১৯ শতকেরপ্রথমার্ধে শিল্পমুক্তকরণ
১৯ শতকের প্রথমার্ধে শিল্পমুক্তকরণ (Industrial Emancipation) শিল্পবিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফল এবং এই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন। এটি কারখানা-ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর বিকাশকে চিহ্নিত করে। যদিও এটি শিল্পোন্নতির এক সোনালী অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, এর ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির শোষণ এবং অসন্তোষকেন্দ্�। শিল্পমুক্তকরণ নিয়ে বিতর্কের মূলে ছিল উৎপাদন ব্যবস্থা, শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নৈতিকতা। এই প্রবন্ধে উল্লিখিত সময়কালীন শিল্পমুক্তকরণ এবং এর সঙ্গে যুক্ত বিতর্ককে একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হবে।
শিল্পমুক্তকরণ: ধারণা ও প্রেক্ষাপট
শিল্পমুক্তকরণ বলতে সেই প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়, যার মাধ্যমে শ্রমিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে উৎপাদনের মাধ্যমগুলিকে পুঁব্যবস্থাবায়িত হয়।
তবে শিল্পমুক্তকরণ শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তসীমাবওকএটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে গভীর প্রভাব ফেলে। গ্রামীণ জীবনব্যবস্থা এবং ছোট ছোট কারুশিল্পভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। শ্রমিকশ্রেণি শহরের কারখানাগুলিতে কাজ করতে বাধ্য হয়, যেখানে তাদের কর্মপরিবেশ ছিল কঠোর এবং অবমাননাকর।
বিতর্কের প্রেক্ষাপট
১৯ শতকের প্রথমার্ধে শিল্পমুক্তকরণ নিয়ে বিতর্কের মূলে ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন বনাম সামাজিক ন্যায়বিচার। বিতর্কটি তিনটি প্রকেন্��কেন্দ্রীভূত ছিল:
১. শ্রমিকশ্রেণির দুরবস্থা
শিল্পমুক্তসমালোচনাআসে বড় সমালোচনা আসে শ্রমিকশ্রেণির দুরবস্থার প্রেক্ষাপটে।
- দীর্ঘ কর্মঘণ্টা: শ্রমিকদের ১২-১৬ ঘণ্টা প্রতিদিন কাজ করতে বাধ্য করা হতো।
- নিম্ন মজুরি: তাদের পারিকমমিক ছিল অত্যন্ত কম, যা তাদের জীবনযাত্রার ন্যূনতম চাহিদা পূরণে অসমর্থ ছিল।
- শিশুশ্রম: শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ১৮৪২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, কয়লা খনি এবং কা�ষণ গুরুতর আকার ধারণ করে।
- স্বাস্থ্যঝুঁকি: কারখানাগুলির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যহানির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২. পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার নৈতিকতা
শিল্পমুক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে, যা শ্রমিকশ্রেণির শোষণ এবং পুঁজিপতিদের মুনাফাপ� লক্ষ্য রেখে পরিচালিত হয়।
- কার্ল মার্কসের দৃষ্টিকোণ: মার্কস তার ‘দাস ক্যাপিটাল’-এ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে শ্রমিকদের “শ্রমশক্তির চুরিকরেন অভিহিত করেন। তিনি মনে করেন, পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের শ্রম থেকে বাড়তি মূল্য (surplus value) অর্জন করে তাদের শোষণ করে।
- অ্যাডাম স্মিথের যুক্তি: অন্যদিকে, অ্যাডাম স্মিথ এবং অর্থনৈতিক উদারনীতির সমর্থকেরা যুক্তি দেনগত উদ্যোগ এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে উৎসাহিত করে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক।
৩. সামাজিক প্রভাব
শিল্পমুক্তকরণ শহুরে জীবনের উত্থান এবং নগরায়ণের সূচনা করলেও, এটি সমাজের উপর কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- পারিবারিক কাঠামোর ভাঙন: গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শহরে শ্রমিকদের স্থানান্তরের ফলে পরিবারের ঐতিহ্যবাহী কাঠামো ভেঙে পড়ে।
- অপরাধ ও অস্থিরতা: শহরাঞ্চলে দরিদ্রদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অপরাধের মাত্রা বাড়তে থাকে।
- মহিলাদের অবস্থান: মহিলারা কারখানাগুলিতে স্বল্প মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হন। এটি পরিবার পরিচালনার ভারসাম্য নষ্ট করে।
প্রতিক্রিয়া এবং সমাধানের প্রচেষ্টা
শিল্পমুক্তকরণের ফলাফল নিয়ে তীব্র অসন্তোষ এবং প্রতিবাদ দেহলোয়। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া হলো:
১. লুডাইট আন্দোলন (Luddite Movement)
১৮১১-১৮১৬ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে যন্ত্রপাতি ধ্বংসের মাধ্যমে শ্রমিকরা তাদের অবস্থার বিরুদ্ধেতাদনে করতেন যে যন্ত্র তাদের কাজ কেড়ে নিয়েছে।
২. চার্টিস্টভোটাধিকারেরদাবিতে Movement)
শ্রমিকদের ভোটাধিকারের দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হয়। এটি শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. আইন প্রণয়ন
শ্রমিকদের দুরবস্থা লাঘব করার জন্য বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়:
- ১৮৩৩ সালের Factory Act শিশুশ্রActমহিলাদেরতা আরোপ করে।
- ১৮৪২ সালের Mines Act মহিলাদের এবং শিশুদের খনির কাজ থেকে বিরত রাখে।
৪. শ্রমিক ইউনিয়ন
এই সময়ে শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্ভব ঘটে, যা পরবর্তীতে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
শিল্পমুক্তকরণের সমালোচনা
শিল্প১.শ্রমিকশ্রেণিরচনা মূলত চারটি দিক থেকে উঠে আসে:
১. শ্রমিকশ্রেণির শোষণ
শিল্পমুক্তকরণের ফলে শ্রমিকরা উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং তাদের শ্রমকে পুঁজির অধীন করা হয়।
২. সামাজিক অসাম্য
পুঁ৩.পরিবেশগতমিকদের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়।
৩. পরিবেশগত প্রভাব
শিল্পায়নের ফলে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বায়ু এবং জল দূষণ এই সময়ের অন্যতম শ্রমিকদেরশুধুহয়ে দাঁড়ায়।
৪. মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়
শ্রমিকদের শুধু একটি শ্রমশক্তি হিসেবে দেখা হয়, যা তাদের মানবিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে।
উপসংহার
১৯ শতকের প্রথমার্ধে শিল্পমুক্তকরণ একদিকে শিল্পবিপ্লবের উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রতিফলন হলেও অন্যদিকে�শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে প্রাসঙ্গিক।