অধিকারের সংজ্ঞা দাও। অধিকারের বিভিন্ন রূপ বা ধরন গুলি  সম্পর্কে আলোচনা কর

অধিকারের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বোসাংকে বলেছেন, “অধিকার হল সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযুক্ত দাবি।” বাকারের মতে, অধিকার হল যথাসম্ভব সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী সর্বাধিক পরিমাণ সেইসব বাহ্যিক সুযোগসুবিধা, যেগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়। সুতরাং, কোনো সুযোগসুবিধা বা দাবিকে তখনই অধিকার বলা যাবে, যদি তা দুটি শর্ত পূরণ করে। 

১. এইসব সুযোগসুবিধা বা দাবি প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক হবে এবং

 ২. এটি রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হবে। অধ্যাপক ল্যাস্কিও এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, অধিকার হল সমাজজীবনের সেইসব অবস্থা, যেগুলি ছাড়া ব্যক্তির প্রকৃষ্টতম বিকাশ সম্ভব হয় না। সমাজসচেতনতা থেকেই অধিকারবোধের উৎপত্তি বলে গিলক্রিস্ট অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

অধিকার কাকে বলে, অধিকারের সংজ্ঞা, প্রকৃতি, অধিকারের প্রকারভেদ

সূচীপত্র :-  প্রধানত নিম্নলিখিত দুটি দিক থেকে অধিকারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে 

প্রথমত, অধিকার একটি সামাজিক ধারণা: অধিকার হল একটি সামাজিক ধারণা। কারণ, সমাজজীবনের বাইরে অধিকারের কথা কল্পনাই করা যায় না। গ্রিনের মতে, “পরস্পরের প্রয়োজন সম্পর্কে নৈতিক চেতনাসম্পন্ন সমাজ ছাড়া অধিকারের অস্তিত্ব থাকতে পারে না।” সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজের মুখসুবিধার সঙ্গে সঙ্গে অপরের সুখসুবিধার কথাও ভাবতে হয়। এইভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি যখন পারস্পরিক সুযোগসুবিধা সম্পর্কে সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণ করে, তখনই সমাজে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। 

দ্বিতীয়ত, অধিকার একটি আইনগত ধারণা: অধিকার হল একটি আইনগত ধারণা। কারণ, অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হওয়ার ফলে সমাজের মধ্যে সকলের আত্মবিকাশের পথ প্রশস্ত হয়। এদিক থেকে অধিকারকে আইনগত ধারণা বলাই সংগত। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্র নাগরিককে কী পরিমাণ অধিকার প্রদান ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, তার ওপর নির্ভর করবে সে কতখানি আনুগত্য তাদের কাছে দাবি করতে পারবে। সুতরাং রাষ্ট্র অধিকার সৃষ্টি করতে পারে না। তাকে স্বীকার ও সংরক্ষণ করে মাত্র। রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত না হলে। অধিকারের কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকে না—এই যুক্তি মেনে নিতে তিনি রাজি নন। তাঁর মতে, জনগণের এমন কতকগুলি ন্যায়সংগত দাবি থাকে, যেগুলি রাষ্ট্র স্বীকার করে না। কিন্তু সেইসব অধিকারকে মূল্যহীন বা ভিত্তিহীন বলে কোনোমতেই বলা যায় না। তিনি মনে করেন যে, কতকগুলি স্বীকৃত এবং কতকগুলি অস্বীকৃত অথচ স্বীকারযোগ্য অধিকারসমষ্টির মাঝে রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে। স্বীকারযোগ্য অধিকারগুলিকে রাষ্ট্র যতখানি স্বীকৃতি দিতে পারবে, ততখানি সে তার অস্তিত্বের সার্থকতা প্রতিপন্ন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু শ্রেণিবিভক্ত সমাজে স্বার্থের সংঘর্ষ অনিবার্যভাবে অধিকারের প্রশ্নে বিরোধ সৃষ্টি করে। একদিকে যেমন ধনিকশ্রেণি মুনাফা লাভ করার অবাধ অধিকার দাবি করে, অন্যদিকে তেমনি শ্রমিকশ্রেণি দাবি করে উপযুক্ত মজুরি। এরুপ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র শ্রেণি-নিরপেক্ষভাবে প্রতিটি ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করতে পারে না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের অধিকারের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়। তাই ধনতান্ত্রিক সমাজে নীতি হিসেবে স্বীকৃত হলেও মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

অধিকারকে সাধারণভাবে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, যথা—
১. নৈতিক অধিকার এবং
২. আইনগত অধিকার।
সামাজিক ন্যায়নীতিবোধের ওপর ভিত্তি করে যেসব অধিকার গড়ে উঠেছে, সেগুলিকে নৈতিক অধিকার বলে। এইসব অধিকার ভঙ্গের অপরাধে রাষ্ট্র কোনোরুপ শাস্তি বিধান করতে পারে না। নৈতিক অধিকার ভঙ্গকারী কেবল নিজ বিবেকের দংশন অনুভব করে এবং সমাজ কর্তৃক নিন্দিত হয়। কিন্তু যেসব অধিকার আইন কর্তৃক স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়, সেগুলিকে আইনগত অধিকার বলা হয়। আইনগত অধিকারসমূহকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়-

ক. পৌর অধিকার,

খ. সামাজিক অধিকার,

গ. রাজনৈতিক অধিকার এবং

ঘ. অর্থনৈতিক অধিকার।

ক. পৌর অধিকারসমূহ (Civil Rights)

যেসব সুযোগসুবিধা ছাড়া মানুষ সভ্য ও সামাজিক জীবনযাপন করতে পারে না এবং যে-সুযোগের অভাবে ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশসাধন ব্যাহত হয়, সেইসব সুযোগসুবিধাকে পৌর অধিকার বলা হয়। বর্তমানে নিম্নলিখিত পৌর অধিকারগুলিকে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ বলে মনে করা হয় ।

জীবনের অধিকারঃ

জীবনের অধিকার অর্থাৎ বেঁচে থাকার অধিকার হল মানুষের মৌলিক অধিকার। জীবনের নিরাপত্তা না থাকলে অন্যান্য অধিকার ভোগ করা কখনোই সম্ভব নয়। জীবনের অধিকার বলতে
আত্মরক্ষার অধিকার এবং আত্মরক্ষার প্রয়োজনে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের অধিকারকেও বোঝায়।

চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকারঃ

স্বাধীন চিন্তার অধিকার মানুষের মানসিক ও নৈতিক অগ্রগতির ভিত্তি। চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার বলতে বাকস্বাধীনতা ও মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতাকে বোঝায়। এরূপ স্বাধীনতা হল গণতান্ত্রিক সরকারের মূলভিত্তি। এই অধিকার সরকারকে স্বৈরাচারী হতে বাধা দেয়। অবশ্য সদাচার, শালীনতা, রাষ্ট্রীয় সংহতি ও নিরাপত্তা প্রভৃতি রক্ষার জন্য রাষ্ট্র এই অধিকারের ওপর যুক্তিসংগত বাধানিষেধ আরোপ করতে পারে। তবে বাধানিষেধগুলি যুক্তিসংগত কি না, তা বিচার করার অধিকার নিরপেক্ষ আদালতের থাকা উচিত।

ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারঃ

স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং সংঘ বা সমিতি গঠন করার অধিকার মানুষের ব্যক্তিসত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয়। কোনো ব্যক্তিকে বিনাবিচারে আটক করা বা ইচ্ছামতো গ্রেপ্তার করা প্রভৃতি এই অধিকারের বিরোধী। তবে জাতীয় বিপদের দিনে অর্থাৎ।জরুরি অবস্থার সময় জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে এই অধিকারটিকে ক্ষুণ্ন করা যেতে পারে বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, কোনো অবস্থাতেই এই অধিকারটিকে সংকুচিত করা উচিত নয়।

কার্যের অধিকারঃ

জীবনের সঙ্গে জীবিকার প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই জীবনধারণের জন্য প্রতিটি কর্মক্ষম ব্যক্তির কার্যে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার রয়েছে। শুধু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলেই রাষ্ট্রের কর্তব্য শেষ হয় না; দক্ষতা অনুযায়ী উপযুক্ত মজুরি লাভের অধিকারকেও স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।

সম্পত্তির অধিকারঃ

সম্পত্তির অধিকার বলতে বোঝায় ব্যক্তির সম্পত্তি অর্জন ও রক্ষা এবং সম্পত্তি ক্রয়বিক্রয় ও ভোগ করার অধিকার। নিজ সম্পত্তি দান ও হস্তান্তর করার অধিকারও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সম্পত্তির অধিকার থাকা উচিত কি না, তা নিয়ে সমাজতন্ত্রবাদীদের সঙ্গে ধনতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসীদের যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে।

পরিবার গঠনের অধিকারঃ

পরিবার গঠনের অধিকার বলতে বিবাহের মাধ্যমে পরিবার গঠন করার সুযোগসুবিধাকে বোঝায়। পিতামাতা, ভাইবোন, সন্তানসন্ততি এবং পত্নীকে নিয়ে একটি সুখী পরিবার গঠন মানুষের পৌর অধিকার।

ধর্মের অধিকারঃ

স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার করার অধিকার মানুষের একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আমার ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচারের অধিকার আছে বলে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের ওপর অত্যাচার করার কোনো অধিকার আমার নেই। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি যাতে অন্য ধর্মে হস্তক্ষেপ না ক’রে স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার করতে পারে, সেদিকে রাষ্ট্র সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখে।

শিক্ষার অধিকারঃ

সভ্য সমাজ গঠনের কাজে শিক্ষার ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা ছাড়া মানুষ কখনই আত্মসচেতন ও সমাজসচেতন হয়ে উঠতে পারে না। সর্বোপরি, শিক্ষাই মানুষের বৃত্তি, সামাজিক।মর্যাদা, চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রভৃতি বিকাশে সহায়তা করে। তাই শিক্ষার অধিকার স্বীকার করে নেওয়া প্রতিটি রাষ্ট্রের।কর্তব্য।

চুক্তির অধিকারঃ

যে-কোনো ব্যক্তি ন্যায়সংগতভাবে একে অপরের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করার অধিকারী। এই চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দেশের শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতি সাধিত হতে পারে। কিন্তু অসামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত থাকার যে-কোনো চুক্তিকে রাষ্ট্র বেআইনি বলে ঘোষণা করতে সক্ষম।

সাম্যের অধিকারঃ

আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং আইন কর্তৃক সমানভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকারকে সাম্যের অধিকার বলে। জাতিধর্মবর্ণ, স্ত্রীপুরুষ ও ধনীনির্ধন-নির্বিশেষে সকলকেই আইন সমদৃষ্টিতেদেখবে।
উপরিউক্ত পৌর অধিকারগুলির কোনোটিই অবাধ ও নিরুঙ্কুশ হতে পারে না। প্রতিটি অধিকার ভোগের সঙ্গে কর্তব্যপালন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কর্তব্য পালন না করলে কোনো ব্যক্তি নিজ অধিকার দাবি করতে পারে না।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Scroll to Top

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading