আলেকজান্ডারের অভিযানের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও বিজেতা ছিলেন। তার অভিযান ও বিজয়ের কাহিনী ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করা আলেকজান্ডার ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের পুত্র। ফিলিপের কাছ থেকে একটি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত সামরিক বাহিনী ও একটি সুপ্রতিষ্ঠিত রাজ্য লাভ করেছিলেন তিনি। অল্পবয়সেই তিনি দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্যের শিক্ষায় দীক্ষিত হন এবং সেনাবিদ্যা ও যুদ্ধনীতিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন।
আলেকজান্ডারের অভিযান শুরু হয়েছিল ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, যখন তিনি এশিয়া মাইনরে (আজকের তুরস্ক) পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার প্রথম বড় যুদ্ধ ছিল গ্রানিকাস নদীর তীরে, যেখানে তিনি পারস্যের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। এই বিজয় তার সামরিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে।
এরপর আলেকজান্ডার প্রাচীন পারস্যের রাজধানী সুসা, পার্সেপোলিস এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো দখল করেন। পারস্য সম্রাট দারিয়ুস তৃতীয়ের সাথে গাউগামেলার যুদ্ধে আলেকজান্ডার একটি নির্ণায়ক বিজয় অর্জন করেন, যা পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। এই যুদ্ধে আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী ছিল সুসংগঠিত এবং অত্যন্ত শক্তিশালী, যার ফলে দারিয়ুসের বিশাল সেনাবাহিনীকে তিনি পরাজিত করতে সক্ষম হন।
পারস্য সাম্রাজ্য বিজয়ের পর আলেকজান্ডার তার সেনাবাহিনী নিয়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তিনি বাকত্রিয়া, সোগডিয়ানা এবং অন্যান্য মধ্য এশীয় রাজ্য দখল করেন। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে মিশে আলেকজান্ডার একটি মিশ্র সংস্কৃতি সৃষ্টি করেন, যা হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি নামে পরিচিত। তিনি গ্রীক সংস্কৃতি ও প্রাচ্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়ে একটি নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেন।
আলেকজান্ডারের অন্যতম বৃহত্তম অভিযান ছিল ভারতবর্ষে। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি সিন্ধু নদ পার করে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন। তিনি পাঞ্জাবের রাজা পুরুর সাথে যুদ্ধে মিলিত হন। হাইডাস্পিস নদীর তীরে এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয়, যা আলেকজান্ডারের জীবনের অন্যতম বৃহত্তম ও কঠিন যুদ্ধ ছিল। রাজা পুরুর সাহসিকতা ও প্রতিরোধ সত্ত্বেও আলেকজান্ডার বিজয়ী হন। কিন্তু তার সেনাবাহিনী ভারতবর্ষের গ্রীষ্মের কঠিন আবহাওয়া ও অজানা ভূখণ্ডের কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তারা আরো পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে রাজি হয়নি। ফলে আলেকজান্ডার বাধ্য হয়ে পশ্চিম দিকে ফিরে যেতে শুরু করেন।
আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ অভিযান তার সামরিক কৌশল ও নেতৃত্বের উৎকর্ষতা প্রদর্শন করে। তার সেনাবাহিনী সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষিত এবং অত্যন্ত অনুগত ছিল। আলেকজান্ডার নিজে তার সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতেন এবং তাদের মনোবল বৃদ্ধি করতেন। তিনি নতুন নতুন কৌশল ও অস্ত্র ব্যবহার করতেন, যা তাকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল।
ফিরে আসার পথে আলেকজান্ডার মাকড়োনিয়া ও পারস্যের বিভিন্ন অংশে নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করেন, যা তার নাম অনুসারে আলেকজান্দ্রিয়া নামে পরিচিত। এই শহরগুলো প্রাচীন বিশ্বের বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। আলেকজান্ডার তার সাম্রাজ্যে গ্রীক ভাষা, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রসার ঘটান।
কিন্তু আলেকজান্ডারের জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩২ বছর বয়সে বাবিলন শহরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু নিয়ে নানা মত রয়েছে, কেউ কেউ মনে করেন যে তিনি বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন, আবার কেউ কেউ মনে করেন যে তিনি প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার বিশাল সাম্রাজ্য বিভিন্ন সেনাপতির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কোন শক্তিশালী নেতা না থাকায় সাম্রাজ্যটি ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তার অভিযানের মাধ্যমে তিনি যে সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন, তা যুগ যুগ ধরে প্রাচীন বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করে।
আলেকজান্ডারের অভিযান ও বিজয় শুধু সামরিক দক্ষতার দৃষ্টান্ত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানের বিনিময়েরও প্রতীক। তার নেতৃত্ব, সাহসিকতা এবং দৃঢ় সংকল্প তাকে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার অভিযান প্রাচীন বিশ্বের ভৌগোলিক সীমা বিস্তৃত করেছে এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে, যা ইতিহাসে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।