স্বাধীনতার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ :-
সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ যুগ যুগ ধরে মানুষকে নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে । কিন্তু তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সুদীর্ঘকাল ধরে যে – বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে , অদ্যাবধি তার পরিসমাপ্তি ঘটেনি । প্রাচীন গ্রিস ও রোমে দাস – ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায় তখন সব মানুষকে সমান বলে মনে করা হত না । তাই তখন স্বাধীনতার স্থান ছিল সাম্যের অনেক ওপরে । অনুরূপভাবে মধ্যযুগে সাম্যের আদর্শ উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছিল । এমনকি , উদীয়মান বুর্জোয়াশ্রেণির প্রতিনিধিস্থানীয় চিন্তাবিদ লকের দর্শনে যে – তিনটি প্রাকৃতিক অধিকারের কথা বলা হয় , তার মধ্যেও সাম্যকে স্থান দেওয়া হয়নি । তিনি জীবন , স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে স্বাভাবিক অধিকার হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন
স্বাধীনতা ও সাম্যের ওপর সমান গুরুত্ব আরোপ : –
অবশ্য এর ব্যতিক্রম ছিলেন টমাস মোর , কাম্পানেল্লা , উইনস্ট্যান্লি , ম্যূনৎসার প্রমুখ কাল্পনিক সমাজবাদী এবং ইংল্যান্ডেরআইন , স্বাধীনতা , সাম্য ও ।। ৯৩ ‘ লেভেলার ’ ও ‘ ডিগার’গণ । পরবর্তী সময়ে মোরলি , মালি , বাবফ , কাৰে , ভাইটলিং , সাঁ সিমোঁ , শার্ল ফুরিয়ে , রবার্ট ওয়েন প্রমুখ কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা অসাম্য – বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা প্রচার করেছিলেন । তাঁদের কারও কারও তত্ত্বের মধ্যে সাম্যের সঙ্গে স্বাধীনতার আদর্শের সমন্বয়সাধনের কথা বলা হয় । উদাহরণ হিসেবে সাঁ সিমোঁর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে । তিনি মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব বিস্তারের যে – কোনো প্রচেষ্টাকে স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করতেন । কিন্তু তাঁর চিন্তা খ্রিস্টধর্মের নীতিশাস্ত্রভিত্তিক হওয়ায় তা অবাস্তব চিন্তায় পর্যবসিত হয়েছিল । বস্তুত আমেরিকার ভাজিনীয় অধিকারের ঘোষণা ( ১৭৭৬ ) এবং ফরাসি মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণায় ( ১৭৮৯ ) সর্বপ্রথম সাম্যের সঙ্গে স্বাধীনতার সমন্বয়সাধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় । ফ্রান্সের জাতীয় সংসদ মানুষকে জন্ম থেকেই স্বাধীন এবং সমানাধিকারসম্পন্ন বলে ঘোষণা করেছিল ।
সাম্য স্বাধীনতার পরিপন্থী : –
সাম্যের সঙ্গে স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যেও যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে । ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তাগণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতার স্বাধীনতা দাবি করে যে – তত্ত্ব প্রচার করেন , তা কার্যত সাম্য তত্ত্বের পরিপন্থী ছিল । এমনকি , লর্ড অ্যাকটন , টক্ভিল স্পেনসার , বেজহট , লেকি প্রমুখের দৃষ্টিতে সাম্য এবং স্বাধীনতার ধারণা পরস্পর – বিরোধী । লর্ড অ্যাকটন এই মন্তব্য করেছিলেন যে , সাম্য প্রতিষ্ঠার আগ্রহ স্বাধীনতার আশাকে নির্মূল করে দেয় । তিনি স্বাধীনতা বলতে ব্যক্তির ধনসম্পদ ভোগের সীমাহীন অধিকারকে বোঝাতে চেয়েছিলেন স্বাভাবিকভাবেই সাম্য নীতির প্রতিষ্ঠা বিত্তবানের স্বাধীনতার ওপর বাধানিষেধ আরোপ করবে — এই ভয়ে ভীত হয়ে তিনি সাম্যকে স্বাধীনতার পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন । অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন টক্ভিল , স্পেনসার , বেজহট প্রমুখ চিন্তাবিদ।
সাম্য ও স্বাধীনতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক : –
কিন্তু জন স্টুয়ার্ট মিল স্বাধীনতা ও সাম্যকে পরস্পরের পরিপূরক বলে মনে করতেন । তিনি সমাজকল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতাকে বিচারবিশ্লেষণ করেছিলেন । তাই এরুপ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনৈতিক সাম্যের প্রয়োজন বলে তিনি জীবনের শেষ দিকে অভিমত দিয়েছিলেন । বিংশ শতাব্দীতে হবহাউস , ল্যাস্কি বার্কার , টনি , পোলার্ড ( Pollard ) প্রমুখ সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণা দুটিকে পরস্পরের পরিপুরক বলে বর্ণনা করেছেন । এমনকি , অষ্টাদশ শতাব্দীতে রুশোও অনুরূপ ধারণা পোষণ করতেন । তাঁর মতে , সাম্যের অবস্থিতি ছাড়া স্বাধীনতা থাকতে পারে না । হবহাউস্ সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার ধারণাকে ‘ বাগাড়ম্বর ‘ ( a high sounding phrase ) বলে চিহ্নিত করতে দ্বিধাবোধ করেননি । আর , এইচ . টনির মতে , সাম্য স্বাধীনতার পরিপন্থী নয় ; বরং স্বাধীনতার স্বার্থেই তার অবস্থিতি প্রয়োজন । অনুরূপভাবে , পোলার্ড মন্তব্য করেছেন , “ স্বাধীনতা সংক্রান্ত সমস্যার কেবল একটি সমাধানই রয়েছে এবং তা সাম্যের মধ্যেই বর্তমান । ও স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বার্কার বলেছেন যে , সাম্য একটি বিচ্ছিন্ন নীতি নয় । এটি স্বাধীনতা ও সৌভ্রাত্রের সপক্ষে দাঁড়ায় । তাই এটিকে ওই দুটি নীতির সঙ্গে সমন্বিত করা প্রয়োজন । সুতরাং বলা যায় , সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর – বিরোধী নয় ; একে অপরের পরিপূরক ।
ল্যাঙ্কি ও মার্কসবাদীদের অভিমত : –
সাম্য ও স্বাধীনতা — উভয় ধারণাই হল আইনগত ধারণা । কারণ , রাষ্ট্র আইনের সাহায্যে সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণাকে বাস্তবে রূপায়িত করে উভয় ধারণাই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । স্বাধীনতা বলতে এমন একটি সামাজিক পরিবেশকে বোঝায় , যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি তার ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশসাধনের সুযোগ লাভ করে । এই সামাজিক পরিবেশ বলতে সাম্যের পরিবেশকে বোঝায় । আবার , অন্য একটি দিক থেকেও সাম্য ও স্বাধীনতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আলোচনা করা যেতে পারে । স্বাধীনতা এবং সাম্য উভয়েরই লক্ষ্য হল ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশসাধন । রাষ্ট্র আইনের সাহায্যে এই বিকাশসাধনের পথ প্রশস্ত করে । কিন্তু সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অসাম্য – বৈষম্য বিদ্যমান থাকলে স্বাধীনতা কখনোই সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে না বলে ল্যাস্কি এবং মার্কসবাদীরা মনে করেন । ‘ এ গ্রামার অব্ পলিটিক্স ‘ ( A Grammar of Politics ) নামক গ্রন্থে ল্যাস্কি এই মন্তব্য করেছেন যে , অর্থনৈতিক সাম্য না থাকলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায় । ৩৩ অর্থনৈতিক সাম্য বলতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপসাধনকে বোঝায় । মার্কসবাদীরাও মনে করেন যে , ধনবৈষম্যমূলক সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার ফলে রাজনৈতিক , সামাজিক প্রভৃতি স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে । এরূপ সমাজে আইন তথা রাষ্ট্র সম্পদশালী মুষ্টিমেয় ব্যক্তির স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে বলে তা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কখনোই সুনিশ্চিত করতে পারে না । তাই তাঁরা অর্থনৈতিক সাম্যের প্রতিষ্ঠাকে স্বাধীনতার পূর্বশর্ত বলে চিহ্নিত করেন মার্কসবাদীদের মতে , কেবল শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজেই সাম্য ও স্বাধীনতা একে অপরের যথার্থ পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে।