হরপ্পা সভ্যতার শিল্পকলা :
ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ ফাঁসোয়া জারিজ মেহেরগড় উৎখননের মধ্য দিয়ে -৭০০০-৩০০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের মর্ধ্যবর্তী পর্যায়ে ভারতের নব্যপ্রস্তর-তাম্রপ্রস্তর সংস্কৃতির যে চিত্র তুলে ধরেন তার ধারা অনুসরণ করেই এই পর্বে কিলি-গুল-মহম্মদ, দামর্ সাদাত, আনজিরা ও সিয়াদামস্, মুন্ডিগক, সুরজঙ্গল, রানা ঘুনডাই, নাল, কুল্লি প্রভৃতি স্থানে (বেলুচিস্থান ও সিন্ধু অঞ্চলে) একাধিক সংস্কৃতির নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। মূলত এই পর্বের সংস্কৃতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এখানকার মৃৎশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচনা করা হয়। এইরূপ মৃৎশিল্পের ধারবাহিকতা প্রাক্-হরপ্পা, হরপ্পা ও পরবর্তী সভ্যতার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়।
হরপ্পা সংস্কৃতির শিল্পকর্ম ও কারুশিল্প সংক্রান্ত আলোচনায় প্রবেশ করার পূর্বে হরপ্পা সংস্কৃতির কালসীমা সংক্রান্ত আলোচনাটি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে যে কালসীমার ভিত্তিতে আমার এইপর্বে আলোচনা করব সেটিকে নিম্নলিখিত ভাগে বিভক্ত করা হল।
প্রসঙ্গত ভারতের প্রায়-ঐতিহাসিক যুগ নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বৈদিক যুগের পূর্ববর্তী পর্যায়ের হরপ্পা সংস্কৃতিকে ‘প্রায়-ঐতিহাসিক’ পর্ব বলে চিহ্নিত করেছেন। এর ভিত্তি হল মূলত লিখন পদ্ধতির পাঠোদ্ধার না হওয়া। ভারতের ৩০০০-৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত কালপর্বের কোনো লিখিত উপাদান পাওয়া না যাওয়ায় ৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরবর্তীকালকে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা বলে অনেক ঐতিহাসিক ধরে নেন। আমরা পাঠ্যসূচীর পর্ব বিভাজনকে বিবেচনায় রেখে খ্রিস্ট-পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা বলে গ্রহণ করব। পাঠ্যসূচীর ভিত্তিতে এই পর্বের হরপ্পা শিল্পকর্ম ও কারুশিল্প আলোচনার মধ্যেই আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করব
হরপ্পা সংস্কৃতির মৃৎপাত্রগুলির গায়ে আঁকা ছবি রানা ঘুনডাই, কুল্লির মৃৎপাত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ছবিগুলি খালি জমির উপর কালো রঙে আঁকা; আলপনা ছবিগুলি গাঢ় লাল উজ্জ্বল পালিশ করা মৃৎপাত্রের গায়ে চিত্রিত। এগুলির প্যাটার্ন মূলত দু’ধরনের—একটি জ্যামিতিক বা অপ্রাকৃত, যার মধ্যে গোল বা বৃত্ত পরস্পরের উপর পড়ে জাফরির মত ছক তৈরি করে। দ্বিতীয়টি প্রকৃতি থেকে নেওয়া উদ্ভিজ ও জীবজন্তুর ছবি। দ্বিতীয় প্যাটার্নটি হরপ্পার নিজস্ব। এইরূপ চিত্রগুলি সমস্ত গা বেয়ে কোনো ছন্দ বা সমতা ছাড়াই মধ্যিখানে লতাপাতা, পাখি (কখনো ময়ুর) বা চতুষ্পদ জন্তুর মত ছবি ধারন করে এগিয়ে চলে। বালুচিস্তানের মৃৎপাত্রের মত (কুল্লি, কোয়েটা, আমরি-নাল, রানা ঘুনডাই) এগুলির দৃঢ় কঠিন, ঝক্ঝকে বা ধ্রুপদী ঘরানার নয়। এতে যেন নদী-উপত্যকার সমতলভূমির কোমলতা বা সান্দ্রতার ছাপ রয়েছে।
হরপ্পার চিত্রগুলির মৌলিকত্ব হল সুন্দরভাবে মনুষ্যদেহের ব্যবহার, যা অন্যত্র অনুপস্থিত। তবে এগুলির মধ্যে কোনো উন্নত পরিকল্পনা ছিল না। অনেকটা গুহাচিত্রশিল্পীদের চিত্রের মত প্রাথমিক বুদ্ধি দিয়ে এগুলি চিত্রিত হয়েছে। একটি পাত্রে একটি মানুষ কাঁধে বাঁক ঝুলিয়ে যায়, দু’দিকে দুটি মাছ ধরার জাল, পিছনে একটি কাছিম, তার পিছনে মাছ, পা দু’টি মোটা রেখার উপর দাড়িয়ে থাকে। তলায় আড়বোনা রেখার নীচের দিকে নদীর মত রূপ দেবার চেষ্টা করে। এখানে রেখার স্বল্পতা আর পারিপাট্যের উপর যথেষ্ট নজর দেওয়া হয়েছে; ন্যয়সঙ্গত অবয়ব নির্মাণের দিকে ততটা গুরুত্ব আরোপিত হয়নি। একটি প্রাপ্ত চিত্রে মনে হয়, সেখানে অনেকগুলি প্যানেল ছিল। একটি প্যানেলে প্রাকৃতিক দৃশ্য, তারপরের প্যানেলে নৌকা, শতরঞ্জ নক্সা, আবার প্রাকৃতিক দৃশ্য—এভাবে আঁকা হয়েছিল। এক একটি প্যানেলের টুকরোয় গাছের ডালপালা, তার উপরে একটি পাখি, নীচে হরিণ-শাবকের দুগ্ধ পানের দৃশ্য, প্যানেলের উপরে একটি মাছ, একটি তারা, তারপর শতরঞ্জের পটি বা প্যানেল রয়েছে। দু’টো পাত্রের টুকরোয় গাছ, মানুষের মাথা আর হাত এবং একটিতে ফণাযুক্ত গোখরো সাপ পাওয়া গেছে।
হরপ্পা সভ্যতার আর এক ধরনের মৃৎশিল্প পাওয়া গেছে, যার নক্সায় একাধিক রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োয় যে রঙিন মৃৎপাত্র আমরা পাই তার বাফ্ বা হলেদেটে জমির উপর লাল আর সবুজ রঙে আঁকা। চানহুদাড়োতে আবার হলদে জমির উপর কালো, সাদা আর লালে আঁকা পাখি ও জন্তু ছবিযুক্ত প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি পাওয়া গেছে। হরপ্পায় যেমন লাল, নীল, সবুজ বা হলদে অর্থাৎ পুরো রঙ দেওয়া মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। তা একমাত্র ইতিপূর্বে নাল সংস্কৃতিতেই পাওয়া গিয়েছিল ।
হরপ্পা সংস্কৃতির সিমেট্রি H-এর এক ও দু’নম্বর স্তরে বিশেষ একধরনের মৃৎশিল্প পাওয়া গেছে। এগুলির পাত্র খুব মজবুত করে। নির্মিত, গায়ের জমি উজ্জ্বল লাল; কালো নক্সার সীমাগুলি হালকা হয়ে মোাালয়েম হয়ে যায়, অনেকটা শাহী-টুম্পের মত। তবে অঙ্কনরীতি খুবই সুনিপুণ ও দৃঢ়; পাত্রগুলির গড়ন মার্জিত; রুচিসম্মত নক্সার মধ্যে নানাধরনের তারা, গাছপালা, ফুটকি আঁকা বৃত্ত, বক্র ও সরলরেখার সারি; পিছনের জমি ভরাট করে ‘ফর্মাল নক্সা’। এছাড়াও পাওয়া গেছে ষাঁড়, বলদ, ছাগল, ময়ূর, মাছ খুব জাঁকানোভাবে আলপনার মত আঁকা। আলপনাগুলি কখনো পাত্রের গা বেয়ে চলে যায়, কখনও প্যানেল করে আঁকা বা কখনো ঢাকনির ভিতরে গোল করে আঁকা থাকে। এগুলি মূলত সিম্বলিজে ভর্তি – ময়ূর, তাদের মাঝে আবার তারার সভা বা সূর্য। একটি পাত্রে আবার ময়ূরের গায়ে বা পেটে একটি গোল; যার মধ্যে পুরো মানুষ আঁকা।
হরপ্পা সভ্যতার কারিগরি শিল্প
হরপ্পার সাংস্কৃতিক জীবনের অভিনব বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় ভাস্কর্য সৃষ্টিসমূহে। হরপ্পার কারিগরদের নির্মিত টেরাকোটা, পাথর এবং ধাতবমূর্তিগুলিতে ভারতীয় ভাস্কর্যের প্রথম প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। হরপ্পার পোড়ামাটির ভাস্কর্য বা টেরাকোটার মধ্যে সংখ্যাধিক্য রয়েছে।
মাতৃকা মূর্তি, পাখি এবং নানাধরনের প্রাণীর মূর্তির। প্রাণীর মধ্যে বৃষ, হাতির মূর্তিতে এক ধরনের ঠাস বুনন লক্ষ্য করা যায়। জন মার্শাল লোথাল ও কালিবঙ্গানে এইরূপ দুটি বৃষের উল্লেখ করেছেন। পাখির মূর্তিগুলিতে শিল্পীরা প্রাণ ও গতি সঞ্চারের দিকে নজর দেন। পোড়ামাটির বানর এবং অন্য নানা প্রাণীর মূর্তি খেলনা হিসেবে ব্যবহার করা হলেও সব প্রাণীমূর্তি খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হত না।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে যে পরিমান পোড়ামাটির টেরাকোটা মনুষ্যমূর্তি পাওয়া গেছে, তার তুলনায় লোথালে তা কম (প্রাণীর ৭৪টি, মানুষের মাত্র ১৩টি)। কালিবঙ্গানে ও সুরকোটডার মত কেন্দ্রে আশ্চর্যজনকভাবে মানুষের মূর্তি একটিও পাওয়া যায় নি। এম. এস. ভাট হরপ্পায় প্রাপ্ত মনুষ্য মূর্তিগুলির মধ্যে আবার দুই ধরনের মূর্তির উল্লেখ করেছেন—পুরুষ মূর্তি, মাতৃকা মূর্তি বা নারী মূর্তি। কালিবঙ্গানে আবিষ্কৃত হয়েছে টেরাকোটার তৈরি একটি মানুষের মস্তক। বি. বি. লাল এই মূর্তিটির সাথে মহেঞ্জোদাড়োর বেলেপাথরের ‘পুরোহিত-রাজা’-র মূর্তির মিল খুঁজে পেয়েছেন।
হরপ্পা সভ্যতার পোড়ামাটির মূর্তিগুলি বিশ্লেষণ করে পন্ডিতরা বলছেনে, শিল্পীদের কর্মশৈলী অব্যহত ছিল না। যেকোনো কারণে তাদের অগ্রগতি ব্যহত হয়েছিল। ব্রোঞ্জ ও প্রস্তর মূর্তিগুলির তুলনায় পোড়ামাটির মূর্তিগুলি অনেকটা আদিম প্রকৃতির। প্রসঙ্গত মৃত্তিকা নির্মিত মূর্তিগুলির মধ্যে নারীমূর্তিই বেশি। এগুলির নির্মাণকার্যে কোনো ছাঁচ ব্যবহার করা হয়নি।
হাতের কৌশলে মূর্তি নির্মাণ করার পর আঙুলের চাপে নানা কাঠামো এগুলিতে যুক্ত করা হয়েছিল। এগুলির শিল্পদক্ষতা-বর্জিত হলেও সারল্য ও ভাবগাম্ভীর্যে সমুন্নত। গলায় অলঙ্কারের বাংলা এগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হরপ্পা সভ্যতার পুতুলগুলিতে ভাস্করদের শৈল্পিক নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার অভাব স্পষ্ট। মূর্তিগুলির প্রত্যঙ্গগুলি
ভিন্নভাবে নির্মাণ করে সংযুক্ত করা শিল্পীবুদ্ধিপ্রসুত কাজ বলে বিবেচিত হয় না। যেহেতু ছাঁচে মূর্তিগুলি নির্মিত হয়নি, তাই অধিকসংখ্যায় পুতুল নির্মাণ করার সময় অবহেলার ছাপ পড়েছে। মূর্তি পোড়ানো বা কাঁচা দুভাবেই নির্মিত হয়েছিল। সর্বদা পুতুলে রঙ ব্যবহার করা হয়নি। যান্ত্রিক পুতুল ও নির্মিত হত—গোযান বা বৃষমূর্তির সঙ্গে চক্র যুক্ত করে পুতুল নির্মাণ করা হয়েছিল। আবার চার বা দুই চাকার সংযুক্ত মানুষের মূর্তি পুতুল পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদাড়োতে দুই চাকা যুক্ত বিশেষ পরিকল্পনার পক্ষীমূর্তি পাওয়া গেছে।
সীল:
হরপ্পার সীলগুলিতেও প্রাণীর চিত্র-ভাস্কর্য ব্যবহৃত হয়েছিল। সীলে উৎকীর্ণ ভাস্কর্যে হরপ্পার শিল্পীরা বুযের পা ও কাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে শক্তির প্রকাশ ফুটিয়ে তুলেছিলেন; আবার কুঁজ, গলকম্বল ও লেজের ক্ষেত্রে যেভাবে কোমল ভাব ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা তাঁদের চিন্তাশীলতার প্রমাণ দেয়া। জন মার্শাল মহেঞ্জোদাড়োর ৩৩৭ নম্বর সীলে চিত্রিত বৃষের চিত্রে ভাস্করের বাস্তববোধ ও শিল্পনৈপুণ্যের সহাবস্থান লক্ষ্য করেছেন।
হরপ্পার সীলে একটি নগ্ন নারীমূর্তির চিত্র রয়েছে, যার মাথা নীচের দিকে; পদযুগল উপরের দিকে তোলা এবং প্রসারিত; যোনিদেশ থেকে একটি গাছের চারা নির্গত হয়েছে। একে পুরাণে চিত্রিত শাকম্ভরী দেবীর সঙ্গে কেউ কেউ মেলানোর চেষ্টা করেছেন। অন্য একটি সীলে পিপুল গাছের দুই ডালের মাঝে নারীমূর্তিকে প্রাগার্য কৃষিজীবী সমাজের উর্বরতার দেবীর সঙ্গে কেউ কেউ অভিন্ন বলে মনে করেন।
হরপ্পার সভ্যতার সীলে লিপি ও নক্সা ছাড়াও জীবজন্তুর মূর্তি খোদিত আছে। আবার প্রাণীমূর্তির মধ্যে বৃষ সর্বাধিক। বৃষ ছাড়াও হাতি, গন্ডার, অর্ধ-জন্তু, অর্ধ-নর, বহুশিরযুক্ত মানুষ, বৃক্ষ ও লতাপাতার নক্সা বা অলঙ্কারযুক্ত সীলের সংখ্যাও প্রচুর। হরপ্পার সীলের সংখ্যা ও নির্মাণ পরিপাট্য মহেঞ্জোদাড়ো সীলের চেয়ে নিকৃষ্ট ও সংখ্যায় কম। প্রসঙ্গত, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে খননে ঘোড়ার অস্থি যেমন পাওয়া যায়নি, তেমনি ঘোড়ার কোনো চিত্র বা সীল পাওয়া যায়নি।
ধাতুমূর্তি:
হরপ্পার ধাতুশিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের নর্তকী মূর্তি। এটি ভারতীয় ধাতুনির্মিত শিল্পশৈলীর প্রাচীনতম নিদর্শন বলেও স্বীকৃত। মুর্তিটি ৪.২৫ ইঞ্চি লম্বা, নগ্ন, সহাস্য মুখ, অর্থ নির্মিলীত চোখ, দীর্ঘ হাত ও পা। বাম হাত বালাতে সম্পূর্ণ ঢাকা, গলায় তিনটি করচ লাগানো মালা। মূর্তিটির বাম হাঁটু ভাঁজ করা, ডান পা বাঁকানো এবং ডান হাত কোমরে রাখা। মার্শাল অবশ্য এটিকে নর্তকীর মূর্তি বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত খুঁজে পাননি। এই মূর্তিটিতে আদিম শিল্পবুদ্ধির প্রভাব যেমন আছে তেমনি এর গঠনরীতিতে যে রাফনেস রয়েছে তাতে শিল্পীর কলাজ্ঞানের দৈন্য ফুটে ওঠে না। মূর্তিটিতে দেহের তাল-বিভাগ ও অনুপাত এর ভাস্কর্যমূল্য বৃদ্ধি করেছে। রুগ্ন দেহের কারণ ধাতু দ্রব্য ঢালাই করার কলাকৌশল প্রযুক্তির আবিষ্কার তখনো না হওয়া। তবে মূর্তিটির ক্ষীণ দেহে লাবণ্য ও গতির সুন্দর ব্যঞ্জনা সুস্পষ্ট হয়।
লোথালে তামার তৈরি কুকুর ও পাখি, কালিবঙ্গানে ব্রোঞ্জের একটি বৃষের মূর্তি, মহেঞ্জোদাড়োয় তামা বা ব্রোঞ্জের একটি ছোটো জিনিসের উপর তিনটি বাঁদরের মূর্তি পাওয়া গেছে যা হরপ্পা সভ্যতার উন্নত ধাতব ভাস্কর্যের পরিচয় দেয়। মার্শাল মনে করেন, মহেঞ্জোদাড়োর মূর্তিটিতে পূর্ণাঙ্গ ও রিলিফ ভাস্কর্য একসাথে প্রতিভাত হয়েছিল ।
পাথরের মূর্তি:
মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাপ্ত স্টিয়েটাইট পাথরে তৈরি ১৭ সেমি পুরুষ মূর্তিকে সাধারণভাবে ‘পুরোহিত রাজা’ বলে চিহ্নিত করা হয়। মূর্তিটির নীচের দিকটি এবং মাথার অংশ ভাঙা, ডান বাহু থেকে কাঁধ পর্যন্ত একটি শাল জড়ানো, শালটির ধারগুলি দড়ির মত, ভেতরে ত্রিপত্রের মত নক্সা আঁকা। মুর্তিটির মুখমন্ডলে ছোটো দাড়ি গোঁফ, চোখ সোজা, ত্যাধ-বোজা, মাঝারি আকারের নাক, পিছন থেকে ঢালু হয়ে নোমে আসা কপাল, ঠোঁট পুরু, চিরুনি দিয়ে সিঁথি কাটা চুল, চুলের ফিতেতে কপালের মাঝখানে একটি ববলস, ডানদিকের বাহুতে ববলস আকারে একটি বাহুবন্ধ, কানের নীচে কাঁধের মধ্যে নেকলেশ জাতীয় অলঙ্কার আটকানোর জন্য দুটি গর্ত। মূর্তিটিতে হাত অনুপস্থিত। রমাপ্রসাদ চন্দ মূর্তিটির মাথা, কাঁধ ও বক্ষের দৃঢ় ও ঋজু গড়ন দেখে ধ্যানমগ্ন যোগীর ভঙ্গিমার সঙ্গে তুলনা করেছেন। জন মার্শাল আবার মূর্তিটিকে সমসাময়িককালের ধর্মীয় দেবতা বা ‘পুরোহিত’ বলে চিহ্নিত করার পক্ষপাতী।
‘পুরোহিত রাজা’ ছাড়াও ম্যাকে মহেঞ্জোদাড়োতে ৬টি এবং আর্নেলেনু জেনসেন ৪টি মনুষ্য মূর্তির সন্ধান লিপিবদ্ধ করেছেন। এগুলি চুনাপাথর, আলবাস্টার ইত্যাদি পাথরে নির্মিত হয়। মহেঞ্জোদাড়োতে পাথরের তৈরি মেষ, পাহাড়ি ছাগল, কানঝোলা কুকুর (স্টিয়েটাইট পাথরে নির্মিত), কাঠবেড়ালির ক্ষুদ্রাকার মূর্তি (চিনেমাটির তৈরি) পাওয়া গেছে। হরপ্পায় পাওয়া গেছে ধূসর স্টিয়েটাইট পাথরে নির্মিত নৃত্যের ভঙ্গিমায় রত পুরুষ মূর্তি (স্টিয়েটাইট পাথরে নির্মিত), লাল বেলেপাথরের টরসো। লাল বেলেপাথরের টরসোটি প্রাচীন ভারতীয় বাস্তবধর্মী ভাস্কর্যের একটি সুন্দর নিদর্শন। এর গঠনরীতি অত্যন্ত স্বাভাবিক ও গঠন অত্যন্ত নিখুঁত। মূর্তিটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি ভিন্নভাবে নির্মিত হয়। পরে এগুলি মূর্তির দেহের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য স্কন্ধদেশে একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
বিচ্ছিন্ন অঙ্গগুলির সন্ধান না পাওয়া গেলেও শুধু দেহকাভের গঠন দেখেই অনুমান করা যায় এর যৌবনদীপ্ত সৌন্দর্য। অনেক পন্ডিত এটি বাস্তবতা ও সজীবতার দিক থেকে গ্রিক ভাস্কর্যকেও অতিক্রম করেছিল বলে মনে করেন। এই মত অতিশয়োক্তি মনে হলেও এই ভাবের মূর্তি ইউরোপীয় ভাস্কর্যের প্রাচীন ইতিহাসের সংগ্রহে খুব সুলভ নয়। ধোলাভিরায় পাওয়া গেছে পাথরের তৈরি বসে থাকা পুরুষের ভাঙা মুর্তি ও পাথরের তৈরি দন্ডায়মান পুরুষমুর্তি এবং পাথরের তৈরি টিকটিকি।
হরপ্পার ভাস্কর্য শিল্প-নিদর্শনগুলির পর্যালোচনা করে যে বৈশিষ্ট্যগুলি চিহ্নিত করা যায় সেগুলি হল—১। হরপ্পার ভাস্কররা কোনো বৃহৎ মূর্তি নির্মাণের চেষ্টা করেননি। সম্ভবত ভাস্কর্য শিল্পের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না ; ব্যক্তিগতভাবে হরপ্পীয়রা ছোটো ছোটো মূর্তি নির্মাণের দিকে তাই জোর দেন, ২। বেশিরভাগ মূর্তির প্রাপ্তিস্থান ছিল হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো। অন্যত্র এর নিদর্শন তুলনামূলকভাবে কম, ৩। সমসাময়িক মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পার ভাস্কর্যের সাদৃশ্য নেই। এটি ছিল একান্তই হরপ্পা সভ্যতার নিজস্ব শৈলী।
হরপ্পার বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাস্কর্য নিদর্শনের ঐতিহ্যগত ধারাবাহিকতা পরবর্তীকালের ভারতীয় ভাস্কর্যের মধ্যে অটুট ছিল। যেমন ‘পুরোহিত রাজা’-র মূর্তির সাথে পরবর্তীকালের যোগীর মূর্তি, হরপ্পায় প্রাপ্ত লালা বেলেপাথরের টরসোর মত কুষাণ যুগের টরসো, হরপ্পার বাম-পদ নৃত্য ভঙ্গিমার ভাঁজ করা ডান পায়ের উপর দন্ডায়মান পুরুষমূর্তির সাথে পরবর্তী নটরাজ ভঙ্গিমার সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সিন্ধু সভ্যতার শিল্পীদের উন্নত ভাস্কর্যশৈলী সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে স্টেল্লা ক্র্যামরিশ বলেছেন, এই শৈলীই ধীরে ধীরে পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে আসতে আসতে গাঙ্গেয় অঞ্চল ধরে পাটালিপুত্রে এসে পূর্ণ বিকশিত হয়েছে।