আদর্শবাদ কী? বার্কলির আদর্শবাদ ব্যাখ্যা করুন। বার্কলির আদর্শবাদ সলিসিজম?

আদর্শবাদ কী-

রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কিত মতবাদগুলির মধ্যে আদর্শবাদ বা ভাববাদ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। এই মতবাদে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। এই মতবাদে রাষ্ট্রের চরম উৎকর্ষ ও অবাধ ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে।

আদর্শবাদী মতবাদ :-

রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কিত মতবাদগুলির মধ্যে আদর্শবাদ বা ভাববাদ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। এই মতবাদে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। এই মতবাদে রাষ্ট্রের চরম উৎকর্ষ ও অবাধ ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের আদর্শ ও আইনের প্রতি সকলের চরম ও দ্বিধাহীন আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সকল আদর্শবাদী রাষ্ট্র-দার্শনিক অভিন্ন অভিমত পোষণ করেন তা নয়। নাগরিকদের রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা প্রশ্নাতীত কিনা এ প্রসঙ্গে ভাববাদী দার্শনিকদের মধ্যে অল্পবিস্তর মতপার্থক্য বর্তমান।

আদর্শবাদ অনুসারে রাষ্ট্র হল ন্যায় ও নীতিবোধের এক চরম অভিব্যক্তি বা মূর্ত প্রকাশ। অভ্রান্ত যুক্তির প্রতীক হল এই রাষ্ট্র। বলা হয় যে ব্যক্তির স্বাধীনতা ভোগ এবং ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব একমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত পরিবেশের মধ্যে। সুতরাং ন্যায় ও নীতিবোধ এবং যুক্তি ও স্বাধীনতার স্বার্থে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা আবশ্যক। এই আনুগত্যের অর্থ ন্যায়-নীতি ও যুক্তির প্রতি আনুগত্য এবং স্বাধীনতার স্বার্থে আনুগত্য।

প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও রুশো মতানুসারে আদর্শবাদী মতবাদ:-  প্লেটো তাঁর ‘গণরাজ্য’ (Republic) গ্রন্থে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সর্বাঙ্গসুন্দর আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন। অ্যারিস্টটল এক পরিপূর্ণ সুন্দর জীবনের প্রতীক হিসাবে রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। তাঁদের মতানুসারে মানুষ প্রকৃতিগতভাবে রাষ্ট্রনৈতিক জীব। তাই একমাত্র রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই ব্যক্তি তার জীবনকে সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে পারে। প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের কাছে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের স্বার্থ ছিল অভিন্ন। তাই ব্যক্তির আনুগত্যের বিষয়টি তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়নি। ফরাসী দার্শনিক রুশো রাষ্ট্রকে সর্বসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের আলোকে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্রের জনমণ্ডলীর সমষ্টিগত ইচ্ছার (General will) মধ্যেই এই সামগ্রিক কল্যাণের সন্ধান পাওয়া যায়। সামগ্রিক সামাজিক কল্যাণের প্রতীক হল এই সমষ্টিগত ইচ্ছা। এই সমষ্টিগত ইচ্ছার মধ্যে প্রত্যেকের প্রকৃত ইচ্ছা (Real will) বর্তমান।

হেগেল মতানুসারে আদর্শবাদী মতবাদ:-  আদর্শবাদী জার্মান দার্শনিক হেগেল চরম রাষ্ট্র কর্তৃত্বের কথা বলেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্য হল চরম। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণের অধিকারকে তিনি অস্বীকার করেছেন। হেগেলের মতানুসারে রাষ্ট্র হল একটি সচেতন নৈতিক আদর্শ সম্পূর্ণ ব্যক্তি। এর আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধির ক্ষমতা আছে। রাষ্ট্র একটি অতিমানবীয় সংগঠন। এই সংগঠন সর্বশক্তিমান ও অভ্রান্ত। এর স্থান সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রের এই সর্বময় কর্তৃত্বকে দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করে নেওয়া প্রত্যেকের কর্তব্য। রাষ্ট্রই হল ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা ও যাবতীয় ভালোর উৎস। সুতরাং কেবল রাষ্ট্রের মধ্যেই, রাষ্ট্রের নির্দেশ পালনের দ্বারা এবং রাষ্ট্রের ইচ্ছার অনুবর্তী হয়ে ব্যক্তি তাঁর সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। হেগেলের যুক্তি হল ব্যক্তি তার প্রকৃত ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হয়ে স্বাধীনতা উপলব্ধি করতে পারে।

গ্রীণ মতানুসারে আদর্শবাদী মতবাদ:- ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক গ্রীণও ভাববাদী দার্শনিক হিসাবে পরিচিত। তিনিও নাগরিকদের রাজনীতিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর উপর ভাববাদী জার্মান দার্শনিক কান্ট-হেগেলের প্রভাব পড়েছে এবং সমকালীন ব্রিটিশ উদারপন্থী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তাধারার প্রভাবও পড়েছে। গ্রীণের মতানুসারে ব্যক্তির অধিকারের উৎস রাষ্ট্র। আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র এই অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণ করে। মানুষের সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবনের পথে যে সমস্ত বাধা-বিপত্তি আসে রাষ্ট্র তা অপসারণ করে। যথাযথ সামাজিক আচার-আচরণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। এইভাবে রাষ্ট্র ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতা করে। তা ছাড়া রাষ্ট্র সমাজের নৈতিক সচেতনতা এবং ব্যক্তির নৈতিক ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। এই সমস্ত কারণের জন্য রাষ্ট্রের আদেশ-নির্দেশের প্রতি আনুগত্য থাকা দরকার। এবং এই কারণের জন্য মানুষ আইন মেনে চলে স্বাভাবিকভাবে। রাষ্ট্রের উপরিউক্ত ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে বিরুদ্ধাচরণের অধিকার অস্বীকৃত।

আদর্শবাদ বা ভাববাদের বিরুদ্ধাচরণের অধিকার:

তবে গ্রীণের অভিমত অনুসারে নাগরিকদের আনুগত্যের ব্যাপারে রাষ্ট্রের এই দাবি নিঃশর্ত বা চরম নয়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণের ব্যাপারে নাগরিকদের অধিকারকে গ্রীণ একেবারে অস্বীকার করেন নি। গ্রীণের মতে রাষ্ট্র ভুল বা অন্যায় করলে রাষ্ট্রের মঙ্গলের স্বার্থেই ব্যক্তির কর্তব্য হল রাষ্ট্রকে বাধা দেওয়া। রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী বা নাগরিক স্বার্থের বিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে বিরোধিতা করার অধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্র যদি কোন অন্যায় আইন প্রণয়ন করে এবং সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের কোন সুযোগ যদি নাগরিকদের সামনে না থাকে, সেক্ষেত্রে, বিরোধিতা করাকে গ্রীন কর্তব্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তবে জনস্বার্থের বৃহত্তর সংরক্ষণই হবে বিরুদ্ধাচরণের উদ্দেশ্য।

ব্রাডলে মতানুসারে আদর্শবাদী মতবাদ:- ইংরেজ আদর্শবাদী দার্শনিক ব্রাডলে রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক সত্তা হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র ব্যতিরেকে ব্যক্তির পরিপূর্ণ অস্তিত্ব অসম্ভব। ব্যক্তির জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি সম্ভব হয় এবং পরিপূর্ণতা আসে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বিরোধিতার হতে পারে না। কারণ রাষ্ট্রই তার আইনের মাধ্যমে ব্যক্তিকে এক মঙ্গলময় জীবনের সন্ধান দেয়।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading