সাগরী গদ্য এবং আলালী গদ্যের মধ্যে পার্থক্য
ভাষারীতির থেকে প্যারীচাদ যেন বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করবার জন্যই সাহিত্যক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিলেন। যেমন—আলালী ভাষার বৈশিষ্ট্য হল : ভাষায় তীব্র শ্লেষ ও কৌতুকরস; বাক্যরীতির কথ্যভঙ্গিকলকাতার নিকটবর্তী অঞ্চলের ভাষায় আরবী-ফার্সী শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগ; দেশী বিদেশী ও তৎসম শব্দের ব্যবহার ক্রিয়া-বিভক্তি, কারক-বিভক্তি ও অব্যয়ের নতুন রূপ আবিষ্কার এবং সমাস-সন্ধিযুক্ত দীর্ঘ জটিল বাক্য।
প্যারীচাদ বিদ্যাসাগরের ‘পণ্ডিতী রীতি’র গদ্যাদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। অথচ একথা সত্য, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা গদ্যের মধ্যে সরাসরি পাণ্ডিত্য না দেখিয়ে ব্যাকরণের উপাদানকে সাজিয়ে শিল্পের উপাদানে পরিণত করেছিলেন; যেমন—বাংলা ভাষার স্বভাবানুযায়ী পদবিন্যাস রীতি স্থাপন করা, কমা-সেমিকোলন প্রভৃতি বিরামচিহ্ন প্রয়োগ করে আদি হ্রস্ব, হ্রস্বতর বা দীর্ঘ যতি-পদ্ধতির বিস্তারিত ব্যবহার; ভাষার মধ্যে ধ্বনি-সামঞ্জস্য স্থাপন করে অন্ত্যছন্দের আবিষ্কার ইত্যাদি।
আসলে, বিদ্যাসাগর সারা জীবন ‘পণ্ডিতী রীতির’ গদ্য ব্যবহার করেন নি। তার শেষ জীবনের polymics-গুলিতে কথ্য বাক্ভঙ্গীর স্বচ্ছন্দ ব্যবহার দেখা যায়। অনুরূপভাবে ‘আলালে’র রচয়িতা প্যারীচাদও তার পরবর্তী রচনাগুলির মধ্যে কথ্যরীতি ত্যাগ করে জটিল ভাষাভঙ্গী ব্যবহার করেছেন। তাই বলা চলে, ভাষা ও ভাবের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যেমন সমাজমুখীন তেমনি ক্রমান্বয়ে সরলতামুখীন; কিন্তু প্যারীচঁাদ ক্রমান্বয়ে জটিলতামুখীন। দ্বিতীয়ত, লেখক বিদ্যাসাগরের অনেক বেশি ব্যবহারিক বুদ্ধি ছিল। বই লেখা, মুদ্রণ কাজের সঙ্গে সংযোগ, সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরী বা বইয়ের দোকান খোলা ইত্যাদি সক্রিয় উদ্যোগ তাঁর মধ্যে দেখা যায়। তাই মনে হয়, কি ভাবগত কি প্রয়োগগত বা ভাষাগত আদর্শে প্যারীচাঁদ মিত্র ছিলেন যেন বিদ্যাসাগরের বিপরীত মেরুতে অবস্থিত।