চৈতন্য পরবর্তী কালের একজন বিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা জ্ঞানদাস চৈতন্য পরবর্তীকালের একজন সুবিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা জ্ঞানদাস । বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নিকট কাঁদরা গ্রামে জ্ঞানদাসের জন্ম হয় আনুমানিক ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে। চৈতন্য-উত্তর যুগের সোড়শ শতাব্দীর কবি, তিনি বৈষ্ণবগুরু নিত্যানন্দের পণী জাহ্নবী দেবীর শিষ্য ছিলেন । শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা, নৌকাবিলাস ও দানখণ্ড প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানদাস কবিতা লিখেছেন। পূর্বরাগ, আক্ষেপানুরাগ, মান, নিবেদন, রসােদগার, মিলন, বিরহ ও মুরলী শিক্ষা-বিষয়ক পদগুলিতে জ্ঞানদাসের কবিপ্রতিভা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে দ্যুতিময়। এই সময়ে বৈষ্ণব পদ সাহিত্যে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দ দাস—এই চারজন বৈষ্ণব পদসাহিত্যে প্রতিনিধি স্থানীয় কবি ছিলেন । একবার খেতুরীর বৈষ্ণব কবি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং এখানে গোবিন্দ দাস ও বলরাম দাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। বলা হয় তিনি প্রাচীন কবি চণ্ডীদাস রচনা ধারা- কে অনুসরণ করে পদ রচনা কোরতেন এবং চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি । তবে তিনি চণ্ডীদাসকে হুবহু অনুসরণ করেননি।দুজনের রচনার মধ্যে নিবিড় একাত্মতা পরিদৃষ্ট হয়। প্রেমের আত্মনিবেদনে উভয়েই মানবজীবনের সীমা ছাড়িয়ে ভাবালোকের উর্ধ্বলোকে বিচরণ করেন এই কারনে জ্ঞানদাসকে চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলা হয় ।চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস উভয়েই ভাবতন্ময় কবি। কল্পনায় দুজনেই রাধার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। চণ্ডীদাসের সঙ্গে জ্ঞানদাসের দুটি পার্থক্য (ক) চণ্ডীদাস তৰ্গত, জ্ঞানদাস আত্মগত। (খ) চণ্ডীদাস বৈষ্ণবতত্ত্বের আধারে পদ রচনা করেননি,কিন্তু জ্ঞানদাস করেছেন । জ্ঞানদাসের কবি কৃতিত্বের পরিচয় জ্ঞানদাস একই সঙ্গে কবি ও শিল্পী। কবির ভাবাবেগকে শিল্পীর সুক্ষ্ম কারুকর্মে রূপ দিয়েছেন।নায়কনায়িকার রূপ বর্ণনা, প্রেমাবেগের তীব্র জ্বালা ও আর্তি, রূপবিভোরতা ও মিলন ব্যাকুলতাকে জ্ঞানদাস অনায়াসেই শিল্প শ্রীমণ্ডিত করে তুলেছেন। ভাব ও রূপের যুগলমূর্তি গঠনে তিনি অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী। জ্ঞানদাস রচিত কয়েকটি পদের শ্রেষ্ঠ পঙক্তি (ক) আলো মুঞি জানো না, (খ) কী মোহন নন্দ কিশোর, (গ) চূড়াটি বান্ধিয়া উচ্চ, (ঘ) তুমি কী জানো সই, (ঙ) দেইখ্যা আসিলাম তারে সই (চ) বঁধু তোমার গরবে গরবিনী আমি, (ছ) মনের মরম কথা, (জ) মেঘ যামিনী অতি ঘন আন্ধিয়ার, (ঝ) সাজ সাজ বলিয়া, (ঞ) সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু প্রভৃতি । নিম্নে জ্ঞানদাসের কিছু বিখ্যাত পদ নিয়ে আলোচনা করা হলো পদকর্তা জ্ঞানদাস। আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের পদ। এই পদটিতে রাধার প্রেমযন্ত্রণার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে। পদকর্তার নাম জ্ঞানদাস। পূর্বানুরাগ পর্যায়ের পদ। জ্ঞানদাসের রূপবর্ণনায় রোমান্টিক সৌন্দর্য পিপাসা ও হৃদয়াতি বিস্ময়কর আবেগ রক্তরাগে রূপায়িত হয়েছে। জ্ঞানদাস বিরচিত একটি বিখ্যাত পদের অংশ বিশেষ। পদটি ‘নিবেদন পর্যায়ের অন্তর্গত। কবি জ্ঞানদাস বিরচিত এই বৈষ্ণব পদটি পূর্বরাগ পর্যায়ভুক্ত। পূর্বরাগের অনুপম হৃদয়াকুলতা ও রূপপিপাসা আলোচ্য পদটিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই পদটিতে জ্ঞানদাসের প্রতিভার যে মূল বৈশিষ্ট্য ‘রোমান্টিকতা’ তার সম্যক প্রকাশ ঘটেছে। রাধার রূপমুগ্ধ যে ছবিটি অঙ্কিত, তা অতুলনীয়। পদটি কবি জ্ঞানদাসের রচনা । এই পদ টির মূলভাব হোল জ্ঞানদাসের এই ধরনের পদে একদিকে বিদ্যাপতির পদের উল্লাস বা সম্ভোগ রস, অন্যদিকে চণ্ডীদাসের বিরহের বেদনা একসঙ্গে এসে মিলেছে। শ্রীমতী রাধা তাঁর প্রেমের যে গভীরতা তা এই পদে অসামান্য দৃঢ়তা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন, যাতে একদিকে আছে সম্ভোগের আনন্দ, অন্যদিকে বিরহের যন্ত্রণা। পদকর্তা কবি জ্ঞানদাস। পদটি মাথুর পর্যায়ের। শ্রীরাধার অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা মথুরার পাষাণ-প্রাচীরে ব্যাহত হয়ে ফিরে আসে। তাঁর সেই ব্যর্থ হাহাকার কবি জ্ঞানদাসের হৃদয়রসে আপ্লুত হয়ে তাঁর রচিত পদের মাধ্যমে বাঙালির বিরহী চেতনার শাশ্বতলোকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতি দুঃখে রাধা বলছেন যে মাধব তার শপথ ভঙ্গ করেছেন এবং আজ-কাল করে কতদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। জ্ঞানদাসের পদ কল্পতরুতে ১৮৬টি ভণিতা আছে। তার মধ্যে ব্রজবুলিতে লেখা পদ ১০৫টি পদ পাওয়া গেছে । তবে সমস্ত পদ গুলো নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয় সেক্ষেত্রেও অন্যান্য পদগুলো নিয়ে বিস্তারিত জানার জন্য আমার পরবর্তী সময়ের পোস্টগুলি দেখতে পারেন অথবা কোন ভাল লেখক এর বই কিনে করতে পারেন। এখানে শুধুমাত্র খুবই আলোচিত কয়েকটা পদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।