অন্নদামঙ্গলে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের কৃতিত্ব
গ্রন্থের প্রথম খণ্ড অর্থাৎ প্রকৃত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাহিনীতেই ভারতচন্দ্রের সর্বাধিক কৃতিত্ব প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থােক্ত হরিহােড় এবং ভবানন্দ মজুমদারের কাহিনী কবির স্ব-উদ্ভাবিত, অবশিষ্ট অংশ কবিকঙ্কণ, ঘনরাম এবং স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ড থেকে গৃহীত হয়েছে। এই খণ্ডে কবি ভাষা, ছন্দ-অলঙ্কারাদির সার্থক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে গ্রন্থটিকে রাজসভার যােগ্য করেই তুলেছিলেন। মঙ্গলকাব্যে দেবীর মাহাত্মকীর্তনে ও কাহিনী বর্ণনায় কবির যে আন্তরিকতা প্রত্যাশিত আলােচ্য গ্রন্থে তার অভাব লক্ষ্য করা যায়। এই খণ্ডে কলমের দু’একটি আঁচড়ে কবি ঈশ্বরী পাটনীর যে চিত্রটি অঙ্কন করেছেন, তেমন সজীব চিত্র প্রাচীন সাহিত্যে একান্তই দুর্লভ। বস্তুত সমগ্র মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে কবিকৃতির নিদর্শনরূপে অন্নদামঙ্গলের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে একমাত্র ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’ই উপমিত হবার যােগ্যতা রাখে।
বাঙলা মঙ্গলকাব্যধারায় বিদ্যাসুন্দর
গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড ‘বিদ্যাসুন্দর-কে কবি অসাধারণ কুশলতায় পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক কাহিনীর সঙ্গে যােগযুক্ত করেছেন। এই খণ্ডের অধিষ্ঠাতা দেবী অন্নদা নন, ‘কালিকা’। তাই কেউ কেউ ‘কালিকামঙ্গল’ নামে অভিহিত করে থাকেন। বাঙলা ভাষায় যত বিদ্যাসুন্দর’ কাহিনী রচিত হয়েছে, তাদের মধ্যে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ। বিদ্যা এবং সুন্দরের অবৈধ প্রেমের চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে কবিকে অনেক সময়ই শ্লীলতা এবং সুরুচির গণ্ডী অতিক্রম করতে হয়েছে—ভারতচন্দ্রের বিরুদ্ধে অনেকেই এই অভিযােগ উত্থাপন করলেও প্রখ্যাত সমালােচক প্রমথ চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, “ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতার ভিতর আর্ট আছে, অপরের আছে, ন্যাচার।” তবে দোষেগুণে এই খণ্ডটিই যে বাঙলা ভাষায় রচিত প্রথম নাগরিক সাহিত্য এ সত্য অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই।
তৃতীয় খণ্ডের ব্যর্থতা: গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ভিত্তি ইতিহাস হলেও এটিতেই কবির দুর্বলতা সর্বাধিক প্রকট। মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ ও বাঙলার বারাে ভুইঞার অন্যতম যশােহরপতি প্রতাপাদিত্য এবং তাদের সংগ্রাম ঐতিহাসিক বিষয়। কিন্তু ভারতচন্দ্র এর ইতিহাসের উপর গুরুত্ব আরােপ না করে প্রধানতঃ লােকশ্রুতির উপরই নির্ভর করেছেন। এর ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলি কোন ঐক্যসূত্রে বিধৃত না হওয়াতে কাহিনীটি জমাট বাঁধতে পারেনি। চরিত্রসৃষ্টিতেও কবি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিতে না পারায় তৃতীয় খণ্ডটি সাধারণতঃ উপেক্ষিত হয়েই থাকে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে ভারতচন্দ্র লােকশ্রতির উপর নির্ভর করে ঐতিহাসিক ঘটনা বিবৃত করেছিলেন, ফলে ইতিহাসেরও বিকৃতি ঘটেছে। মানসিংহের সঙ্গে প্রতাপাদিত্যের যে সংঘর্ষকে ভিত্তি করে তিনি এই কাব্য রচনা করলেন, একালের ঐতিহাসিকগণ ঐ ভিত্তিকেই প্রচণ্ড আঘাতে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তারা মনে করেন যে অনুরূপ কোন যুদ্ধই সংঘটিত হয়নি। অতএব কবি ভারতচন্দ্রের কাব্যে ইতিহাসের মর্যাদা রক্ষিত হয়নি।
বাঙলা মঙ্গলকাব্যধারায় ভারতচন্দ্র :
বিচ্ছিন্নভাবে ভারতচন্দ্রের কাব্যের অংশত্রয় বিচার-বিবেচনা করা হলেও তার কাব্য-বিচারের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড অর্থাৎ অন্নদামঙ্গল’ এবং ‘বিদ্যাসুন্দর ই আলােচনায় আসে। সামগ্রিক বিচারে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যকে অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ কাব্য এবং সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যরূপে বিবেচনা করা হয়। ভারতচন্দ্রের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী কবি ছিলেন ষােড়শ শতকের কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তী। ভারতচন্দ্রের পাণ্ডিত্য এবং কবিত্বশক্তি দুইই ছিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি এমন একটা অবক্ষয়ের পরিবেশে বর্তমান ছিলেন যে তিনি প্রধানতঃ কাব্যের অঙ্গ-নির্মাণের সমস্ত পটুত্ব ও কৌশল প্রদর্শনেই বাধ্য হয়েছিলেন। যদি তিনি এই কাব্যে প্রাণ সৃষ্টি করতে পারতেন, তবে তিনি নিঃসন্দেহে প্রাচীন ও মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করতে পারতেন। ভারতচন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই যে, তিনি যুগপরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিলেও তার ব্যক্তিআত্মাটি ছিল যুগ- অতিক্রমী আধুনিক। অধ্যাপক ডঃ সত্রাজিৎ গােস্বামী লিখেছেন, “দেববাদনির্ভর ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যে থেকেও ভারতচন্দ্র বস্তুত ছিলেন মুক্তপ্রাণ নাস্তিক। যদিও সেই নাস্তিকতাকে তীব্ররূপে প্রকাশ করে তিনি সমাজ-বিপ্লব ঘটাতে চান নি। রাজন্য-অভিজাত শ্রেণীর অন্নপুষ্ট হলেও তিনি এই শ্রেণীটির দুর্বলতা ও কপট স্বার্থপরতা সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলেন। অর্থাৎ ভারতচন্দ্রের কবিআত্মাটি ছিল যুগের মধ্যে থেকেও যুগােত্তীর্ণ, বিশেষ শ্রেণীভুক্ত হলেও স্বশ্রেণীর নির্মোহ সমালােচক।”
ভারতচন্দ্র ভাষা-ব্যবহারে দক্ষতা :
কবির মাতৃভাষা বাঙলা। তিনি চতুষ্পাঠিতে সংস্কৃত এবং মুন্সীর কাছে ফারসী ভাষায় পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘকাল উত্তর ভারত পরিভ্রমণ সূত্রে তিনি হিন্দী এবং মৈথিলি ভাষাতেও যে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তার প্রমাণের অভাব নেই। বস্তুতঃ বিভিন্ন ভাষায় পাণ্ডিত্যের বিচারে সেকালে ভারতচন্দ্রের জুটি ছিল না। এই পাণ্ডিত্যের সঙ্গে কবিত্বশক্তির সংযােগে ভারতচন্দ্র যে কাব্য রচনা করেন, তার উৎকর্ষ অবশ্য স্বীকার্য। তিনি সংস্কৃত, ফারসী, হিন্দী ও বাঙলা ভাষার মিশ্রণে যে পদ রচনা করেন, তাতে শ্রুতিমাধুর্য কিম্বা অর্থবােধের কোন হানি ঘটেনি।
কবি অকৃপণ হস্তেই অন্নদামঙ্গল ও বিদ্যাসুন্দর কাব্যে রস পরিবেশন করেছেন, হয়তাে সে রস কোথাও একটু কড়াপাক, কোথাও একটু গেঁজে গেছে। কাব্যে যথার্থ রসের সৃষ্টিতে যে গীতিপ্রাণতার সৃষ্টি হয়, তার দৃষ্টান্তও ভারতচন্দ্রের কাব্যে দুর্লভ নয়। তার কাব্যের বিভিন্ন অধ্যায়ের গােড়ায় তিনি কিছু কিছু বিষ্ণু পদ সৃষ্টি করেছেন, সেগুলিকে বৈষ্ণব পদের সমকক্ষ বলেই জ্ঞান করা হয়। অনেকেই এগুলিতে আধুনিক গীতিকবিতার পূর্বাভাষ লক্ষ্য করে থাকেন। ডঃ আশুতােষ ভট্টাচার্য বলেন, “যে গীতি-সুর ও গীতিরস ইতিপুর্বে মঙ্গলকাব্যের কাহিনীর অস্তর্নিবিষ্ট হইয়াছিল, ভারতচন্দ্রের মধ্যে আসিয়া তাহাই স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীন পরিচয় লাভ করিল।”
শব্দশিল্পে ভারতচন্দ্র যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তার তুলনা সেকালে দুর্লভ। তিনি তার কাব্যকে ছন্দে অলঙ্কারে রাজসভার উপযােগী করেই সাজিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ