সুবর্ণলতা উপন্যাসের নামকরণ ও সার্থকতা

সুবর্ণলতাকে শুধু একজন গৃহিনীর জীবনকাহিনী বললে ভুল বলা হবে, সুবর্ণ প্রতিনিধিত্ব করে একটি নির্দিষ্ট কালের। এটা সেই সময়ের গল্প, যখন ‘মেয়েমানুষের’ পড়াশোনা করতে চাওয়ার ইচ্ছেকে ধরা হতো মহাপাপের সমান। ন’বছর বয়সে বিয়ে হওয়া সুবর্ণ কতোটা পেরেছিলো সব বাঁধা পেরিয়ে এগোতে? সে কি নিজের আলোয় উজ্বলতা ছড়াতে পেরেছিলো, নাকি দৈনন্দিন চাল-ডাল আর তেল-মসলার ফর্দতে হেঁশেলের দরজার আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিলো? সুবর্ণর স্বপ্ন ছিলো একটা ঝুলবারান্দার। স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছিলো আদতে।

থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিলো সুবর্ণর। ‘সুবর্ণলতা’ উপন্যাসটা সত্যবতীর একমাত্র মেয়ের সংসারজীবনের গল্প। মা-মেয়ে দুজনেই এক চরিত্রের মানুষ হলেও তাদের পারস্পার্শ্বিক পরিবেশ একরকম না। একরকম চরিত্রের না তাদের স্বামীরা, শ্বাশুড়িরাও। যেখানে মা নিজের চারপাশের পরিবেশটা পিটিয়ে পাটিয়ে নিজের উপযোগী করে নিয়েছিলো, যেখানে বাবা বোকাসোকা মানুষ হলেও অন্তত মায়ের সম্মান করতো, যেখানে শ্বাশুড়ি রাগী হলেও বৌয়ের ওপরে কথা বলতে সাহস পেতেন না সেখানে সুবর্ণ রাগী, অত্যাচারী, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত এক স্বামী ও ভয়ানক মুখরা শ্বাশুড়ি, দেবর, ভাসুর পরিবেষ্টিত পরিবারে প্রতিবাদের নামে মার খেয়ে মরে। তার থেকে এক জেনারেশন আগের তার মা, মাত্র তিনটি সন্তান নিয়ে ছোট্ট গোছানো সংসার ছিলো তার। সে নিজেও ছিলো তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান তার স্বামীও তাই। কিন্তু সুবর্ণ? ছয় সন্তানের জননী সে।

এমন নয় যে তার স্বামী প্রবোধ তাকে ভালোবাসে না। ভালো না বাসলে ঐ মুখরা বৌকে নিয়ে জ্বলেপুড়ে মরেও ত্যাগ করে না কেন? করে না কারণ সে যে তার বৌকে ভালোবাসে তা তার এই জলন্ত স্বভাবের জন্য‌ই। মুখরা এই মেয়ের‌ই আর সকলের চেয়ে মায়া মমতা বেশী। নিজের সন্তানের জন্য চকলেট, বিস্কুট কিনলে পরিবারের অন্য সবার সন্তানের জন্য‌ও কেনে। পরিবারে কারোর কিছু হলে সবার আগে সেবা করতে ছোটে। কারো টাকা লাগলে আর জায়েরা স্বামীদের দিতে বাঁধা দিলেও সুবর্ণ জোর করে টাকা বের করে দেয়। শ্বাশুড়ি বলে, “এদিকটাই শুধু ওর ভালো।” কিন্তু দোষ হলো,বড্ড ন্যায্য কথা বলে। এত ন্যায্য কথা বললে সংসারে টিকে থাকা যায়?

দোষ তার আরো একটা আছে। সে পড়তে ভালোবাসে, সে চায় মাথার ওপর ছাদ আর ঘরের সাথে বারান্দা। সে চায় একটু আকাশ, সে চায় একটু ভালো পরিবেশ, মানুষের মতো করে বাঁচা! এটাই তার দোষ। অর্থ আছে, স্বামী আছে, সংসার আছে‌। এসব রেখে ওসব আবার কি ঢং? এমন মেমসাহেবীয়ানা জীবনে সুবর্ণের শ্বশুরবাড়ির লোক শুনেছে?

তারপর আছে গৃহত্যাগী মায়ের অপবাদ,যদি এই বাড়ির দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে যায় দাঁড়াবে এমন কোন জায়গা কি সুবর্ণের আছে? অবশ্য সে দেশের কাজ করবে এমন একটা বাসনা তার আছে, কিন্তু তারাও যে তাকে নিতে চায় না! বলে, “এতগুলো পিছুটান তোমার, এত সন্তান কাজেই তুমি পারবে না।”

আর স্বামী মানুষটি নিজেও জানে যে সুবর্ণের সে যোগ্য নয়। সুবর্ণের মনের ‌জায়গা যে তার মনের থেকে অনেক ওপরে একথা সে বোঝে বলেই চায় কোনোরকমে সুবর্ণকে টেনে নিচের দিকে নামিয়ে জাপটে ধরে আটকে রেখে সন্তান দিয়ে বেঁধে নিজের কাছে ধরে রেখে এই জীবনটা তো পার করে দেয়া যাক! সুবর্ণ কারো সাথে হেসে কথা বললেও তার রাগ হয়, তখন তাকে ঘরে এনে বেদম মারে। তবুও শিক্ষা হয় না সুবর্ণর। যে আনন্দ সে কুঁড়েঘরেও বড় মনের মানুষের পরিচয় পেলে পায় সে আনন্দ এই দালানে এত অর্থবিত্তের মধ্যে বাস করে কেন পায় না এটাই প্রবোধের রাগ। খুব রাগ।

সুবর্ণর সংসারে মেয়েদের আর ছেলেদের এক চোখে দেখা হয় না। তার শ্বাশুড়ি কথায় কথায় বলে,কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা? পায়ের সঙ্গে মাথার? না পেরে কাজের মেয়েও মাঝেমধ্যে বলে ওঠে, মানুষের সঙ্গে মানুষের‌ই তুলনা। তা পা-ই বা মাথার থেকে কোন অংশে ছোট? মাথাটা তো পায়ের ওপর‌ই দাঁড়িয়ে?

হয়তো এই মানসিকতা এখন পরিবর্তন হয়েছে। তারপর‌ও এতবড় বিশ্বসংসারের জীর্ণ দেয়ালের কোনো না কোনো ফাঁকে ফোঁকরে কি এখনো লেগে নেই সেই পুরাতনের ছোঁয়া? বিংশ শতাব্দীর চোখ ধাঁধানো আভিজাত্য আর আধুনিকতার মধ্যেও হয়তো কোথাও একটা মেয়েকে ধরা হয় পা, ছেলেকে ধরা হয় মাথা। এই বিষ কি এত সহজে যাবার?

সুবর্ণ ভাবে তার ইহকাল শেষ হয়ে গেছে। আবার ভাবে, তা কেন! আমার ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটি কি মানুষের মতো মানুষ হবে না? হবে হয়তো,বকুল হয়তো মানুষ হবে, পড়বে লিখবে। হয়তো এই বিরাগ পরিবেশেও একজন তৈরি হবে, সেটাই হবে ঈশ্বরের সুবর্ণর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা। কিন্তু সুবর্ণ কি তা দেখে যেতে পারবে?

সিক্যুয়েল এত সুন্দর হয় আমার ধারনা ছিলো না। আজ অব্দি খুব কম ব‌ইয়ের‌ সিক্যুয়েল‌ই আমাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে। বিভূতির পথের পাঁচালী-অপরাজিতের পর আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রতিশ্রুতি-সুবর্ণলতা যেন একে অন্যের সাথে ফাইট দিচ্ছে কে বেশী সেরা। এর একটা কারণ সম্ভবত, এখনকার লেখকরা সিক্যুয়েল লেখেন জনপ্রিয়তা, ব্যবসায়িক লাভ হিসেব করে। কিন্তু আগের লেখকরা লিখতেন প্রাণ থেকে অনুভব করেই।

একেবারে অভিনব এই চমৎকার লেখনী কোথা থেকে পেলেন অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া সংসারের একরাশ বোঝা কাঁধের আশাপূর্ণা দেবী। শুনেছি সংসারের সব কাজ সেরে রাতের বেলা লিখতে বসতেন, এমন নয় যে মুড হলেই বসে পড়তে পারতেন।  এত গভীর, এত হৃদয় জেতা, আপনি যদি সুবর্ণলতা উপন্যাসের একটা লাইন‌ও বুঝতে না পারেন ভাববেন না আশাপূর্ণা দেবী ভুল লিখেছেন, জানবেন আপনি লাইনটা স্পর্শ করতে পারেননি দুঃখটা না জানার কারণে। কিন্তু যারা দুঃখটা জানে তাদের কাছে এই ব‌ইটা সোনার চেয়েও খাঁটি, কারণ সোনায়‌ও খাদ থাকে।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading