উদ্ধৃতি: “শিক্ষা জিনিসটে আসলে মনের স্যানিটেশন বই আর কিছুই নয়”
এই মন্তব্যটি প্রমথ চৌধুরী’র বিখ্যাত প্রবন্ধ “শিক্ষার সংকট” থেকে এসেছে। এখানে প্রমথ চৌধুরী শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং তার সঠিক ভূমিকা সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর এই মন্তব্যটির মাধ্যমে তিনি শিক্ষা কীভাবে একজন ব্যক্তির মনের ভিতর অপ্রয়োজনীয় ধারণা বা অজ্ঞতা দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, তা তুলে ধরেছেন।
মনের স্যানিটেশন:
“মনের স্যানিটেশন” বলতে প্রমথ চৌধুরী মনের পরিস্কারকরণ বা বিশুদ্ধকরণের ধারণাটি বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, মানুষের মনে যেসব অপ্রয়োজনীয়, ভুল ধারণা বা পূর্বগ্রহণ (prejudice) বিদ্যমান, সেগুলোকে সাফ বা পরিস্কার করা। প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন যে, শিক্ষার মূল কাজ হল মানুষের মনকে সঠিক ধারণা, জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ করা। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, যে ধরনের সমাজ বা সংস্কৃতি কোনো সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে, সে সমাজ বা সংস্কৃতির মধ্যে অনেক রকমের ভুল ধারণা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং অবাঞ্ছিত মানসিকতা বাস করে থাকে, যা সমাজের উন্নতি এবং সভ্যতার দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে বাঁধা সৃষ্টি করে।
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য:
প্রমথ চৌধুরী শিক্ষা সম্পর্কে আরও বলেছেন, শিক্ষা কেবলমাত্র বইয়ের পাঠ বা তত্ত্ব জানানো নয়, বরং মানুষের আত্মিক উন্নয়ন এবং মনের খোলামেলা দৃষ্টি তৈরির মাধ্যম হওয়া উচিত। তিনি সাফ বলছেন, শিক্ষা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক জ্ঞান অর্জন নয়, বরং মানসিকতা এবং মনের দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়ন করা উচিত।
এখানে “শিক্ষা জিনিসটে আসলে মনের স্যানিটেশন বই আর কিছুই নয়” মন্তব্যে শিক্ষার পরিস্কারকরণ এবং সচেতনতা সৃষ্টি বোঝানো হয়েছে। মানুষের মধ্যে যতটা প্রশস্ততা, আধুনিক চিন্তা এবং নির্দিষ্ট মূল্যবোধ আনা সম্ভব, সেটাই শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত সবচেয়ে বড় কাজ। প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, শিক্ষা একটি সামাজিক ও ব্যক্তিগত পরিস্কারের প্রক্রিয়া, যা শুধু মেধা বা তত্ত্বের সীমা পেরিয়ে মনের ভুল ধারণা, অজ্ঞতা এবং অবিচার দূর করতে সহায়তা করে।
সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং শিক্ষার ভূমিকা:
প্রমথ চৌধুরী যখন এই মন্তব্যটি করেছিলেন, তখন বাংলা সমাজ ছিল বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে। তখনকার সময়ে ভারতবর্ষের সমাজে বেশ কিছু বিচ্ছিন্নতা, কুসংস্কার, সামাজিক বৈষম্য এবং অধিকারহীনতা ছিল, যা শিক্ষার অভাবে আরও প্রকট হচ্ছিল। প্রমথ চৌধুরী এই সংকটের কথা তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন যে, এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র ভালো শিক্ষা-র মাধ্যমে পাল্টানো সম্ভব। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষের মনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব, যা পরবর্তীতে সমাজের সমৃদ্ধি এবং উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে।
শিক্ষার প্রভাব:
“মনের স্যানিটেশন” কথাটি দ্বারা প্রমথ চৌধুরী বুঝিয়েছেন, শিক্ষা মানুষের চিন্তা ও মূল্যবোধকে শুদ্ধ এবং পরিষ্কার করে তোলে। মনের স্যানিটেশন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানুষ শুধুমাত্র বাহ্যিক জ্ঞান অর্জন নয়, বরং নিজস্ব মনোজগতের ভিতরে বাস করা সমস্ত নেতিবাচক এবং ভুল ধারণাকে পরিহার করে, এবং উচ্চমানের সত্ত্বার দিকে অগ্রসর হয়। শিক্ষা আসলে মনকে শুদ্ধ করে, তাকে সত্যের দিকে পরিচালিত করে, এবং তার মধ্যে বোধের গভীরতা সৃষ্টি করে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, শিক্ষার স্যানিটেশন বলতে, প্রমথ চৌধুরী এমন একটি শিক্ষার ধারণা পেশ করেছেন, যা জীবনদৃষ্টিভঙ্গি-র পরিবর্তন ঘটায়। শিক্ষা এমন হতে হবে যাতে একজন শিক্ষার্থী শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়, বরং সমাজের, মানুষের এবং তার নিজস্ব অস্তিত্বের গভীরে প্রবাহিত হয়ে তাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এটি ব্যক্তি এবং সমাজের মাঝে সামাজিক সংহতি এবং মানবিক বোধ তৈরি করবে।
ভুল ধারণা দূর করা:
তাঁর দৃষ্টিতে, বাংলা সমাজে সেই সময়ে বিভিন্ন প্রকারের অন্ধবিশ্বাস এবং অপ্রচলিত চিন্তা ছিল, যা মানুষের মনের ভিতরে জমে থাকতে দেখে প্রমথ চৌধুরী শিক্ষাকে একটি অন্তর্দৃষ্টির প্রশিক্ষণ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষা শুধুমাত্র বইয়ের জ্ঞান দেয় না, এটি মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি পরিবর্তন করে, তাকে নতুন করে চিন্তা করতে শিখায় এবং জীবনের উদ্দেশ্য বোঝাতে সহায়তা করে। শিক্ষা যদি সত্যিকার অর্থে কার্যকর হয়, তবে তা মানুষকে ভুল ধারণা, কুসংস্কার, এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সংশোধন করে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
উপসংহার:
প্রমথ চৌধুরীর এই উক্তি “শিক্ষা জিনিসটে আসলে মনের স্যানিটেশন বই আর কিছুই নয়” সমাজের আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং মানসিক মুক্তি সম্পর্কে একটি গভীর দর্শন তুলে ধরেছে। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, সত্যিকারের শিক্ষা মানবতার জন্য স্বাস্থ্যকর মানসিকতা এবং নতুন চিন্তার সূচনা ঘটাতে পারে। এটি মানুষের মনের মধ্যে গড়ে ওঠা সব ভুল ধারণা, কুসংস্কার ও নেতিবাচক ভাবনাকে ধুয়ে দিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। শুধুমাত্র বই পড়া বা পরীক্ষায় পাশ করাই প্রকৃত শিক্ষা নয়, শিক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা মানুষের মনের ভিতরে শুদ্ধতা, সদ্ভাবনা এবং আত্মবিশ্বাস আনে।