NLM
ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রক বিভিন্ন সময়ে বয়স্কদের শিক্ষার জন্য নানা ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী হল জাতীয় বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচী (NAEP) এবং জাতীয় স্বাক্ষরতা মিশন (NLM)। এই দুটি কর্মসূচী দেশের বয়স্ক জনগণের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। এই টীকায় NAEP এবং NLM-এর মূল উদ্দেশ্য, কার্যক্রম এবং তাদের প্রভাবের উপর আলোচনা করা হবে।
জাতীয় বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচী (NAEP)
প্রেক্ষাপট ও প্রবর্তন:
১৯৭৮ সালে ভারতের শিক্ষা মন্ত্রক জাতীয় বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচী (NAEP) চালু করে। এই কর্মসূচীর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বয়স্ক জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করা, বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা জীবনে কখনোও কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি বা অল্প শিক্ষিত। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যেখানে প্রধান লক্ষ্য ছিল বয়স্ক জনগণকে মৌলিক শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
কর্মসূচীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
NAEP-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল বয়স্কদের শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, বিশেষ করে অল্প শিক্ষিত এবং পিছিয়ে পড়া জনগণের মধ্যে। এটি তিনটি মূল উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেছিল:
- স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি: NAEP-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাক্ষরতা হার বৃদ্ধি করা, যা তখন অনেক নিচে ছিল। এই কর্মসূচীটি বয়স্কদের মধ্যে মৌলিক শিক্ষার প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে তাদের স্বাক্ষরতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চালায়।
- আত্মবিশ্বাস ও ক্ষমতায়ন: NAEP-এর মাধ্যমে বয়স্ক জনগণ তাদের ক্ষমতা এবং আত্মবিশ্বাসের উন্নয়ন ঘটানোর সুযোগ পায়। এটি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
- সমাজে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা: বয়স্কদের শিক্ষার মাধ্যমে তাদের সামাজিক অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতাবান হতে সাহায্য করা, যাতে তারা সমাজে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারে।
কর্মসূচীর কার্যক্রম:
NAEP-এর কার্যক্রম প্রধানত গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চলের বয়স্ক জনগণের জন্য ছিল। এই কর্মসূচীটির আওতায় বিভিন্ন শিবির, প্রশিক্ষণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। কর্মসূচীটি প্রধানত গ্রামে, শহরের সীমানার বাইরে, এবং পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলিতে বেশি কার্যকর ছিল।
NAEP-এর আওতায় পাঠ্যক্রমে সাধারণ ভাষা, গণনা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য শিক্ষা, কৃষি, এবং বিভিন্ন পেশাগত দক্ষতা বিষয়ক শিক্ষা প্রদান করা হত। এটি এমন একটি ধারণা ছিল, যেখানে শিক্ষা শুধু শ্রেণীকক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি গ্রামের জীবনযাত্রার বাস্তবতার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এছাড়া, NAEP-এর আওতায় নারীদের জন্য বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল।
NAEP-এর প্রভাব:
NAEP-এর বাস্তবায়ন ভারতের বয়স্ক জনগণের মধ্যে শিক্ষা প্রসারে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। এই কর্মসূচীটির ফলে বহু বয়স্ক নাগরিক শিক্ষা লাভ করেছেন এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। গ্রামীণ ভারতের অনেক অঞ্চলে NAEP শিক্ষার জোরালো প্রসার ঘটাতে সাহায্য করেছে। এ ছাড়া, এটি বয়স্কদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করেছে।
জাতীয় স্বাক্ষরতা মিশন (NLM)
প্রেক্ষাপট ও প্রবর্তন:
ভারতে, স্বাক্ষরতার হার তখনও ছিল অতি নিম্ন, বিশেষত গ্রামীণ এলাকাগুলিতে। এই সমস্যা সমাধান করতে ১৯৮৮ সালে ভারতের সরকার “জাতীয় স্বাক্ষরতা মিশন” (NLM) প্রবর্তন করে। NLM-এর মূল লক্ষ্য ছিল ভারতের জনগণের মধ্যে স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি করা, এবং বিশেষ করে বয়স্ক জনগণের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো। NLM কর্মসূচীর উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি জাতি তৈরি করা, যেখানে জনগণ শিক্ষিত এবং নিজেদের জীবনের মান উন্নত করতে সক্ষম হয়।
কর্মসূচীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
NLM-এর উদ্দেশ্য ছিল দেশের সারা দেশে স্বাক্ষরতা প্রচার করা, যাতে প্রতিটি নাগরিক মৌলিক শিক্ষা পেতে পারে। এর লক্ষ্য ছিল:
- গ্রামীণ এবং দরিদ্র জনগণের জন্য স্বাক্ষরতা নিশ্চিত করা: NLM-এর মূল লক্ষ্য ছিল বিশেষ করে গ্রামীণ, নিরক্ষর এবং দরিদ্র জনগণের মধ্যে স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি করা।
- নারী শিক্ষার প্রসার: NLM-এর আওতায় নারী শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এতে মহিলাদের শিক্ষা প্রদান এবং তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা ছিল।
- দ্বিতীয় সারির শিক্ষা: বয়স্কদের এবং যুবকদের দ্বিতীয় সারির শিক্ষা প্রদান করে, যাতে তারা পুনরায় শিক্ষার মাধ্যমে আত্মনির্ভর হতে পারে।
- অলাভজনক ও অস্থায়ী শিক্ষার ব্যবস্থা: NLM-এর আওতায় নানা ধরনের অলাভজনক শিক্ষার ব্যবস্থা যেমন রাতের স্কুল, মোবাইল পাঠাগার এবং সাধারণ জ্ঞান ক্লাস তৈরি করা হয়েছিল, যাতে যারা প্রথমে শিক্ষিত হতে পারেননি, তারা পুনরায় শিক্ষা লাভ করতে পারেন।
কর্মসূচীর কার্যক্রম:
NLM-এর কার্যক্রম ছিল ব্যাপক। বিভিন্ন রাজ্য সরকারের সাহায্যে এটি তৃণমূল স্তরে কার্যকর করা হয়েছিল। গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষক পাঠান, পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে সাধারণ ভাষা, গণনা, বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং জীবন দক্ষতা শিক্ষা দেওয়া হতো।
এটি কয়েকটি স্তরে কাজ করেছিল:
- মৌলিক শিক্ষা: বয়স্কদের জন্য বিশেষ শিক্ষণ পদ্ধতি ছিল, যেখানে তারা মৌলিক ধারণা শিখতে পারতেন।
- শিক্ষার জন্য সচেতনতা: গ্রামীণ এলাকায় শিবির, সেমিনার ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হত, যাতে লোকেরা শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারে।
- পরবর্তী শিক্ষা: যারা অল্প শিক্ষিত ছিলেন, তাদের জন্য আরও উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
NLM-এর প্রভাব:
NLM-এর ফলে ভারতে স্বাক্ষরতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ জনগণের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, এবং বয়স্ক জনগণ স্বাক্ষরতা অর্জন করার মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নত করতে সক্ষম হয়েছেন। মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং নারী সমাজের উন্নতিতে NLM-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
NAEP ও NLM-এর মধ্যে পার্থক্য
যদিও NAEP এবং NLM দুটোই বয়স্ক শিক্ষা এবং স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত কর্মসূচী, তবে তাদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে:
- প্রতিষ্ঠার সময়: NAEP ১৯৭৮ সালে এবং NLM ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
- কেন্দ্রীয় লক্ষ্য: NAEP-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল বয়স্কদের মৌলিক শিক্ষা প্রদান এবং তাদের ক্ষমতায়ন করা, যেখানে NLM-এর লক্ষ্য ছিল দেশের সামগ্রিক স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে গ্রামীণ ও দরিদ্র জনগণের মধ্যে।
- কর্মসূচীর গঠন: NAEP সাধারণত গ্রামীণ এলাকাগুলিতে সক্রিয় ছিল এবং বয়স্কদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী পাঠ্যক্রম এবং প্রশিক্ষণ আয়োজন করেছিল। NLM ছিল একটি বৃহত্তর কর্মসূচী, যা স্বাক্ষরতা এবং শিক্ষা প্রসারের জন্য নানান উদ্যোগ নিয়েছিল।
উপসংহার
NAEP এবং NLM, দুটোই ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই কর্মসূচীগুলি ভারতের বয়স্ক জনগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করেছে। NAEP বয়স্কদের জন্য মৌলিক শিক্ষা প্রদান এবং তাদের সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সহায়ক ছিল, যেখানে NLM স্বাক্ষরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছে। এই দুটি কর্মসূচী ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।