আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি ও বিষয়বস্তু (The scope and subject matter of International Relations):
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয়বস্তু নির্ধারণ করার কাজটি খুবই কঠিন, কারণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গতিশীল এবং এর বিষয়বস্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল। নতুন নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব, বহুসংখ্যক আন্তর্জাতিক সংগঠনের উদ্ভব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভূতপূর্ব উন্নতি, আণবিক মারণাস্ত্রের প্রসার, বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তন, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উত্থান ও পতন, তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভব, বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এনেছে, উনবিংশ শতাব্দীতে তা কল্পনা করা যেত না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মূলত কূটনীতিবিদদের কার্যাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জনসাধারণ বিদেশ নীতি অথবা আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির ব্যাপারে আদৌ উৎসাহ দেখাতো না।
কার (E. H. Car)-এর মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রথমাবস্থায় পরম লক্ষ্যবাদী চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল (“The teleological aspect of the science of international politics has been conspicuous from the outset.”)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে যাঁরা মাথা ঘামাতেন তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পৃথিবী থেকে যুদ্ধকে নির্বাসন দেওয়া এবং শান্তিপূর্ণ নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তাই ওই সময় যুদ্ধ প্রতিরোধের উপায় নির্ধারণই ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান আলোচ্য বিষয়।
যুদ্ধহীন পৃথিবী যে নেহাত কল্পনাবিলাস ছাড়া কিছু নয়, পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ তা প্রমাণ করে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ফলপ্রসূ করতে হলে প্রয়োজন বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে এগিয়ে এলেন মরগেনথাউ (H. J. Morgenthau), টমসন (K. Thompson), স্পাইকম্যান (Spykman), মার্টিন রাইট (M. Wright) প্রমুখেরা। মরগেনথাউ-এর মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ক্ষমতার লড়াই ছাড়া আর কিছুই নয় (“International politics, like all politics, is struggle for power”-Politics Among Nations)। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইকে তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির মুখ্য আলোচ্য বিষয় বলে চিহ্নিত করেছেন। ক্ষমতা, জাতীয় স্বার্থ, শক্তিসামা, আন্তর্জাতিক নৈতিকতা ও বিশ্বজনমত, আন্তর্জাতিক আইন, সার্বভৌমিকতা, আধুনিক যুদ্ধ, নিরস্ত্রীকরণ, যৌথ নিরাপত্র, আন্তর্জাতিক সংগঠন, কূটনীতির অবিষাৎ প্রাকৃতি বিষয়কে মরঙ্গেনগাউ আন্তজাতিক রাজনীতির আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন।
১৯১৭ সালে গ্রেসম কার্ড (Grayan Kark) পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কাউন্সিলের রিপোর্টে ৫টি বিষয়কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত করেন, যথা- (১) রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃতি ও পরিচালনা, (২) রাষ্ট্রীয় শক্তির ওপর প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ, (৩) বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলির অবস্থান ও পররাষ্ট্রনীতি, (৪) সাম্প্রতিককালের আন্তজাতিক সম্পর্কের ইতিহাস এবং (৫) একটি অধিকতর স্থিতিশীল বিশ্বব্যবস্থা।
১৯৪৮ সালে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান পবিয়দের প্যারিস সম্মেলনে তিনটি বিষয়কে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যথা (১) আন্তর্জাতিক রাজনীতি, (২) আন্তর্জাতিক সংগঠন ও প্রশাসন এবং (৩) আন্তর্জাতিক আইন।
১৯৫৪ সালে প্রণীত The Introductory Course in International Relations নামক গ্রন্থে ভিনসেন্ট বেকার (Vincent Baker) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয় হিসাবে ৭টি বিষয়ের উল্লেখ করেন, যথা- (১) আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রকৃতি ও প্রধান শক্তিসমূহ, (২) আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন, (৩) জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহ, (৪) জাতীয় স্বার্থ সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, (৫) জাতীয় শক্তির সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণ, (৬) বৃহৎ শক্তিধর ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলির পররাষ্ট্রনীতি, (৭) সাম্প্রতিককালের আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির ইতিহাস।
কুইনসি রাইট (Quincy Wright) tt “The Study of International Relations” নামক গ্রন্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্যসূচিতে ৮টি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেন, যথা-
(১) আন্তর্জাতিক আইন, (২) কূটনৈতিক ইতিহাস, (৩) সামরিক বিজ্ঞান ও যুদ্ধের কলাকৌশল, (৪) আন্তর্জাতিক রাজনীতি, (৫) আন্তর্জাতিক সংগঠন, (৬) আন্তর্জাতিক বালিজা, (৭) উপনিবেশিক সরকার, (৮) বৈদেশিক নীতি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ।
পামার ও পারকিনস্ (Palmer and Perkins) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয় হিসাবে যেসব বিষয়ের উল্লেখ করেছেন সেগুলি হল-(১) রাষ্ট্রব্যবস্থা, (২) জাতীয় শক্তি, (৩) জাতীয় স্বার্থসাধনের হাতিয়ার হিসাবে কুটনীতি, (৪) প্রচার কার্য, (৫) জাতীয় নীতি প্রয়োগের অর্থনৈতিক হাতিয়ারসমূহ, (৬) যুদ্ধ, (৭) সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ, (৮) শড়িসামা, (৯) যৌথ নিরাপত্তা, (১০) আন্তর্জাতিক আইন, (১১) আন্তর্জাতিক সংগঠন, (১২) জাতীয় স্বার্থ, (১৪) আণবিক মারণাস্ত্র, (১৫) কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের পররাষ্ট্রনীতি, (১৬) পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা।
বৌলছিস এবং উলফ (T. Couloumbis and J. Wolfe) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্যসূচিতে ১৬টি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যথা-(১) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনার বিশ্লেষণতদি, (২) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তন্ধু, (৩) জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জাতীয়তাবাদ, (৪) জাতীয় রাষ্ট্রের ক্ষমতা, (৫) জাতীয় স্বার্থ, (৬) জাতীয় রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি, (৭) কুটনীতি, (৮) যুদ্ধ, (১) শক্তিসামা, (১০) আন্তর্জাতিক আইন, (১১) আন্তর্জাতিক সংগঠন, (১২) আন্তর্জাতিক কল্যাণকর কর্মসূচি, (১৫) আন্তজাতিক অর্থনিতি, (১৪) বিশ্বের ধনী ও দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে বৈষম্য, (১৫) আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কর্মকর্তা, (১৬) মানও সভ্যতার অরিত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জসমূহ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে যে আচরণবাধেরা (Behavinicalism) আবির্ভাব ঘটে আন্তার্জাতিক সম্পর্কের ওপরা তার সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। ডেতিয় ইস্টন, বঙ্গে চয়েন্ট, মটন ক্যাপদান, রিচার্ড প্রাইডার প্রমূখ আচরণবাদীদের মতে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি বা ব্যাক্তি-গোষ্ঠী যে দমন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সেগুলিও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবোন হওয়া উচিত। এই প্রসদে অধ্যাপক বার্টনের মন্ত্রটিকে উল্লেখ করা যেতে পার। বানি বলেন, বর্তমান অবস্থায় আন্তজাতিক সম্পর্ক একদিকে সংকীর্ণ এবং আর একানিতে ব্যাপকতর হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনাক্ষেত থেকে আতারাষ্ট্র সম্পর্কের বেশ কিছু বিষয় বাদ যাওয়ার ফলে তা সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আচরণগত সংবেদনশীলতা, পরিবর্তনের দাবি, সিআন্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আনেজনা করছে। এসব বিষয় আন্তর্জাতিক সম্পর বিষয়ে পূর্বেকার পাঠ্যপুস্তকগুলিতে স্থান গায়নি। আবার কাঠামোবাদ (Stracturalism) নামে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হয়েছে,
যার মূল কথা হল এই যে, আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গুটিকতক প্রভাবশালী পুজিবাদী দেশ এবং তার চারপাশে রয়েছে বিশ্বের অধিকাংশ অনুন্নত পরনির্ভরশীল। দেশ। সুতরাং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় এই কেন্দ্র-প্রান্ত (Centre-Periphery বিশিষ্ট সর্যন্ত কাঠমোটি অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এই তত্ত্বের প্রবক্তারা হলেন ব্রুকটি (৪ Brucau), বাংলারস্টেইন (1. Wallerstein), ছোশপল (T. Skocpol) প্রমুখেরা। এঁদের মতে, তথাকথিত জাতীয় স্বার্থের নামে একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেসব নীতি অনুসরণ করে, সেগুলি আসলে ঐ রাষ্ট্রের প্রভুত্বকারী শ্রেণির স্বার্থরক্ষার উপযোগী নীতিমাত্র। সুতরা। বিডিও রাষ্ট্রের এইসব প্রয়ান্যকারী শ্রেণিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃত কর্মকর্তা হিসাবে স্বীকৃতি দেওায়া উচিত।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনাক্ষেত্রের পরিধি চিরদিনের জন্য বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয়। এটি একটি নিত্য পরিবর্তনশীল ও গতিশীল বিষয়। আর এই পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এর বিষয়-সূচির পরিবর্তন ঘটে। উদাহরণস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঠান্ডা যুদ্ধ, দি মেরুপ্রবণতা, প্রতিরোধের নীতি (podizy of-containment), জোট নিরপেক্ষতা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রাধান্য অন্তর্জনি কদালেও ধীরে ধীরে তার তীব্রতা হ্রাস পেয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান সোভিয়েত ইউনিয়নের ভারন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেহারাটাকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। গত শতকের ১০-এর দশক থেকে বিশ্ব এবং মেরুতে (Unipolar) শনিগত হয়েছে। গোটা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন্ত্রে প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতি সভারি বিশ্বের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ও তাদের কার্যকন্যাপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগন-এর ওপর বিমান হানার মধ্য দিয়ে এই সন্ত্রাসবাদ শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়, গোটা বিশ্বের সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এখন থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে এসব বিষয় নিয়েও ভাবতে হবে। সুতরাং এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়সূচির মধ্যে নতুন যে সমস্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন সেগুলি হল: বিশ্ব রাজনীতিতে একমেরুপ্রবণতা, বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্যবাদ, গ্যাট, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থ্য, নয়া আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা, পারমাণবিক অস্ত্রের সম্প্রসারণ ও সম্প্রাসারণ-রোধ চুক্তি, সার্ক, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীসহ অন্যান্য অ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তি, বিশ্বায়ন, আঞ্চলিকতাবাদ, উন্নয়ন, মানবাধিকার ইত্যাদি।