হিউমের আত্মা বিষয়ক মতবাদটি ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর। অথবা, আত্মা সম্পর্কে হিউমের মতবাদ সমালােচনা সহ ব্যাখ্যা কর। অথবা, আত্মা সম্পর্কে হিউমের মতবাদ একটি বিচারমূলক ব্যাখ্যা দাও।

হিউমের আত্মা বিষয়ক মতবাদটি ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন-

মন বা আত্মা সম্পর্কিত সমস্যাটি দর্শনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যা। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন দার্শনিক, মনীষী, জ্যোতিষী মন বা আত্মা কী? মনের স্বরূপ কী? মনের সাথে বস্তুর সম্পর্ক কী? প্রভৃতি নিয়ে আলােচনা করেন। মন সম্পর্কে এ সব গুণীজন ঐকমত্য হতে পারেননি। কেউ কেউ মনকে একটি চিরস্থায়ী সত্তা, কেউ কেউ মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা, কেউ কেউ অতীন্দ্রিয় ও সক্রিয় সত্তা ইত্যাদি বলে অভিহিত করেন। আসলে মন এমন একটি বস্তু যাকে দেখা যায় না, উপলব্ধি করা যায় মাত্র। এ মন বা আত্মার সংজ্ঞা ও সাধারণভাবে বলা যায় যে, মন হলাে এমন কিছু যা নিজের অবস্থা এবং ক্রিয়াগুলাে সম্পর্কে সচেতন। মনের স্বরূপ বা লক্ষণ হলাে চেতনা। যার দ্বারা মনকে জড় ও প্রাণ থেকে আলাদা করা যায়।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ ডেকার্ট ও প্লেটোর মতে, আত্মা একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য। চেতনা হলাে আত্মার প্রধান ধর্ম। বাকর্লির মতে, “আত্মা অবিভাজ্য, অবিমিশ্র ও বিদেহী আধ্যাত্মিক দ্রব্য। বস্তুত মন বা আত্মা হলাে একটি আধ্যাত্মিক চেতন সত্তা, যা আমাদের দেহকে পরিচালনা করে।

মন বা আত্মা সম্পর্কে হিউমের মতবাদঃ পাশ্চাত্য দর্শন অনুসারে মন বা আত্মা হলাে সমার্থক শব্দ। এবং এদের মধ্যে কোনাে তফাৎ নেই। কিন্তু ভারতীয় দর্শনে মন ও আত্মাকে স্বতন্ত্র সত্তা বলে স্বীকার করা হয়েছে। আবার আদিম যুগে মানুষ মন বা আত্মাকে দেহের ছায়াময় প্রতিরূপ বা দেহাশ্রিত সত্তা বলে ধরে নেয় যা ঘুমন্ত অবস্থায় বা মৃত্যুকালে দেহকে ত্যাগ করতে পারে এবং মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে পারে। অবশ্য আত্মার যথাযথ স্বরূপ জানতে হলে মন ও চেতনা সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। অনেকে মন ও চেতনাকে সমর্থক মনে করলেও আসলে এরা সমর্থক নয়। চেতনা হলাে মনের প্রধান বৈশিষ্ট্য যার সাহায্যে মনকে জড় ও প্রাণ থেকে আলাদা করা যায়। আর এ চেতনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে অনেকে মনের সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেন। অনেকের মতে, মন বলতে মনের তিনটি দিক বা মানসিক প্রক্রিয়াকে বুঝায় এবং এগুলাে হচ্ছে- চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা। অনেকে বলেন, মন হলাে এক স্থায়ী অপরিবর্তনীয় একটি মৃত আধ্যাত্মিক ঐক্যের সম্বন্ধ, যা নিজের স্বাতন্ত্রকে বজায় রেখে তিনটি মানসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের প্রকাশ করে। অধ্যাপক এ মতিন তার ‘An outline, of philosophy’ গ্রন্থে বলেন, একজন ব্যক্তির কাছে মন বা আত্মা দেহাতিরিক্ত সঙ্গ হিসাবে আবির্ভূত হয়। সে তার ভেতর এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি, চিন্তা, কল্পনা, ইচ্ছা অনুভব করে এবং এসবের সমন্বয়ই হচ্ছে মন বা আত্মা। হিউম একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। তার মতে, অভিজ্ঞতাই জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায়। যার অভিজ্ঞতা নেই তার অস্তিত্বও নেই । আর অভিজ্ঞতার আলােকেই হিউম আত্ম সত্তা বিষয়ক মতবাদ ব্যাখ্যা করতে আগ্রহী হয়েছেন। নিম্নে হিউমের আত্মা সম্পর্কিত মতবাদ আলােচনা করা হলাে-

(১) আত্মার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে নাঃ অভিজ্ঞতায় আমরা কোনাে অপরিবর্তিত আত্মার সাক্ষাৎ পাই না। অভিজ্ঞতায় আমরা যে আত্মার সাক্ষাৎ পাই তা হলাে আমাদের মানসিক বৃত্তিগুলাের সমষ্টি, সংবেদন, অনুভূতি ইচ্ছা প্রভৃতি নিয়ত পরিবর্তনশীল মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা বা প্রবাহ। এই মানসিক প্রক্রিয়াগুলাে পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এ বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়াগুলাের মাঝে ঐক্য সৃষ্টি করার জন্য মন বা আত্মার অস্তিত্বের কোনাে প্রয়ােজন নেই।

(২) মন বা আত্মা হলাে সংবেদনসমূহের সমষ্টিঃ বার্কলির মতাে হিউমও দ্রব্যের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণের ওপর নির্ভরশীল এ কথা মেনে নিয়ে দেখালেন যে, আত্মারূপদ্রব্যের অস্তিত্বের প্রত্যক্ষণ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে হিউমের মত যে, আমার দিক থেকে যখনই আমি অন্তরঙ্গভাবে আমার মধ্যে প্রবেশ করি, আমি সর্বদা কোনাে না কোনাে সংবেদন পাই, কখনাে গরম, কখনাে ঠাণ্ডা বা শৈত্য, কখনাে আলাে, কখনাে ছায়া, কখনাে ভালােবাসা, কখনাে বিদ্বেষ, কখনাে দুঃখ, কখনাে সুখ। আমি কখনাে কোনাে সংবেদন ছাড়া কিছু প্রত্যক্ষ করি না। সুতরাং মন হচ্ছে কেবল সংবেদনের সমষ্টি। এ কথা বলাই যথার্থ।

(৩) পরিবৰ্তনশীল সংবেদন অনুভূতি ও ধারণার ধারক বাহকই মনঃ হিউম মন বা আত্মাকে একটি রঙ্গমঞ্চের সাথে তুলনা করেছেন, সেখানে একের পর এক বিভিন্ন সংবেদনের আবির্ভাব ঘটছে। মঞ্চের ওপর চলাফেরা করছে। তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, হিউম মুলত মানুষের একেক সময়ে একেক রকম আচরণকে নাটক বলে অভিহিত করেছে এবং এটা মন নামক দ্রব্যটি পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চে এই রঙ্গ করে থাকে। তাই বলা যায় পরিবর্তনশীল সংবেদন, অনুভূতি, ও ধারণার পরম্পরই মন বা আত্মা। তা ছাড়া হিউম বলেন, কোনাে মানুষই বিভিন্ন সংবেদনের সমষ্টি বা সংগ্রহ ছাড়া অতিরিক্ত কিছু নয়। এ সংবেদনগুলাে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে একের পর এক অনুগমন করে এবং এগুলাে নিয়ত পরিবর্তনশীল।

(৪) অনুষঙ্গের নিয়মে সংবেদনসমূহের ঐক্যবদ্ধতাঃ হিউমের মতে, অনুষঙ্গের নিয়ম দ্বারা সংবেদনগুলাে ঐক্যবদ্ধ হয়। অনুষঙ্গের নিয়ম তিন রকম, যথা: (ক) সাদৃশ্য নিয়ম, (খ) সান্নিধ্য নিয়ম ও (গ) পারম্পর্য নিয়ম। যেসব অভিজ্ঞতার মধ্যে সাদৃশ্য আছে এবং যেগুলাে একসঙ্গে অনেকবার ঘটে থাকে, যেগুলাে পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে এবং এক অভিজ্ঞতা আরেকটি অভিজ্ঞতাকে স্মৃতিতে জাগরিত করে। এভাবে অনুষঙ্গ নিয়মগুলাে অভিজ্ঞতার সাধারণ সংগঠনের জন্য দায়ী হয় এবং আমরা যাকে আত্মা বলি তা হলাে এরূপ অভিজ্ঞতাগুলাের সমষ্টিমাত্র যারা অনুষঙ্গের কোনাে বিশেষ নিয়মে শাসিত হয়। এভাবে রাজ্যের শব্দ সর্বদা বিদ্যুৎ চমকাতে দেয়ার সাথে জড়িত। যখনই বিদ্যুৎ চমকাতে দেখি আমরা তখনই বজ্রের শব্দের জন্য তৈরী হই।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading