“আমরাই তো জোগাই অন্ন, তাই তোমরা বাঁচ-/ আমরাই বুনি বস্ত্র, তাতেই তোমাদের লজ্জা রক্ষা”।পাঠকের নিশ্চয় মনে পড়ে গেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।আর কি বা করতে পারি তাঁর জন্মদিনে, তাঁর ফোটানো ফুলে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া ছাড়া? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি ছোট নাটক “রথের রশি” (১৯৩২)। এই নাটকটির ভিন্ন নাম ও আছে, সেটি হচ্ছে “কালের যাত্রা”। এই নাটক যেমন দার্শনিক বিচার, তেমনি নান্দনিক বিবেচনায় ‘রক্তকরবী’- র কাছাকাছি। অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজনে যেসব মানুষের নিম্নকোটিতে অবস্থান, সেইসব তথাকথিত সাধারণ মানুষের মধ্যে খুঁজে পান অসাধারনত্ব। আর যারা সমাজের উঁচু স্থানে অবস্থান তাদের মধ্যে খুঁজে পান সাধারণত্বকে। ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধি লোভ, দম্ভ তাদের পশুত্বের স্তরে নিয়ে যায়।ত্রিকালদর্শী ঋষি সেদিনই বুঝেছিলেন, ভারতবর্ষের মতো তাঁবেদারী দেশই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের আসল ঘুঁটি। তাই মানবতার অপমানে সামান্য লজ্জাবোধ ও তাদের মনে কাজ করে না।
অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজনে তারা শীর্ষে থাকলেও তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পান অতি সাধারণ মানসিকতার মানুষকে। তাই দেবতার রথের রশি তারা স্পর্শ করলে দেবতার রথের চাকা গড়ায় না। এর কারণে তাই তো সন্ন্যাসী বলেন- “তোমরা কেবলই করেছ ঋণ,/ কিছুই করনি শোধ/দেউলে করে দিয়েছো যুগের বৃত্ত/ তাই নড়ে না আজ আর রথ।” যখনই শুদ্র আর নীঁচু জাতির লোকেরা হাত লাগালো তখন রথের চাকা গড়াতে আরম্ভ করলো। এই নাটক যেন নীচু জাতি শোষিত মানুষদের বিশ্বের পথ দেখায়। এ নাটক সাংকেতিক নাটক। এ নাটক যেন আমাদের দেখায় পাশ্চাত্যের কয়েকটি ধনী দেশ আধিপত্য বিস্তার করে যতই ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটাক না কেন, এ পৃথিবী এক ইঞ্চিও ঘুরবে না যদি সমাজের অবহেলিত মানুষ না সম্মান পায়।
নাটকের বিষয় বস্তুর দিকে দর্শকমনের ঔৎসুক্য সজাগ করতে প্রথমেই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এসেছেন কিছু সাধারন মহিলাকে যারা এসেছে রথের মেলার উৎসবে যোগ দিতে। তাদের সংলাপে নাটকের প্রথমেই বিস্ময় তৈরি হয়- চিরকালের অভিজ্ঞতা অনুসারে রথের চাকা নড়ছেনা। তৃতীয়ার কথা থেকে জানা যায়, রাজ্য জুড়ে যেখানে প্রচুর জনসমাগমের দিন, যেখানে ব্রাহ্মণ ঠাকুর শিষ্য নিয়ে বেরোবেন, পেছনে চলবে সৈন্য-সামন্ত, পন্ডিতমশাই চলবেন পুঁথিপত্র হাতে ধরা ছাত্রদের নিয়ে সেখানে সমস্তই বন্ধ। এ ধরনের সাধারণ মানুষের মঞ্চে উপস্থিতিতে দর্শক মন ধীরে ধীরে প্রবেশ করে নাটকের মূল বিষয়ে। নাগরিক দলের কথায় প্রকাশ পায় নানা আশঙ্কা, উৎকণ্ঠা যা নাটকের নাটকীয় গতিদান করে।
কারোর মনে ভয় লাগে, রথের রশি কে সাপের ফণা বলে বিভ্রম জাগে, আবার কেউ ভাবে রথের রশি নিজে থেকে নড়লে চাকার তলায় নিজেদেরই পড়তে হবে। মানুষের অবচেতনে যে পাপবোধ সঞ্চিত থাকে এইসব মানুষের উৎকণ্ঠায় তাই প্রমাণিত। তাদের মনে হয় ‘দেশে পুণ্যাত্মা কেউ নেই কি আজ/ ধরুক না এসে দড়িটা’। মহিলাদের কথায় ফুটে ওঠে চিরাচরিত সংস্কারের কারণে ভীতি, সমাজে সংসারের নানা অলক্ষণের দিন বুঝি ঘনিয়ে উঠেছে। নারীকে যে সমাজ অশ্রদ্ধা বশত দূরে ঠেলেছে, মহাকালের রথ চালনায় তার ভূমিকা স্বীকার করেনি সেই নারী কন্ঠই আজ সোচ্চারিত। দ্বিতীয়া বলে, ‘আমরা না থাকলে পুরুতের পেট হতো না এত মোটা।’ যেখানে সমাজে এত উঁচু নিঁচুর ভেদাভেদ তা যতদিন সমান না হচ্ছে ততদিন রথের রশি নড়বে না। এ যেন মানব সমাজে মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর শোষণ ও নির্যাতন চালানোর ঘটনাকে দিক্ নির্দেশ করে। যা দেখে রবীন্দ্রনাথের হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তখনই মনে পড়ে আর এক দার্শনিক মার্কসের কথা। সন্ন্যাসীর এই কথা বিস্মিত করে তৃতীয়াকে- “বাবা সাত জন্মে শুনিনি এমন কথা/ চিরদিনই তো উঁচুর মান রেখেছে নিচু মাথা হেঁট করে/উঁচু-নিঁচুর সাঁকোর উপর দিয়েই তো রথ চলে।” সাংকেতিক নাটক এইভাবে বিচিত্র মনস্তত্ত্ব, বিচিত্র সাধারণ মানুষের সংলাপে উঠে এসে নাটকের অভিনয় ও মঞ্চউপস্থাপনার বাস্তবতার দরজা-জানালাগুলো খুলে দেয়। চিরাচরিত অভ্যাসের সংস্কারে এইসব মানুষ মনে করে উঁচু বর্ণের কাজে নিচু বর্ণের মানুষে হাত দিয়েছে বলেই এই অনর্থ। চিরকালীন সমাজ ব্যবস্থার অদলবদল হতে দিতে আত্মশ্লাঘা জাগে কিছু মানুষের। তাই প্রথম সৈনিক বলে, ‘আজ শুদ্র পড়ে শাস্ত্র,/ কাল লাঙ্গল ধরবে ব্রাহ্মণ। সর্বনাশ!’ ক্ষমতার জোরে চিরকাল ঠেকিয়ে রাখা যায় না মানুষের অধিকার। তারই প্রতিফলন দেখতে পাই ‘মে দিবস’। শুদ্র পাড়ায় গোল ওঠে- চর এসে মন্ত্রী কে খবর দেয় ‘দলে দলে ওরা আসছে ছুটে- বলছে, রথ চালাবো আমরা।’ শুদ্রদের দলপতি বলে, ‘এতদিন আমরা পড়তেম রথের চাকার তলায়, দলে গিয়ে ধুলোয় যেতুম চ্যাপ্টা হয়ে। এবার সেই বলি তো নিল না বাবা।’ রথের রশি টানার অধিকার দেবতা যে তাদেরই দিয়েছেন। পুরোহিত বলে, ‘স্পর্ধা দেখো একবার। কথার জবাব দিতে শিখেছে।’ নাটকীয় দ্বন্দ্বের মুহূর্ত নির্মাণে এই ভাবেই বিচিত্র সাধারণ মানুষের উপস্থাপনা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সৈনিকরা বাধা দিতে এলে দলপতি বলে, ‘আমরাইতো যোগাই অন্ন, তাই তোমরা বাঁচ/ আমরাই বুনি বস্ত্র, তাতেই তোমাদের লজ্জা রক্ষা।’ তাদেরই টানে রথের চাকা নড়ে ওঠে- পুরোহিতের কাছে তা অবিশ্বাস্য, সৈনিকদের মনে ভয় ও আতঙ্ক আর নারীরা দেখলো পুরোহিত এতদিন যা শিখিয়েছে তা ভুল। সৈনিকের প্রশ্নে এই উল্টোপাল্টা ব্যাপারের কৈফিয়ৎ দিল কবি- ‘মানুষের সঙ্গে মানুষকে বাঁধে যে বাঁধন তাকে ওরা মানেনি/ রাগী বাঁধন আজ উন্মত্ত হয়ে লেজ আছড়াচ্ছে-/ দেবে ওদের হাড় গুঁড়িয়ে।’ কবির অন্তর দৃষ্টিতে সাংকেতিক নাটকে সাধারণ মানুষের ভূমিকা বিশেষ ব্যঞ্জনার মাত্রা নিয়ে ধরা দেয়।
রাজা স্বয়ং হাত লাগিয়ে আছেন কিন্তু রশি নড়ে না। কে যেন রাজাকে বলছে যুগটা ধনতন্ত্রের, এখানে ‘না চলে শাস্ত্র, না চলে শস্ত্র/ চলে কেবল স্বর্ণচক্র।’ সৈনিকরা ও জানে যে একালে রাজা থাকেন সামনে। পেছনে থাকে বেনে। যাকে বলে ‘অর্ধ-বেনে-রাজেশ্বর মূর্তি।’ কিন্তু সৈনিকদের কারো কারো আবার অভিমান লাগে, তাদের তলোয়ার আছে, তারা কেন বণিকদের মানতে যাবে। তবে নাগরিকদের একজন সতর্ক করে দেয়: ‘তোমাদের তলোয়ার গুলোর কোনোটা খায়/ ওদের নিমক কোনোটা খেয়ে বসেছে ওদের ঘুষ।’ বণিকরা এগিয়ে আসে, রথের রশি ধরে তারা টান দেবে কিন্তু টান দেওয়া দূরের কথা, রশিটাকে তারা টেনে তুলতেই পারে না। রণে তাদেরকে ভঙ্গ দিতে হয়। ধনপতিরা লজ্জিত হয়, তারা স্বীকার করে চাকায় তেল দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু রশিতে কখনো টান দেয়নি।
রাজা হেরে গেলেন, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য সবাই ব্যর্থ, তাহলে উপায় কি? উপায় নিজেই এসে উপস্থিত। শূদ্র (শ্রমিক) পাড়ায় রটে গেছে যে রথ চলছে না। এবং তাদের কিছু করা দরকার। কেউ তাদের ডাকে নি, দলবেঁধে তারা নিজেরাই এসে হাজির হয়েছে। কারণ ইতিহাস বলে শ্রমিকশ্রেণীর উত্তরণ ছাড়া জাতির মুক্তি নেই। সৈনিকরা ঠাট্টা করে, কিন্তু মন্ত্রী বুদ্ধিমান, তিনি বুঝে ফেলেছেন যে রথ চলবে ওদেরই টানে। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ দলবেঁধে আসছে শুনে তিনি ভয় পান না, কিন্তু ওরাই রথটাকে সচল করতে পারবে এই আশঙ্কায় তিনি বসে পড়েন। তার এই ভয়টাকে সৈনিকেরা ঠাট্টা করে। মন্ত্রী জানেন ভয় করতেই হবে, কেননা তলোয়ারের বেড়া তুলে বন্যা ঠেকানো যায়না। এ যেন সেই চিরন্তন সত্যের কথা বলে, যেদিন শোষিত মানুষ জাগবে সেদিন শোষক এ গ্রহ ছেড়ে পালাবে। তার এই জ্ঞান আছে যে, এই শ্রমজীবীরাই আজ পেয়েছে নতুন কালের প্রসাদ। মান বজায় রাখতে হলে ওদের সমান হওয়া চাই, হাত দেওয়া চাই রথের রশিতে- ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। স্মরণীয় যে রথের রশি বা কালের যাত্রা লেখা হয় ১৯৩২ সালে। তার আগে ১৯৩০ এ রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবপরবর্তী রুশদেশে শ্রমিক শ্রেণী কিভাবে সমাজকে বদলে দিয়েছে সেটা দেখে এসেছেন, এবং সে অভিজ্ঞতার কথা ১৯৩১ সালে লেখা রাশিয়ার চিঠিতে প্রকাশ করেছেন। শ্রমজীবীরা যে ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এবং পুঁজিবাদের তৎকালীন আধিপত্যের কালে কাজটা যে কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব ছিল তা তিনি উপলব্ধি করেছেন।
শ্রেণি বৈষম্যমূলক সমাজের থেকে শ্রেণিহীন সমাজ যে অধিক কাম্য, মানুষে মানুষে ব্যবধান বজায় রাখার থেকে সকলের সমান অধিকার গড়ে ওঠা যে অনেক বেশি বাঞ্ছনীয় এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এই শ্রেণী শাসনের কবলে যেহেতু পৃথিবীর এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বসবাস করেন, তাই রবীন্দ্রনাথের এ নাটকের মর্মবাণী এখনো যে অটুট তা প্রমাণ করে। ধণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের যে পার্থক্য এ নাটক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই নাটক আরও প্রমাণ করে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে অধিক বাঞ্ছনীয় তা মনে হয় অতি ধনী ব্যক্তি ছাড়া প্রায় সকলেই স্বীকার করবেন। আর তা যদি আমরা বিশ্বাস না করি, তাহলে পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। এবং তার দায়ে আমরা সকলেই অভিযুক্ত হব। এই সত্য মনে রাখা তাঁর জন্মদিনে তাঁকে শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি।