শেরশাহের রাজস্ব ও প্রশাসনিক সংস্কার মূল্যায়ন।

Table of Contents

শেরশাহের রাজস্ব ও প্রশাসনিক সংস্কার:

শেরশাহ মাত্র পাঁচ বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু এই স্বল্পকালের মধ্যে সামরিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রতিভার সমন¦য়ে তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থেকেও নব-প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের শান্তি রক্ষা ও সুশাসনের উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা প্রবর্তন করে ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। শেরশাহ আলাউদ্দিন খলজীর শাসনপদ্ধতির কিছু মূলনীতি অনুসরণ করেছিলেন। তবে অধিকাংশ ছিল তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবন।তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতের হিন্দু-মুসলিম শাসন পদ্ধতির কিছু কিছু মৌলিক নীতি গ্রহণপূর্বক স্বীয় প্রতিভার দ্বারা সেগুলোকে আধুনিক রূপদান করেছিলেন। ভূমি রাজস্ব ও প্রশাসনিক সংস্কারে নতুনত্ব আনয়নের ক্ষেত্রে শেরশাহ বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। বৃটিশ ঐতিহাসিক কিনি শেরশাহের শাসন পদ্ধতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে মন্তব্য করেন যে, কোন শাসকই এমনকি বৃটিশ সরকারও শাসনকার্যে শেরশাহের ন্যায় পারদর্শিতা প্রদর্শন করেননি।

ভূমি রাজস্ব ও প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে শেরশাহ অভিনব কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। শেরশাহের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব সংস্কার ছিল নিম্নরূপ-

শেরশাহের রাজস্ব সংস্কার:

ভূমি জরিপ:

শেরশাহ ই প্রথম ব্যক্তি যিনি ভারতের ইতিহাসে সার্বজনীন ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করেন । ভূমি রাজস্ব উন্নয়নের জন্য তিনি একই পরিমাপের ভিত্তিতে সমস্ত ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করেন।  ইতিপূর্বে কেউই পূর্ণাঙ্গভাবে ভূমি জরিপ করতে পারে নাই। তিনি ফসল উৎপাদন মৌসুমে ভূমি জরিপ চালান, তার ভূমি জরিপের মাধ্যমে আবাদি জমির পরিমাণ নির্ধারিত হয় ফলে রাজস্ব নির্ধারণ করা সহজ হয় । তার পরিমাপের একক ছিল সিকান্দারি বিঘা

ভূমির শ্রেণী বিভাগ:

উর্বরতা শক্তির উপর ভিত্তি করে শেরশাহ আমাদের ভুলকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন এবং উৎপাদন স্তর অনুযায়ী তিনি রাজস্ব নির্ধারণ করেন।

I.          উত্তম শ্রেণি

II.         মধ্যম শ্রেণীর এবং

III.        নিম্ন শ্রেণীর

শেরশাহের রাজস্ব নির্ধারণ:

আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতে রাজস্ব সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা রয়েছে । শেরশাহ রাজস্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে অভিনব এবং মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি  বিভিন্ন শ্রেণীর জমিতে বিগত কয়েক বছরের উৎপাদিত ফসলের গড়করে তার তিনভাগের একভাগ রাজস্ব নির্ধারণ করেছেন।  ঐতিহাসিক মোড়ল্যান্ড এর মতে প্রতি সিকান্দারী বিঘার ক্ষেত্রে রাজস্বের পরিমাণ ছিল নিম্নরূপ-

I.          উত্তম শ্রেণি ১৮

II.         মধ্যম শ্রেণী ১২ মন এবং

III.        নিম্ন শ্রেণী ৮ মন ৩৫ সের

শেরশাহের রাজস্ব আদায় পদ্ধতি:

শেরমাহের আমলে নগদ টাকা বা উৎপন্ন দ্রব্যে রাজস্ব দেওয়া যেত । তবে পচলশীল দ্রব্যের ক্ষেত্রে নগদ অর্থে রাজস্ব নেয়া হতো।এই রাজস্ব সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে আদায়ের ব্যবস্থা করা হয় । এর ফলে মধ্যস্বত্বভেগী – শ্রেণির শোষন থেকে কৃষকেরা মুক্তি পায় ।

শেরশাহের কবুলিয়ত ও পাট্টা ব্যবস্থার প্রচলন:

শেরশাহের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব সংস্কারের  ক্ষেত্রে কবুলিয়াত ও পাট্টা সর্বাধিক প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ দুটি শব্দ। শেরশাহ রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করে পাট্টা ও কবুলিয়ত প্রথার প্রবর্তন করেন। সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত যে দলিলে কৃষকের নাম, জমিতে কৃষকের অধিকার ও রাজস্ব দেওয়ার পরিমাণ প্রভৃতি উল্লেখ করে লেখা থাকত, তাকেই পাট্টা বলে ।পাট্টা হলো কোনো ব্যক্তির জমি ভোগ দখলের সরকার স্বীকৃত অধিকার পত্র। এতে জমির দাগ নম্বর , প্রজার নাম , জমির স্বত্ব ও দেয় রাজস্ব উল্লেখ থাকতো।

আর যে দলিলে কৃষক রাজস্ব দেওয়ার কথা কবুল করে সরকারকে একটি অঙ্গীকারপত্র দিত, তাকে কবুলিয়ত বলে।পাট্টার শর্তগুলো মেনে নিয়ে প্রজা যেই সম্মতিপত্র দিতেন তাই কবুলিয়াত। এর মাধ্যমে চাষিরা জমির মালিকানা ও দখল প্রমাণের সুযোগ পায়।

শেরশাহের জমিদারি উচ্ছেদ:

শেরশাহ  জমিদারী উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন । মূলত তিনি রায়তওয়ারি ব্যবস্থা এবং কবুলিয়ত ও পাট্টা প্রচলন মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চেয়ে ছিলেন যাতে মধ্যস্বত্বভোগী জমিদারদের বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু তিনি তাতে পুরোপুরি সফল হন নাই কেননা তখনো অনেক বড় বড় জমিদার বিদ্যমান ছিল।

শেরশাহের জরিবানা ও মাহসিলানা:

উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের এক অংশ নেওয়ার পরেও শেরশাহ জরিবানা ও মাহসিলানা নামের আরও দুটি কর কৃষকের থেকে আদায় করতেন। জরিপ কর্মচারীদের জন্য ফিস হিসেবে জরিবানা এবং রাজস্ব কর্মচারীদের বেতন হিসেবে মাহসিলানা না আদায় করা হতো।

শেরশাহের রাজস্ব উৎস:

ক. কেন্দ্রীয়ভাবে আদায় কৃত উৎস সমূহ

1.  ওয়ারিশবিহীন সম্পত্তি

2.  বাণিজ্য শুল্ক

3.  লবণ কর

4.  আবগারি শুল্ক

5.  উপহার-উপঢৌকন

6.  জিজিয়া

7.  খারাজ

8.  ভূমি রাজস্ব ও

9.  খুমুস

খ. স্থানীয়ভাবে আদায় কৃত রাজস্ব:

স্থানীয়ভাবে আদায় কৃত রাজস্বকে বলা হত আবওয়াব। এই রাজস্বের উৎস গুলো হল

1.  বাণিজ্য দ্রব্য

2.  ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী

3.  আমদানী ও রপ্তানী কারক এবং

4.  বিভিন্ন পেশাজীবীদের উপর আরোপিত কর

শেরশাহের রাজস্ব আদায় পদ্ধতি:

রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ের ক্ষেত্রে শেরশাহ একটি নীতি মেনে চলতেন । জমিতে রাজস্ব নির্ধারণের ব্যাপারে যথাসম্ভব উদারতা এবং ছাড় দেওয়া হতো কিন্তু রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে কঠোরতা  প্রদর্শন করা হতো , অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাজস্ব আদায় করা হতো এবং প্রজাদের  উপর অত্যাচার ও নিপীড়নের না করার জন্য তিনি এ কর্মচারীদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

শেরশাহের মওকুফ ও তাকাভী ঋণ:

রাজস্ব নির্ধারিত থাকলেও সৈন্য পরিচালনা বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের হানি ঘটলে   তিনি  রাজস্ব মওকুফ করতেন এবং ক্ষতিপূরণ দিতেন । এছাড়া দুর্যোগকালীন সময়ে জমি চাষাবাদের জন্য তিনি কৃষকদের মাঝে সুদ মুক্ত কৃষিঋণের তথা তাকাভী  ঋনের   সরবরাহ করতেন, এতে কৃষকরা বেশ উপকৃত হতো।

শেরশাহের শস্য ভান্ডার স্থাপন

শেরশাহ বিভিন্ন স্থানে সরকারি শষ্যভাণ্ডার স্তাপন করেন। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য শেরশাহ বিঘা প্রতি অতিরিক্ত কর সেস হিসেবে আদায় করতেন এবং তা শস্য ভান্ডার জমা রাখতেন।এছাড়া আদায়কৃত রাজস্বের ২.৫% রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা রাখা হতো। যে কোন প্রতিকুল সময়ে শষ্যভান্ডার থেকে নাম মাত্র মূল্যে জনগনের মধ্যে শষ্য সরবরাহ করা হতো।

শুধু ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব সংস্কারই নয় প্রশাসনিক সংস্কারের  ক্ষেত্রেও শেরশাহ অসামান্য কৃতিত্বের দাবিদার। নিম্নে শেরশাহের প্রশাসনিক সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

শেরশাহের বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা:

শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে শেরশাহ তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭টি সরকারে/শিক  বা অঞ্চলে ভাগ করেছিলেন। আবার প্রত্যেক সরকারকে কয়েকটি পরগণায় ভাগ করেন। প্রত্যেকটি পরগণায় একজন করে শিকদার, আমীন, মুনসীফ, খাজাঞ্চী বা কোষাধ্যক্ষ, দু’জন ‘কারকুন’ (হিসাব লেখক, একজন হিন্দু ও একজন মুসলিম)থাকতেন।পরগণার সামরিক অধিকর্তা হলেন শিকদার।কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশনির্দেশ কার্যকরী করা, প্রয়োজনের সময় আমীনকে সামরিক সহায়তা প্রদান করা ছিল তাঁর কর্তব্য। আমীন ছিলেন সর্বোচ্চ বেসামরিক কর্মকর্তা। পরগণার রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায় করাই ছিল তাঁর কর্তব্য।প্রত্যেকটি সরকারের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন শিকদার-ই-শিকদারান এবং মুন্সীফ-ই-মুনসীফান।মুনসীফ-ই-মুনসীফান সাধারণত দিওয়ানী মামলার বিচার করতেন এবং শিকদার-ই-শিকদারান সরকারের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃ´খলা রক্ষা ও বিদ্রোহ দমনে নিযুক্ত থাকতেন।

শেরশাহের শুল্ক নীতি:

ভূমি রাজস্ব সংস্কারের পরই মুদ্রা ও শুল্ক সংস্কার শেরশাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতির জন্যে তিনি আন্ত:প্রাদেশিক শুল্ক আদায়ের রীতি তুলে দিয়ে কেবলমাত্র সীমান্তে অথবা বিক্রয়ের স্থলে উক্ত শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের যথেষ্ট সুবিধা হয়। এরফলে যেখানে সেখানে সমগ্র দেশব্যাপী ব্যবসায়ীদের ওপর শুল্ক আদায়ের জুলুম বন্ধ হয়ে যায়।

শেরশাহের মুদ্রানীতি:

শেরশাহ মুদ্রা ব্যবস্থারও সংস্কার সাধন করেন। তিনি তাঁর মুদ্রার উপাদানে নির্ভেজাল, ওজনে সঠিক ও গঠনরীতিতে মনোরম ইত্যাদি বিষয়ের ওপর প্রভুত গুরুত্ব প্রদান করেন। তিনি চতুষ্কোণ ও গোলাকার দু’ধরনের মুদ্রা চালু করেন। তিনি সোনা, রূপা ও তামার পৃথক মুদ্রা চালু করেন। তামার মুদ্রাকে বলা হতো দাম। এছাড়া আনি, দু’আনি, সিকি, আধুলি স্তরের মুদ্রাও প্রচলন করেছিলেন।এসঙ্গে মুদ্রার নকসার উন্নতি সাধন করেন। তাঁর এই মুদ্রানীতির সংস্কারের ফলে সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে লেনদেনের অসুবিধা দূর হয়। তাঁর মুদ্রা পদ্ধতি মুঘল ও কোম্পানি আমলেও বজায় ছিল। প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল ব্রিটিশ মুদ্রার ভিত্তি

শেরশাহের কেন্দ্রীয় সরকার:

কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং।তিনি ছিলেন সকল শক্তির আধার । ঐতিহাসিক ত্রিপাঠীর মতে, শেরশাহ যতই কর্মঠ এবং পরিশ্রমী হোন না কেন তাঁর পক্ষে একা সব কাজ দেখাশোনা করা সম্ভব ছিল না । রাজকাজে সাহায্যের জন্য তিনি কয়েকজন মন্ত্রী নিয়োগ করেন-

শেরশাহের প্রাদেশিক সরকার:

1. শাসনের সুবিধার জন্য শেরশাহ তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭ টি শিক বা সরকারে বিভক্ত করেন। প্রতিটি সরকারে শিকদার-ই-শিকদারান এবং মুনসিফ-ই-মুনসিফান নামক দুজন প্রধান কর্মচারী থাকতেন । তাঁরা যথাক্রমে সাধারণ প্রশাসন এবং বিচার ও রাজস্ব বিভাগ তত্ত্বাবধান করতেন ।

2. প্রতিটি সরকার আবার কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত ছিল। প্রতিটি পরগনায় শিকদার ও মুনসিফ নামক দুজন প্রধান কর্মচারী থাকতেন। তাঁদের সাহায্য করতেন কারকুন , আমিন , কানুনগো , ফোতেদার নামক কর্মচারীরা ।

3.  শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল গ্রাম। খুৎ, মুকদ্দাম, চৌধুরী, পাটোয়ারী প্রমুখ কর্মচারী গ্রাম-শাসনের কাজে নিযুক্ত থাকতেন। গ্রামশাসনে পঞ্চায়েতের বিশেষ ভূমিকা ছিল । কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য বছর অন্তর তাদের বদলি করা হত ।

শেরশাহের প্রশাসনিক বিভাজন:

  1. প্রশাসনিক ইউনিট    সামরিক প্রধান বেসামরিক প্রধান

2. শিক/সরকার (৪৭টি) শিকদার ই শিকদারান মুন্সিফ ই মুন্সিফান

3. পরগনা শিকদার আমিন/মুন্সিফ

4. গ্রাম   চেীধুরি,খুত, মোকাদ্দাম,পটাটোয়ারি ইত্যাদি

শেরশাহের বিচার সংস্কার:

শেরশাহের বিচারব্যবস্থা ছিল নিরপেক্ষ ও উন্নতমানের । আইনের চোখে সকলেই ছিল সমান । বিচারক্ষেত্রে জাতি , ধর্ম বা ব্যক্তির মধ্যে বৈষম্য করা হত না । বিচারব্যবস্থার চূড়ায় ছিলেন সম্রাট শেরশাহ স্বয়ং । তবে বিভিন্ন স্তরে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার পরিচালনার জন্য বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন । প্রতিটা পরগনায় দেওয়ানি বিচারের দায়িত্ব ছিল আমিন নামক কর্মচারীর ওপর এবং ফৌজদারি বিচারের ভার ছিল কাজী ও মীর আদল এর ওপর। কয়েকটি পরগনার ওপর দেওয়ানি বিচারের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন মুনসিফ-ই-মুনসিফান নামক কর্মচারী এবং ফৌজদারি বিচারের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন কাজউকাজাতন বা প্রধান কাজী ।

শেরশাহের সেনাবাহিনীর সংস্কার:

শেরশাহের সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং শৃঙ্খলা পরায়ণ । তিনি আলাউদ্দিনের সামরিক রীতির অনুকরণে সেনাবাহিনীকে দেশের বিভিন্ন অংশের সেনানিবাসে মোতায়েন রাখতেন ।প্রতিটি সেনানিবাসের দায়িত্বে ছিলেন একজন করে ফৌজদার । এ ছাড়া সম্রাটের অধীনে ছিল ২৫ হাজার পদাতিক ও দেড় লক্ষ অশ্বারোহীর এক বিশাল ও সুদক্ষ বাহিনী ।যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর যুদ্ধযাত্রার ফলে ফসল বা সম্পত্তির ক্ষতি হলে শেরশাহ্ রাজকোশ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রীতি চালু করেন । শেরশাহ তার সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহীর, পদাতিক সেনা এবং হস্তী বাহিনীর উন্নতি ঘটান। সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে ‘দাগ’ ও ‘হুলিয়া’ ব্যবস্থা চালু করেন। দাগ অর্থাৎ সেনাবাহিনীর ঘোরাগুলির গায়ে চিহ্নিত করা। হুলিয়া ছিল সেনাদের দৈহিক বর্ণনামূলক তালিকা।

শেরশাহের পুলিশবাহিনীর সংস্কার:

দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষার ভার ছিল পুলিশবাহিনীর হাতে। শেরশাহ গ্রামাঞ্চলের শান্তি- শৃঙ্খলার দায়িত্ব গ্রামের মােড়লদের ওপর অর্পণ করেছিলেন । গ্রামে গ্রাম-পঞ্চায়েত ও গ্রাম- প্রধান শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করতেন। সরকারি কর্মচারীরা দেশে চুরি-ডাকাতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে তাদেরই শাস্তি দেওয়া হত । ফিরিস্তা লিখেছেন, শেরশাহের আমলে পুলিশ ব্যবস্থা এতই দক্ষ ছিল যে, পর্যটকরা পথের ধারেই তাদের মূল্যবান দ্রব্যাদি রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতেন। এই বক্তব্য হয়তো কিছুটা অতিরঞ্জিত; কিন্তু এ থেকে তখনকার উন্নত আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কে ধারণা করা যায় ।

সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি:

শেরশাহ ভারতের বেশ কয়েকটি বড় বড় রাস্তা তৈরি করেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সড়ক-ই আজম। যা বাংলার সোনারগাঁও থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পেশোয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় 2400 কিলোমিটার। এই রাস্তাটি বর্তমানে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে খ্যাত। পথচারীদের সুবিধার জন্য রাস্তার দু-পাশে তিনি সারি সারি গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেন এবং তাদের বিশ্রামের জন্য কিছু দূরত্ব অনুযায়ী সরাইখানা নির্মাণ করেন ।

ডাক ব্যবস্থা:

ভারতীয় উপমহাদেশের ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন শেরশাহ । শেরশাহ প্রচলন করার আগে কি ঘোড়া ডাকতো না? উত্তরটা হচ্ছে- তখনও ঘোড়া ডাকতো, তবে তিনি যে ডাক প্রচলন করেছিলেন সেটি ডাকাডাকির ডাক নয়, ডাকব্যবস্থার ডাক। শেরশাহ চিঠি পাঠানোর জন্য ডাকব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন, সেই ব্যবস্থায় চিঠি পৌছানোর বাহন ছিল ঘোড়া। এইজন্য সেই ডাকব্যবস্থাকে ঘোড়ার ডাক বলা হয়।

বদলি ব্যবস্থা:

শেরশাহ ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত শাসন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন এবং যাতে কোন রাজকর্মচারী স্থানীয় প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে না পারে এবং দুর্নীতিতে জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য প্রতি তিন বৎসর পর পর নিয়মিতভাবে তাদের বদলির ব্যবস্থা করেছিলেন। এটা ছিল তার একটি দূরদর্শী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।

সমালোচনা:

অনেকেই শেরশাহের রাজস্ব ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। মূল্যায়ন বলেন, একটা বৈজ্ঞানিক ছিল না। কারণ জরিপকারীরা খামখেয়ালি করতো, অনেক পার্থক্য ছিল। ত্রিপাঠি বলেন, পরিমাপের ওজনে মিলছিল,আদায়কারীরা দুর্নীতি করতো  ও কৃষকের উপর অত্যাচার করতো । আবার কেউ কেউ বলেন রাজস্ব আদায়ে কৃষকদের কোন সুবিধা দেওয়া হয়নি ।তবে এসব সমালোচনা কার্যত বস্তুনিষ্ঠ নয়।বৃহত্তর  কর্মকাণ্ডের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে, তা ছাড়া অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণই শেরশাহের সংস্কারের ভূয়শী প্রশংসা করেছেন।  আকবরের সময়ে টোডরমলের বন্দোবস্ত এবং ব্রিটিশদের রায়তওয়ারি ব্যবস্থার মূলে ছিল শেরশাহের এই ভূমি রাজস্ব এবং ভূমি ব্যবস্থাপনা সংস্কার।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading