নিক গতি ও মাঝখানের দরজা’ গল্পেও গ্রামীণ সমাজ চিত্র উঠে এসেছে। গল্পের প্রধান চরিত্র তটিনী ও শিশির বারান্ধায় দুটো নিড়ি পেতে বসে আছে কিংবা ডেকচি থেকে হাত দিয়ে ভাত বের করে দেয়। শিশির লুঙি পড়ে, রাতের অন্ধকারে লণ্ঠন জ্বানে। তটিনী প্রতিদিনের মত বঁটি নিয়ে আনাজ কূটতে থাকে। উঠোন পার হয় ঘোমটা তুলে। ‘সাত- হাটের হাটুরে’ গল্পে গ্রামীণ কিছু চালচিত্রের বিবরণ পাওয়া যায়। সাধনের দিদি শাড়ি পড়ে এবং আঁচল দিয়ে গা ঢেকে রাখে। এরূপ লজ্জাবোধ যেন গ্রামের মেয়েদের ভূষণ। সারা গল্প জুড়েই রয়েছে গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র-
“মাসকলাই বাড়ি কলোনির সকাল সেলার প্রায় নির্জন পথটা দিয়ে সাধন এগুতে থাকে।
একটু ভেজা ভেজা ঘাস, ভেজা ভেজা গাছের পাতা, ভেজা ভেজা নদীর জল, ভেজা ভেজা হাওয়া। মাঝেমধ্যে দু-একজন বুড়াও, মজা না ঘাঁট হাতে দেখা দেয়। ওরা এখনো গাঁয়ের। অভ্যাস ছাড়তে পারেনি, তাই কেউ উঠবার আগে মাঠে কাজ সেরে আসে।
সাধন বিড়ি, লজেল্গুম, সেফটিপিন, তালাচাবি গাঁয়ে গায়ে ফেরি দিয়ে বিক্রি করে। স্বামী পরিত্যক্তা দিদি আর ভাই সাধনের সংসারে অভাব অনটন দেণেই থাকে তবু ও সাধন প্রায়ই গান গেয়ে ওঠে-
” খেয়ে নাও সাধনের পানবিডি তোমার
শিছে-ফোঁকা বাবা-মা আসিবে ফিরি।
কিংবা
“দাসের বিড়ির কথা শোনেন
ভিতরেতে ভরতি কোকেন রোজ রোজ
যদি টানবেন আফিও-খাওয়া নাথ হবেন
দাসের বিচির কথা শো-কে-না
‘দুপুর’ গল্পের বর্ণিত গ্রামীণ প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোরম। রেনুবালা, সতীদের বাড়ির পাশে আমগাছ সে গাছের ছায়া মাঠে পড়ে। কোন এক নারীকে মাটির কলসী নিয়ে জল আনাতে দেখা যায়। আমগাছের ডালে ডানে অসংখ্য কাঠপিপড়ে চলছে, তারা গাছের কোটরে বাসা বাঁধে। মাটির বেহানা বেজেই যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ঐ গল্পের প্রকৃতির রূপ অনবদ্য। পায়ে পায়ে’ গল্পে রয়েছে ঘড়ের চাল অর্থ্যৎ কাঁচা ঘারের উল্লেখ, লাঙলের উল্লেখ, আমলকী গাছের মৃদুমন্দ বাতাসের প্রসঙ্গ ‘শামুক’ গল্পের নায়িকা দময়প্তি শাড়ি পড়ে গা ঢেকে কলেজে যায়। ‘স্মৃতিজীবী’ গল্পে পরেশ ও বল্লভ ধুতি পড়ে। ‘অসুখ’ গল্পে রয়েছে গোবর নিকানো উঠোনের প্রসঙ্গ। অবিনাশ ধুতি পড়ে। অনুরাধা সজনে ডাঁটা, পুঁইশাক খেতে চায় না। বাঙালির অন্যতম খাদ্য সজনে ডাঁটা। ‘বেড়ালটির জন্য প্রার্থনা’ গল্পে আমলকী গাছ, কূল গাছের কথা ও রয়েছে, আসনে আমলকীর ভেষজ গুণাবলী সম্পর্কে গ্রাম জীবনে সকলেই জানে। তাই গল্পকারের বেশ কয়েকটি গল্পে আমলকীর প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। গল্পকার বাল্যকালে মামার বাড়ির এদিক ওদিক গ্রামের চারদিকে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর চোখে বিভিন্ন দৃশ্যাবলী চোখে পড়েছে। যার প্রভাব তাঁর অপেক্ষায়’ গল্পে দেখা যায়। গল্পের ভাষায়- আমাদের শোবার ঘরের বারান্দায় ও পাশে বাড়ির সজনে গাছটা সজনে গাছে যখন ফুল ফোটে তখন-ই সুন্দর ‘অপেক্ষায়’ গল্পে গল্পকারের ব্যক্তিগত গ্রামীণ অভিজ্ঞতার বর্ণনা মেনে। স্মৃতির প্রভাব মানব জীবনে অনেক। গল্পকারের ও ব্যক্তিগত স্মৃতি যে স্মৃতি পরিবেশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তার গুরুত্ব অনেক। অতুলনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য তাঁর হৃদয়ে শুধু আনন্দ-ই দান করেনি পাশাপাশি হৃদয়ে চিরকালের জন্য স্মৃতি হয়ে রয়েছে
“জানো, আমি তোমাদের বাড়িতে তো প্রায় পাঁচ বৎসর যাই না, অথচ স্পষ্ট বলে দিতে। পারব কোথায় কী আছে। সেই রান্নাঘরের পেছনে একটা জলপাই গাছ তখন ছিল দেয়ান
উচু, এখন নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছে’ রান্নাঘরের পাশে অনেকগুলো গাছ-ই তো আছে কিন্তু কাঁঠাল গাছ বাদে আর কোনো গাছই আমি মনে আনতে পারিনা।
এই গল্পে শেফালী, চামেলি ফুলের কিংবা গাদার ফুদের বিবরণ ছিল। আসলে তিনি ফুলপ্রেমী ছিলেন। তাই গল্পে বাস্তব কাহিনি বর্ণনা করেছেন প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মেলবন্ধ ঘটিয়ে। এক প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা, গল্পের ভাষায়-“চাঁদের দিকে তাকালাম-তেল ফুরিয়ে যাওয়া লণ্ঠনের মত পোড়ামাটি রঙের চাঁদটা আরো ক্ষতযুক্ত হয়ে টুপ করে এঐ মাঠটার ওপর খসে পড়বে অথচ কেউ জানে না, কেউ দেখছে না, ফলে সন্ধ্যেবেলা যখন আর চাঁদ উঠবে না তখন খোঁজ পড়বে সেই শশ্মশানে যেন আমরা অপেক্ষা করে থাকলাম কখন ক্ষয়ে ক্ষয়ে চাঁদের নাভি কুণ্ডলী একটি ছোট বিন্দুর আকার নেয় ও তারপর ঝরে পড়ে। চাঁদটা মারা মাচ্ছে চাঁদ আমাদের আমগাছটা, বর্ষা রাতের চামেলি ফুল, সপ্তর্ষি তারা সব, সব সব মারা যাচ্ছে।
গল্পকার প্রাকৃতিক পরিবেশের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তাই কাঁঠাল গাছ, আমগাছ, চামেলি ফুল, সজনে গাছ, জলপাই গাছ, মালতী ফুল, আমনকী গাছ, ইত্যাদি গাছের বিবরণ বেশ কয়েকটি গল্পে উল্লেখিত হয়েছে।
“শেফানিগাছের এমন একটা ডান আছে সেটার দিকে চাইলে, রাস্তার আলোটাকে আর দেখা যায় না। এই সত্যি বলছ, চামেলিকেই জাতি পুষ্প বলে?
বাদ্যযন্ত্র হিসাবে রেডিও, সানাইয়ের উল্লেখ রয়েছে। উলুধ্বনি, শাখের আওয়াজ, বিয়ে বাড়ির গেটের কলাগাছ দুদিকে। ‘ষড়কোটা’ গল্পের প্রধান চরিত্র হিসাবে নানকু কাহারকে গল্পকার কঠিন, হৃদয়হীন, সত্তার অধিকারী হিসাবে পরিচিত করিয়েছেন। গল্পে একদিকে যেমন নানকুর নির্দয়, নির্মম হৃদয়ের পরিচয় মেনে তেমনি গল্পের প্রাকৃতিক বিবরণ অসাধারণ।
“মোরগগুলো একবার ফোকর গলিয়ে দেখে নিন পুবেল আকাশ লালচে হয়েছে কিনা, তারপর মাখাটা ভিতরে নিয়ে মুরগির উষ্ণ রোমশ তুলতুলে বুকে মুখ গুঁজে দিল; বুনো অশ্বথ গাছের ফোকারের মধ্যে কুগুনী পাকানো গোখরা সাপটি বাঁ পাশ থেকে ডান পাশে মাথা দিন, আকাশে উড়তে থাকা পেঁচা আর বাদুড়েরা পূর্বদিকে তাকাল, গাছের পাতা সে-রাতের শেষ শিশির ফেলল টিপ টিপ টপ আশমানের পশ্চিম কোনায় পানশে চাঁদ খুলে যাচ্ছে। যেমন কারে খুনে থাকে সেয়া কুলকাটার সব পাপড়ি কারে যাওয়া হলদে বাসি ফুলের একটি মাত্র পাপড়।”
উপরে উল্লিখিত পংক্তিগুলির তাৎপর্য অনেক। অসাধারণ প্রাকৃতিক বর্ণনার মধ্যে দিয়ে দুটি নরনারীর মধ্যের শারীরিক সম্পর্কের সুন্দর মুহূর্তটিকে সাহিত্যে রূপ দিলেন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাধুর্য বোঝাতে প্রকৃতি এখানে বিরাট বড় ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি রয়েছে নানকু কাহারের বিড়ি খাওয়ার প্রসঙ্গও। গ্রামে বিড়ি খাওয়ার ব্যাপারটিও চোখে পড়ে বেশ কিছু ছোটোগল্পে। গ্রামের সহজ সরল মানুষ অনেক সময় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে নেশাদ্রব্য যেমন বিড়ি ও তামাক সেবন করে। নানকুর দোকানের পাশে বিরাট কদমগাছের উল্লেখ এবং গরুর গাড়ির উল্লেখ। তারাপুর পায়ের পাশ দিয়ে রূপখালাসি নদীর অতিবাহিত। হওয়ার কথা, কিংবা নানকুর স্ত্রী গাধুলির শাড়ির আচল দিয়ে গা ঢাকার প্রসঙ্গ গায়ের নারীর পোষাক এর বিবরণ-সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বত্রিশ আঙুলো গল্পে শ্রীশ চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে গ্রামীণ
পরিচ্ছদের বিবরণ। পাশাপাশি অবিনাশ ও অনুরাধার মধ্যে রসিকতারও উল্লেখ রয়েছে। যেমন গল্পে বর্ণিত ‘রাগ করে না রাগুনি, রাঙা মাখায় চিরুনি, বর আসবে এখুনি, নিয়ে যাবে তক্ষুনি।’ প্রকৃতির সৌন্দর্যতা বজায় রাখা মানুষের প্রধান সামাজিক কর্তব্য। তার এজন্য প্রয়োজন বৃক্ষরোপণ করা। কারণ গাছ পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার যুগে মানুষ প্রতিনিয়ত বৃক্ষচ্ছেদন করে চলছে। এ থেকে বিরত হতে হবে। আর এজন্য দেবেশ রায় ও তাঁর গল্পবিশ্ব মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতিকে সমান ভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। মানবের সঙ্গে প্রকৃতির অপূর্ব মেলবন্ধন যোগ কিছু গল্পে ফুটে উঠেছে। এ ব্যাপারে গল্পকার ভূয়সী প্রশংসার যোগ্য। আধুনিক পৃথিবীতে দূষণের যাত্রা ক্রমে বেড়েই চলেছে। শস্যশ্যামলা পৃথিবীকে দুষনমুক্ত করতে সকলের সর্বাঙ্গিন সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রকৃতির নানা জৈব ও অজৈব উপাদানের প্রসঙ্গ ‘হাড়কাটা’ গল্পের এসেছে মানবজীবনের ওপর এদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য এবং পাঠক ও এব্যাপারে গল্পকারের সঙ্গে একমত। প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য, বিভিন্ন অনুপবৎ বর্ণনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। গল্পে, অশ্বত্থ গাছ, সজনে, কদম, কাঁঠাল, কাঁশ তেমনি পেঁচা, বাদুড় মোরগ, ইঁদুর, চিল, শকুন, চামচিকা পাখির নামও। এমন প্রাকৃতিক গ্রামীণ দৃশ্যের বর্ণনা সত্যি মন মুগ্ধ করে দেয়। ঢেঁকিশাক, কচুপাতা, শেয়াল, কুকুর, পাঠা, বাঘ, বনবিড়াল, সাপ ইত্যাদির উল্লেখ গল্পের সার্থকতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘হাঁড়কাটা গল্পে রয়েছে লোক ঔষধের প্রসঙ্গ ও নানকুর ছেনের আমাশা হলে তার স্ত্রী তাকে পাঠার মেটে আনতে বনে, তাদের ধারণা মেটে খেলে আমাশা সেরে যাবে। কখন ও খিটখিটে হিসাবে নানকুকে দেখা যায় তখন স্ত্রীকে গালাগালি করে। প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা যেমন গাছের ছায়া উঠোনে পড়েছিল, বাড়ির সীমানায় বেড়ায় উল্লেখ, পাশে ঝোপঝাড়, পন্দ্রনাথের ঘর টিনের ছাওয়া। পান-সুপাড়ির উল্লেখ, কোথাও ছনের ঘরের উল্লেখ আবার কখনও পদ্মনাথকে দেখা যায় ‘অদুরা পোক’ ও হাতিরাচোতা বনে গালি দেয় ইত্যাদি বর্ণনা সত্যিই গ্রামীণ নরনারীর প্রাত্যহিক ঘটনাবলীর বিবরণ। চাঁপা গাছ, ধুতরা গাছ, লঙ্কা, লতা-গুন্মের ও উল্লেখ মেদে বেশ কিছু গল্পে।
প্রকৃতি আর মানুষকে একই রেখায় দাঁড় করিয়েছেন গল্পকার ‘হাঁড়কাটা’ গল্পে। মনে হয় গল্পকার পাঠককে এই ম্যাসেজ দিতে চেয়েছিলেন যে মানব জীবনে প্রকৃতির গুরুত্ব অনেক। আর তাইতো এমন সুন্দর পংক্তি রচনা-
গিয়েছে, ভরে গেছে ফুলে। তারই একটা ডানের ওপর বসে একটা কাক আরেকটার পিঠ ঠুকরে দিচ্ছে। কয়েকটা বাচ্চা ছেনের নাড়ানাড়িতে টপটপ করে করে পড়ছে সজনে ফুল, ঝির ঝির করে ঝরে পড়ছে সজনে পাতা। মাঠের ওপর একটা বাছুরের গা চেটে দিচ্ছে একটা গরু, তিন কোনো মাঠের মাঝখানে পাগলটা আর কুকুরটা খেলছে, হাসছে।
প্রকৃতির সাহচর্যে-ই আমাদের জীবন পরিপূর্ণ। প্রকৃতির সৌন্দর্যতা তাই বজায় রাখার দায় আমাদের সকলের।
“গলিতে ঢুকে দেখে মাটির রাস্তার দুইপাশে দণ্ডকনসের শাদা শাদা ফুলের উপর মৌমাছি বসেছে। সেয়াকুল কাঁটার হলুদ ফুল হাঁ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। দুই পাশের ঘরের ছায়ায় রাস্তাটা ঠাণ্ডা, ছায়ায় ছায়া মধুর। ঢেঁকিশাক আর লম্বা ঘাস বাঁচা নানার দুই পাশে বর্তমানের মতো অতীতে রাস্তাঘাট, যান-বাহনের তেমন সুজাপন্থা কম ছিল। মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গরু- গাড়ি করে যেত। গরুর গাড়ির প্রসঙ্গটি তৎকালীন সময়ের গ্রামীণ যানবাহনের উল্লেখ করে।
উপসংহার:
সময়ের অগ্রগতির ফলে সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান যুগে পৌঁছে ও মন মানসিকতা থেকে পুরোপুরি কুসংস্কার দূর করতে পারিনি। কিছু কিছু কুসংস্কার তো সংস্কৃতি হিসাবে গেঁথে গেঁথে যেমন দিনের শেষে সন্ধ্যায় ধূপ প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া। দিপাবলীতে পিতৃপুরুষের উপলক্ষে চৌদ্দ বাতি জ্বালানো কিংবা তর্পন অর্থাৎ বিশেষ দিনে বা তিথিতে পূর্বপুরুষদের উপলক্ষে জল দান ইত্যাদি, যদিও এগুলির পিছনে বৈজ্ঞানিক কারণ থাকতেও পারে তবুও মানুষের বিশ্বাসে এগুলি জড়িয়ে গেছে। সংস্কৃতির শেকড় গ্রামে পোঁতা রয়েছে এ ব্যপারে গ্রাম্যজীবনের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিতে বহু গল্পে গ্রাম্যজীবনের ছোটখাটো প্রসঙ্গ নানা ভাবে তুলে ধরেন গল্পকার। আসলে আমরা জ্ঞান বিজ্ঞানের দিক দিয়ে অনেক উন্নতি করলেও এসব আঙটি পাথর এগুলোতে অনেক মানুষ এখনও বিশ্বাস করে। ‘উচ্ছেদের পর’ গল্পে এক ‘ভুইছাড়া’ আধিয়ার বগাকে গিরি তার-জমি থেকে উচ্ছেদ করে দিয়েছে। এ থেকে তৎকালীন সমাজের সমাজচিত্র ফুটে উঠে। অর্থাৎ উচ্ছেদ করাটা সে সময়ে একটা প্রথা বা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, গ্রামীন জীবনের অভ্যন্তরের রূপটি গল্পটিতে বাস্তবতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। গল্পকার সমাজ সচেতনতা-ই তাঁর গল্পগুলির রসদ যুগিয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে, অর্থনীতি প্রচার মাধ্যমের ব্যাপক প্রতিযোগিতা গ্রামজীবনেও এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে, দৈনন্দিন জীবনের নানা অশান্তি, অর্থনৈতিক অনটনের কারণে গ্রামীণ সংস্কৃতির চর্চায় দেখা যায় অনেক ঘাটতি। কখনও বিজ্ঞাপনমূলক চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠানের বর্ণনা মানুষের মনকে কেড়ে নিচ্ছে, কমে যাচ্ছে রাত জেগে ঝুমুর ও যাত্রাগানের আগ্রহ। সমাজ গতিশীল, তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লৌকিক দেশজ সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
আরো পড়ুন,
‘স্টোভ’ গল্পে শশিভূষণের চরিত্র আলোচনা করো।
‘নিমগাছ’ গল্পটি কোন গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত? নিমগাছের প্রতীকে গল্পকার যে সমাজচিত্র তুলে ধরেছেন তা বুঝিয়ে দাও।
‘রস’ গল্প অবলম্বনে মাজু খাতুনের চরিত্রটি আলোচনা করো।
‘পাড়ি’ গল্পটি রচনার প্রেক্ষাপট বুঝিয়ে দাও।
‘পুঁইমাচা’ গল্পে প্রতিফলিত সমাজচিত্র আলোচনা করো।
‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে হাস্যরস নির্মাণে গল্পকারের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
‘মৌরীফুল’ গল্পে প্রকৃতি ও মানবের মেলবন্ধন কীভাবে ঘটেছে বুঝিয়ে দাও।
‘ছিন্নমস্তা’ গল্পে একটি পুরুষ চরিত্রকে ঘিরে মাতা ও বধূর যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছবি প্রকাশিত হয়েছে তার পরিচয় দাও।
‘আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা’ গল্পের নামকরণের তাৎপর্য আলোচনা করো।
‘আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা’ গল্পের নামকরণের তাৎপর্য আলোচনা করো।
‘পুঁইমাচা’ গল্পটি নামকরণের সার্থকতা বিচার কর ?
“ রস ” গল্পের নামকরণ সার্থকতা বিচার কর ?
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের দেবী গল্পের বিষয়বস্তু ?
দেবী গল্পের বিষয়বস্তু ও নাম করনের সার্থকতা বিচার কর ?
রবীন্দ্রনাথ ও প্রভাতকুমারের মধ্যে তুলনা কর ?
‘দেবী’ গল্পের মূল চরিত্রের পরিণতির জন্য কোন কোন ঘটনা দায়ী উল্লেখ করো।