সাম্যের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য গুলি লেখ

রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা—এই তিনটি রাজনৈতিক আদর্শ যুগ যুগ ধরে সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষকে প্রেরণা জুগিয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মানুষের স্বাধীনতা উপভোগের জন্য সাম্যের প্রয়োজন।

সাম্যের সংজ্ঞা সাধারণভাবে সাম্য বলতে সব মানুষের সমতাকে বোঝায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘সাম্য’ বা Equality কথাটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য বলতে সব মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী যাবতীয় সুযোগ সুবিধার সমতাকে বোঝায়। এই কারণে যে সমাজে ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী সুযোগ সুবিধাগুলি সকলের জন্য সমান নয় সেখানে সাম্যের অস্তিত্ব নেই বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন।

বার্কার এর মতে, “সাম্য বলতে ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ সুবিধার সমতাকে বোঝায়, কিন্তু এর ফলে প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব সমানভাবে বিকশিত হবে এবং প্রত্যেকে একই রকম গুণগত যোগ্যতা অর্জন করবে তা বোঝায় না।” মার্কসবাদীদের মতে, ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণি বৈষম্য ও শ্রেণি শোষণ প্রভৃতির অবসানের মাধ্যমে সমাজে সকলের সম সুযোগ সুবিধার পরিবেশ সৃষ্টি করাই হচ্ছে সাম্য।” অধ্যাপক ল্যাস্কি সাম্য বলতে বুঝিয়েছেন-

ক) বিশেষ সুযোগসুবিধার অনুপস্থিতি এবং

খ) সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার উপস্থিতি।

সাম্যের প্রকৃতিঃ সাম্যের ধারনার উপরিউক্ত সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে তিন দিক থেকে সাম্যের প্রকৃতি  আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন-  

নেতিবাচক দিকঃনেতিবাচক অর্থে সাম্য হল সব ধরনের বৈষম্যের অনুপস্থিতি। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, মানবসমাজে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভেদে প্রতিটি মানুষ আলাদা হলেও তাদের সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম বৈষম্য করা যাবেনা। রাষ্ট্রের কাছে বা আইনের চোখে সকলেই সমান। এটি হল সাম্যের নেতিবাচক দিক।

ii) ইতিবাচক দিকঃইতিবাচক অর্থে সাম্য হল প্রত্যেকেই ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য যথার্থ সুযোগসুবিধ পাবে। সকল নাগরিককে সমান সুযোগসুবিধা দিলেই প্রত্যেকে সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার ঘটিয়ে সমানভাবে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারবে এমনটা বলা যায় না। তাই রাষ্ট্র এমন একটি পরিবেশ এবং সুযোগ- সুবিধার ব্যবস্থা করে দেবে, যাতে প্রত্যেকে তার প্রতিভা ও যোগ্যতার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।

iii) মার্কসীয় দিকঃমার্কসবাদীরা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্যের ধারণার ব্যাখা দিয়েছে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ধন বৈষম্যমূলক ও শ্রেণি বিভক্ত সমাজে প্রকৃত সাম্যের অস্তিত্ব কখনোই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ না ঘটলে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যাবেনা। ।

সাম্যের প্রকারভেদঃ– 

সাম্য একটি বহুমাত্রিক ধারণা। তাই সাম্যের বিভিন্ন প্রকারভেদ উল্লেখ করা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকারভেদ্গুলি হল-

i) স্বাভাবিক সাম্যঃস্বাভাবিক সাম্যের তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ জন্ম থেকেই স্বাধীন। প্রতিটি মানুষ সমানাধিকার সম্পন্ন ফরাসি দার্শনিক রুশো বলতেন, মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলে আবদ্ধ। প্রাচীন গ্রিসে স্টোয়িক দার্শনিকরা এবং রোমান চিন্তাবিদ সিসেরো ও পলিবিয়াস প্রমুখ স্বাভাবিক সাম্যের ধারণা প্রচার করেছিলেন।

ii) সামাজিক সাম্যঃসামাজিক সাম্য বলতে বোঝায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ মর্যাদা, স্ত্রী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব মানুষের সামাজিক ক্ষেত্রে সমমর্যাদা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, দাস সমাজ ও সামন্ত সমাজে সামাজিক সাম্যের অস্তিত্ব ছিল না। পরবর্তীকালে আইনের অনুশাসনের প্রসার লাভের ফলে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

iii) রাজনৈতিক সাম্যঃ রাজনৈতিক সাম্য বলতে সব নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার ভোগের সমতাকে বোঝায়। রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভোট দেওয়ার অধিকার ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার, রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের অধিকার প্রভৃতি। রাজনৈতিক সাম্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলভিত্তি

iv) আইনগত সাম্যঃ  আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকারকে আইনগত সাম্য বলে অভিহিত করা হয়। আইনের দৃষ্টিতে সমতার অর্থ হল সব নাগরিক আইনের চোখে সমান। অন্যদিকে আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকারের অর্থ হল, আইনের মাধ্যমে সব নাগরিককে সমান সুরক্ষাকে প্রদানের ব্যবস্থা করা।

v) অর্থনৈতিক সাম্যঃ  অর্থনৈতিক সাম্য বলতে বোঝায় সব নাগরিকের আর্থিক সুযোগ সুবিধা ভোগের সমতা। মার্কসীয় দর্শনে অর্থনৈতিক সাম্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া অন্যান্য সাম্য গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।  

vi) আন্তর্জাতিক সাম্যঃ  আন্তর্জাতিক সাম্য বলতে প্রতিটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমমর্যাদার ধারণাকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক সাম্যের মূল বক্তব্য হল ক্ষুদ্র বৃহৎ নির্বিশেষে সমস্ত জাতীয় রাষ্ট্রের মর্যাদা ও গুরুত্ব সমান।

মূল্যায়নঃ  পরিশেষে বলা যায় সাম্য একটি পরিবর্তনশীল ধারণা। রাষ্ট্র সকলের জন্য সমান সুযোগ ও অধিকার ভোগ করার ব্যবস্থা করে ; মানুষ তার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী নিজের জন্য সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Scroll to Top

Discover more from Online Learning

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading