‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে শ্রেণিচরিত্র হিসেবে দিব্যনাথের সার্থকতা বিচার করো
‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে দিব্যনাথ চরিত্রটি শ্রেণিচরিত্র হিসেবে অত্যন্ত সার্থকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তার চরিত্রের মাধ্যমে মহাশ্বেতা দেবী সমাজের শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্য, ক্ষমতার গঠনতন্ত্র এবং সামাজিক সংকটের একটি গভীর চিত্র তুলে ধরেছেন।
দিব্যনাথের শ্রেণিচরিত্র হিসেবে সার্থকতা:
১. সামাজিক অবস্থান ও ক্ষমতার প্রতীক:
দিব্যনাথ চরিত্রটি উপন্যাসে উচ্চবর্ণের এক ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত। তিনি একজন জমিদার এবং তাঁর সামাজিক অবস্থান তার চরিত্রের মূল ভিত্তি। দিব্যনাথের এই উচ্চ সামাজিক অবস্থান তার ক্ষমতা, বিত্ত-বৈভব এবং সমাজের নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। তার মাধ্যমে সমাজের শাসকশ্রেণির বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব প্রকাশিত হয়, যা সাধারণ মানুষের জীবন এবং সংগ্রামকে প্রভাবিত করে।
২. শোষণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার:
দিব্যনাথ চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের শোষণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি স্পষ্ট চিত্র উঠে আসে। তাঁর জমিদারি ব্যবস্থা এবং জমিদারির দ্বারা সাধারণ মানুষের উপর আরোপিত নানা চাপ, যেমন অত্যধিক কর, নির্যাতন এবং শোষণ, তাঁর চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। দিব্যনাথের ক্ষমতার অপব্যবহার ও শোষণের মাধ্যমে মহাশ্বেতা দেবী সমাজের অনাচার এবং বৈষম্যকে চিহ্নিত করেছেন।
৩. চরিত্রের দ্বৈততা:
দিব্যনাথের চরিত্রে একটি দ্বৈততা বিদ্যমান—একদিকে তিনি সমাজের উচ্চবর্ণের একজন প্রতীক, আরেকদিকে তাঁর নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব ও সংকট রয়েছে। তাঁর ক্ষমতা এবং অবস্থান সমাজে তাকে একটি বিশেষ মর্যাদা প্রদান করলেও, তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে সংকট এবং দুঃখে ভুগছেন। এই দ্বৈততা তাঁর চরিত্রকে আরও জটিল ও বাস্তবমুখী করে তুলেছে।
৪. সমাজের শোষণমূলক কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব:
দিব্যনাথ চরিত্রটি উপন্যাসের মাধ্যমে সমাজের শোষণমূলক কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে। তাঁর জমিদারির মাধ্যমে তিনি যে শোষণ এবং বৈষম্য তৈরি করেছেন, তা একটি বৃহত্তর সামাজিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর চরিত্রের মাধ্যমে মহাশ্বেতা দেবী সমাজের অন্ধকার দিক এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাবের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
৫. মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের দিকনির্দেশ:
দিব্যনাথের চরিত্রটি মায়ের সাথে তার সম্পর্কের মাধ্যমে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। তাঁর মা সুজাতা একজন সংগ্রামী নারী, যিনি তার ছেলের সামাজিক অবস্থান এবং ক্ষমতার শোষণকে মেনে নিতে পারেন না। দিব্যনাথের মা তাঁর সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেন এবং তাঁর সন্তানদের প্রতি যে নির্দিষ্ট প্রত্যাশা থাকে, তা তাঁর চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৬. চরিত্রের প্রভাব ও সমাজের প্রতিক্রিয়া:
দিব্যনাথের চরিত্র সমাজের অন্যান্য চরিত্রদের উপর একটি বিশাল প্রভাব ফেলে। তাঁর কর্মকাণ্ড এবং সিদ্ধান্তগুলি সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই প্রভাবের মাধ্যমে মহাশ্বেতা দেবী সমাজের শোষণ, অসাম্য এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
৭. শ্রেণী বৈষম্য ও সামাজিক পরিবর্তন:
দিব্যনাথের চরিত্র সমাজের শ্রেণী বৈষম্যের একটি স্পষ্ট প্রতীক। তাঁর জীবনের মাধ্যমে মহাশ্বেতা দেবী শ্রেণী বৈষম্য এবং সামাজিক পরিবর্তনের গুরুত্বকে তুলে ধরেছেন। দিব্যনাথের চরিত্রের মাধ্যমে এটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে যে সমাজের উচ্চবর্ণ শ্রেণীর ক্ষমতা এবং অবস্থান সাধারণ মানুষের জন্য কেমন ক্ষতিকর হতে পারে।
উপসংহার:
দিব্যনাথ চরিত্রটি ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে শ্রেণিচরিত্র হিসেবে একটি অত্যন্ত সার্থক এবং গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তার মাধ্যমে সমাজের উচ্চবর্ণ শ্রেণির ক্ষমতা, শোষণ, এবং বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর দ্বৈততা, শোষণমূলক কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব, এবং সমাজের প্রভাবের মাধ্যমে মহাশ্বেতা দেবী সমাজের বাস্তবতা এবং সামাজিক পরিবর্তনের একটি গভীর চিত্র উপস্থাপন করেছেন। দিব্যনাথের চরিত্র উপন্যাসের শ্রেণিচরিত্র হিসেবে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করে, যা সমাজের অনাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ।